Afghanistan

আফগানিস্তানের চেয়ে পিছিয়ে

২০১৩ সালে পাশ হয় জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন, যা পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য সুলভ মূল্যে পাওয়ার অধিকারকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়েছে।

Advertisement

অমর্ত্য পাল ও উপাসক দাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০২০ ০১:১৬
Share:

গত ফেব্রুয়ারিতে সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এক স্কুল শিক্ষিকা জানান, নবাগত পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রীরা বিগত বছরের শিক্ষার্থীদের তুলনায় মাথায় খাটো। তাঁর অনুমান ছিল, সম্ভবত অপুষ্টিজনিত সমস্যাই এই উচ্চতা হ্রাসের মূল কারণ। তাঁর অভিজ্ঞতায়, দরিদ্র পরিবারের শিশুরা প্রায়শই মিড-ডে মিলের খাবার খেতে পারে না। জিজ্ঞাসা করলে বলে, পেটের সমস্যা। তার প্রধান কারণ সকাল থেকে খালি পেটে থাকা। প্রতিবেদনটি পড়ে কৌতূহলী হয়ে আমরা দূরভাষের মাধ্যমে কিছু স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের নিয়ে একটি সমীক্ষা করি। সেখানেও শুনি, “স্কুল চলাকালীন মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার ঘটনা হামেশাই লক্ষ করি। বেশির ভাগ সময়ই জিজ্ঞেস করলে জানা যায়, সকাল থেকে কিছু খায়নি।” দেশের হাল কী এমন যে, গরিব বাড়িতে পান্তাভাতটুকুও জুটছে না? অঙ্গনওয়াড়ি, মিড-ডে মিল এবং রেশনের মতো খাদ্যবণ্টনের ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও ন্যূনতম ডালভাত না জোটার কী কারণ?

Advertisement

রাষ্ট্রপুঞ্জের সদ্য প্রকাশিত দু’টি রিপোর্ট বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে— বিশ্বায়ন পরবর্তী যুগেও— ভারত অন্যতম খাদ্য-অসুরক্ষিত দেশ। সঙ্গে আছে চরম অপুষ্টির মতো ঘটনা। রিপোর্টে প্রকাশিত তিন বছরের চলমান গড়ের হিসেব অনুযায়ী ২০০১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ভারতে অপুষ্টির হার কমেছে ঠিকই, কিন্তু তা আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলির তুলনায় অনেকাংশে কম। প্রায় দুই দশকে ভারতে অপুষ্টি কমার হার ২৪.৭ শতাংশ (অর্থাৎ, বার্ষিক গড়ে ১.৫ শতাংশ), যেখানে চিন, নেপাল, পাকিস্তান, আফগানিস্তানে সেই হার যথাক্রমে ৭৬.৪, ৭৪, ৪২ এবং ৩৭.৪ শতাংশ। চিন ছাড়া বাকি দেশগুলো আর্থিক ভাবে ভারতের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। আফগানিস্তানের মতো দেশ, যারা গত দুই দশকে ভয়াবহ প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছে, তারাও অপুষ্টি প্রতিরোধে ভারতের চেয়ে এগিয়ে আছে।

২০০১ সালে দেশে ১৮.৬ শতাংশ শিশু অপুষ্টির শিকার ছিল, যা প্রথমে বেড়ে ২০০৪ সালে দাঁড়ায় সর্বোচ্চ ২২.২ শতাংশে। ২০০৯ সালে অর্থাৎ ইউপিএ-র প্রথম দফায় তা কমে দাঁড়ায় ১৬.৪ শতাংশ। এযাবৎ কালের মধ্যে সর্বাধিক কমার হার— পাঁচ বছরে প্রায় ২৬ শতাংশ। ইউপিএ-র দ্বিতীয় দফায় কিন্তু আবার এই পতনের হারের পরিমাণ নিতান্তই কম। ২০০৯ থেকে ২০১৪— এই ৫ বছরে কমার হার মাত্র ৬.৭ শতাংশ। ২০১৯-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে অপুষ্টির হার প্রায় ১৪ শতাংশ, অর্থাৎ বিজেপি সরকার প্রথম ৫ বছরে ৮.৫ শতাংশের কাছাকাছি কমাতে পেরেছে। মনে রাখতে হবে, ২০১১-১২ সাল পর্যন্ত সরকারি হিসেব অনুযায়ী (পরবর্তী সময়ে কোনও সমীক্ষা না হওয়ায় এর পরে দারিদ্রের আর কোনও সরকারি হিসেব নেই) দারিদ্রের হার যথেষ্ট কমলেও অপুষ্টির ক্ষেত্রে সেই কমার হার তুলনামূলক ভাবে কম। ২০১১-১২ পরবর্তী সময়ের তথ্য না থাকলেও এটা মেনে নিতে নিশ্চয়ই অসুবিধে হওয়ার কথা নয় যে, অর্থনৈতিক ডামাডোলের বাজারে এই পরিস্থিতির উন্নতি হওয়া প্রায় অসম্ভব। নোট বাতিল ও কোভিড-১৯’এর খাঁড়ার ঘা তো আছেই।

Advertisement

ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজ়েশনের তথ্য অনুযায়ী, খাদ্যশস্য রফতানির পরিমাণ কিন্তু যথেষ্ট বেড়েছে ওই সময়ে। আবার, কিলো-ক্যালোরির হিসেবে, দেশে দৈনিক জনপ্রতি খাদ্যের জোগান ওই একই সময়ে ভীষণ ভাবে কমে গিয়েছে। বার্ষিক হিসেব অনুযায়ী, ২০০০ সালে যেখানে দৈনিক মাথাপিছু ২৪ কিলো-ক্যালোরির সমান খাদ্য পাওয়া যেত, ২০১৪ সালে তা কমে গিয়ে ২০ কিলো-ক্যালোরিতে দাঁড়ায়। ২০১৭ সালে এই পরিমাণ দাঁড়িয়েছে জনপ্রতি মাত্র ৬ কিলো-ক্যালোরি। অর্থাৎ, অপ্রতুল খাদ্যের জোগান এবং দেশে অপুষ্টি থাকা সত্ত্বেও ওই সময়ে ভারত খাদ্যশস্য রফতানি করছে বিদেশের বাজারে।

কেউ বলতেই পারেন, এতে মাথাব্যথার কারণ নেই, যদি না সাধারণ মানুষের, বিশেষত বাচ্চাদের স্বাস্থ্যের উপর কোনও বিরূপ প্রভাব থাকে। তবে, পরিসংখ্যানের চিত্রটা সেখানেও খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। এফএও-র সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে প্রায় ১৭.৩ শতাংশ শিশু অতি মাত্রা থেকে স্বল্প মাত্রার ওয়েস্টিং (বয়সের অনুপাতে ওজনে কম)-এর শিকার ছিল, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে সর্বোচ্চ। ওই বছরই ৩৪ শতাংশেরও বেশি শিশু স্টান্টেড (বয়সের অনুপাতে উচ্চতায় কম) ছিল, যা সাহারা মরুভূমির দক্ষিণে অবস্থিত আফ্রিকার কিছু দেশের চেয়েও বেশি।

২০১৩ সালে পাশ হয় জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন, যা পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য সুলভ মূল্যে পাওয়ার অধিকারকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়েছে। তাতে সমস্যা মেটেনি। অতিমারি নিঃসন্দেহে অপুষ্টি ও ক্ষুধার এই সমস্যাকে আরও সঙ্কটজনক করে তুলতে চলেছে। বিশেষ করে দরিদ্র, প্রান্তিক মানুষদের জন্য পরিস্থিতির ভয়াবহতা অসীম। রাজ্যগুলো সাময়িক ভাবে বিভিন্ন যোজনায় এঁদের অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করলেও ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব এবং অর্থনৈতিক মন্দা আগামী দিনে সমস্যাকে আরও গভীর করতে পারে।

এই অবস্থায় গণবণ্টন ব্যবস্থাকে সর্বজনীন করে তার মাধ্যমে সুষম খাদ্য বণ্টন করতে হবে। সঙ্গে যৌথ রান্নাঘরের মতো ব্যবস্থার কথাও অবশ্যই ভাবা উচিত। এতে কিছুটা হলেও সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। মিড-ডে মিলের মতো প্রকল্পকে আরও বেশি ও কুশলী ভাবে কাজে লাগাতে হবে। এ বছর নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জের ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম। আশা করি, দশক শেষের এই পুরস্কার অপুষ্টি এবং ক্ষুধার মতো সামাজিক অভিশাপকে সম্পূর্ণ নির্মূল করতে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলির কাছে এক অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়াবে।

সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ়, তিরুঅনন্তপুরম; ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টার, ইংল্যান্ড

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement