ছোটরা পারছে। বড়রা হারছে?

এই রাজনীতি আমরা হারাতে বসেছিলাম, বাচ্চারা ফিরিয়ে দিল

সুকান্ত ভট্টাচার্য ‘ডাংগুলি খেলা নয়, গুলির সঙ্গে খেলা’ লিখতে গিয়ে প্রতিবাদী যৌবনের প্রতিনিধি হিসেবে দেখেছিলেন: ‘রক্ত-রাঙানো পথের দুপাশে ছেলের মেলা’।

Advertisement

রংগন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০২০ ০০:০১
Share:

স্পর্ধা: দেশ জুড়ে তরুণ প্রজন্ম প্রতিবাদে পথে নেমেছে। ১০ জানুয়ারি। শাহিনবাগ, নয়াদিল্লি। পিটিআই

ভারতীয় যৌবন, তোমাকে সালাম। কী বলব, এই বুড়ো বয়সে কী যে দারুণ লাগছে। দেশটাকে আমাদের চেয়ে যোগ্যতর বাচ্চাদের হাতেই রেখে যাচ্ছি। ফল যা-ই হোক, এই আন্দোলন আমাদের বাঁচাল।

Advertisement

সুকান্ত ভট্টাচার্য ‘ডাংগুলি খেলা নয়, গুলির সঙ্গে খেলা’ লিখতে গিয়ে প্রতিবাদী যৌবনের প্রতিনিধি হিসেবে দেখেছিলেন: ‘রক্ত-রাঙানো পথের দুপাশে ছেলের মেলা’। আমি জানি আজকে দেখলে ‘মেয়ের মেলা’ লিখতে তাঁর বাধত না। এই আন্দোলন যৌবনের তো বটেই, তবে লক্ষণীয় ভাবে মেয়েদের। সমাজের নানান স্তরের, নানান ঘরের মেয়েরা এগিয়ে এসেছে। মনে হয় মেয়েদের বেশি করে পড়তে আসা, কাজে আসা, নানান বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে নারীবাদী পাঠ্যক্রম, নারী আন্দোলনের মাধ্যমে মেয়েদের কমিউনিটি আর পরিসর তৈরি হওয়া থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চলে সংগঠন, বহু কারণে মেয়েদের জোর বেড়েছে, এই আন্দোলনে আমরা তার পরিষ্কার জয়ধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। এই আন্দোলনে ছেলেমেয়েদের মেলামেশাতেও একটা সহজিয়া ভাব দেখতে পাচ্ছি, যেটা এই ধর্ষণের দেশে বড় সুস্থ লাগছে। এই যে একটা রাজনৈতিক আন্দোলন পিতৃতান্ত্রিক নেতৃত্বকে অবান্তর করে তুলল, এর গুরুত্ব আমরা বুঝতে পারব আশা করি। পুরনো রাজনৈতিক দলের নেতাদের গায়ে যেন ‘টক টক গন্ধ’ পাওয়া যাচ্ছে। কী রকম পচে যাওয়া, বাতাসহীন, গাজোয়ারি, হতবুদ্ধি, হিংস্র। তাঁদের আদর্শগুলোও দলবাজির বেশি কিছু হয়ে উঠছে না।

মজার ব্যাপার, এক ধাক্কায় ধর্মের বিভাজনে দেশটাকে ভাগ করার হিসেব কী রকম উল্টে গেল। আমি ব্যক্তিগত ভাবে সাঙ্ঘাতিক ভিতু। যখন দেখি কেউ নিজেকে সামনে এনে বিপদের মোকাবিলা করছে, তখন আমার তার জন্য ভয় করতে থাকে। মেয়েদের আন্দোলন, সমকামী আন্দোলনে যুক্ত থাকার সময় মনে হত সমকামী ছেলে বা মেয়েটি প্রকাশ্যে আসছে, ওকে তো মারবে। কিন্তু এ-ও জানি লুকিয়ে থাকলে চিরকাল মার খেতে হবে। তাই এই আন্দোলনে মুসলমান চেহারা যেমন নির্ভয়ে সামনে এসেছে, নিজেকে সামনে তুলে যে ভাবে নাগরিকত্বের দাবি জানাচ্ছে, আন্দোলনে হিন্দু-মুসলমান আর বাকি সবাই যে ভাবে এক হয়ে যাচ্ছে, এটা বিশাল পাওনা। সব হিসেব উল্টে গিয়েছে।

Advertisement

দানবিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির দল লম্বা দৌড়ের ঘোড়া। আপাতত মনে হচ্ছে এই উদ্বেল জনরোষ তাদের হিসেবের মধ্যে ছিল না। কিন্তু আজকে আমি সেই হিসেবের কথা বলছি না। অন্য একটা উদ্বেগ ও আনন্দের কথা বলছি। আমাদের চেনা রাজনীতির দাবিদাওয়াগুলো বহু বছর ধরে নানান গোষ্ঠীর স্বার্থের দাবির বেশি কিছু হয়নি। এই ভাবে আদর্শকে আমরা কেবল নিজেদের ‘পাওয়া’র পক্ষের যুক্তিতে নামিয়ে এনেছি। সরকারি ডিএ-র আন্দোলন, শ্রমিকের বাড়তি মজুরির আন্দোলন, চাষির করছাড়ের আন্দোলন। জানি এগুলো সবই জরুরি আন্দোলন। কিন্তু কেবল এই আন্দোলনই হতে থাকলে, আদর্শের বদলে স্বার্থে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকলে প্রতিবাদী চেতনা কেবল নিজের প্রয়োজনের গণ্ডিতে আটকে যায়। বৃহত্তর পরিবেশ, সাম্প্রদায়িকতা, লিঙ্গসাম্য, বর্ণাশ্রম ভিত্তিক বৈষম্য— অর্থাৎ যাতে আমার নিজের কিছু পাওয়ার নেই, এমন কোনও বোধ তৈরি হয় না। গণতান্ত্রিক চেতনা তৈরি হয় না। তৈরি হয় নিজেদের প্রয়োজনে ঐক্যবদ্ধ নানান রাজনৈতিক বা সামাজিক গোষ্ঠী।

আর এই ভাবেই তৈরি হয় মণ্ডল কমিশন-বিরোধী আন্দোলনের মতো বিক্ষোভ। আজকের হিন্দুত্বের সমর্থক-জনভিত্তিকে বিশ্লেষণ করলে দেখব, কী ভাবে তা ‘ওদের হাতে সব হারানোর’ অলীক ভয়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এই ‘ওরা-র’ ধারণা ক্রমশ বাড়ছে। আরএসএস ‘এসসিএসটি মুর্দাবাদ’ ধ্বনি তুলছে। গোটা দেশ আউশভিৎস করে দিতে চায় ওরা। অনেক ‘বামপন্থী’দের মধ্যেও দেখি ছুপা মুসলিম বিদ্বেষ ও নারীবিদ্বেষ, সেটাও উদ্বেগজনক।

এই পটভূমিকায় এই আন্দোলন এত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এখানে আজকে যে বাচ্চারা জান বাজি রেখে লড়ছে তারা কিন্তু নিজেদের পাওয়ার গল্পের চেয়ে মহত্তর এক নাগরিক অধিকারের আদর্শ মাথায় নিয়ে লড়ছে। যারা আজ রাস্তায় তারা সবাই মোটেই শুধু নিজের নাগরিকত্ব নিয়ে চিন্তিত নয়। তারা এই পদক্ষেপের ফ্যাসিবাদী রাজনীতির আদর্শগত বিরোধ করছে। এই যে আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়ানোর রাজনীতি, বুকের মাঝে বিশ্বলোকের সাড়া পাওয়ার রাজনীতি, এই রাজনীতি আমরা হারাতে বসেছিলাম, বাচ্চারা আমাদের ফিরিয়ে দিল।

এই আন্দোলনের আর একটা অপূর্ব দিক হল, কোনও রাজনৈতিক দল এর ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে না। গোটা বিশ্বেই সমাজ বদলানোর আন্দোলনে বড় (লৌকিক ভাষায় দামড়া) রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই আন্দোলন তা নিয়েও রাস্তা দেখাচ্ছে। কিন্তু আমরা যারা চাই এই আন্দোলন সফল হোক, ফ্যাসিবাদী রাজের পরাজয় হোক, তারা এটাও জানি, যে যদি গণআন্দোলনের চাপে সরকার গদি না ছাড়ে, তবে সেই নির্বাচনই ভরসা। তাই, ভোট ভাগ হতে দেওয়া যাবে না। সেখানেই উঠছে বড়দের দলবাজির প্রশ্ন। এত দিন মনে হচ্ছিল যে রাজ্যের শাসক দলের অজস্র সমস্যা থাকা সত্ত্বেও অন্তত সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধিতাটা তারা করছে। মনে হচ্ছিল অন্য বিজেপি-বিরোধী দলগুলির পক্ষে শাসক দলের বিরোধিতা এমন একটা অবিমৃশ্যকারিতা হচ্ছে, যা সাম্প্রদায়িক শক্তিকেই শক্ত করছে (লোকসভা নির্বাচনে হয়তো যা ঘটেছে)। কিন্তু এই মুহূর্তে শাসক দলের অবস্থানে সেই আরও বড় সমস্যা তৈরি হচ্ছে।

আমরা বড়রা কি তবে আরও এক বার ছোটদের এই অকল্পনীয় আন্দোলনকে হারিয়ে দেব? জানি না। কেবল আসনের হিসেবে যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁদের অবশ্য সেটাই করার কথা। তবু, একটা মির‌্যাকল দেখেছি তো সবে, তাই আশা হারাচ্ছি না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement