প্রশ্ন: লাদাখে ভারতীয় সেনার উপর বর্বরোচিত আক্রমণের পর ভারত-চিন সম্পর্কের এই নাটকীয় অবনতি সম্পর্কে আপনার মত কী?
রণেন সেন: আমি চিন-বিশেষজ্ঞ নই, কার্টোগ্রাফারও নই! চিন সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা হল প্রধানমন্ত্রীদের বিদেশ এবং প্রতিরক্ষা নীতি সংক্রান্ত পরামর্শদাতা হিসাবে। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ১৯৮৮ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধীর মাইলফলক চিন সফর। সেটা ছিল চৌত্রিশ বছর পর প্রথম কোনও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর চিন সফর। এক দশকের উপর হয়ে গেল আমি সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। জমিনি হকিকত কী, সেটার কোনও প্রত্যক্ষ তথ্য আমার কাছে নেই। শুধু এটুকু বলতে পারি, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা (এলএসি) সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা আমাদের বরাবর ছিল। চিনেদেরও ছিল।
প্র: রাজীব গাঁধীর ওই ঐতিহাসিক সফরের কোনও প্রাসঙ্গিকতা এখনও রয়েছে কি? আজকের ভারত সেই সময়কার ভারতের থেকে অনেক আলাদা।
উ: ঠিকই। এখন আমরা বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি। আমাদের সামরিক বাহিনী অনেক শক্তিশালী। সীমান্তে পরিকাঠামোর প্রশ্নেও অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে ভারত। কিন্তু চিনের সঙ্গে তুলনা করতে বসলে ছবিটা একটু অন্য রকম দেখায়। রাজীব গাঁধী চিন গিয়েছিলেন পূর্বাঞ্চলেসামদোরোং ছউ-তে দীর্ঘমেয়াদি উত্তেজনা এবং সংঘাতের পর, অরুণাচল প্রদেশকে রাজ্য হিসাবে ঘোষণা করার পর। সে সময় আমরা অর্থনীতির আয়তন এবং প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয়ের ক্ষেত্রে চিনের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছিলাম। এখন চিনের অর্থনীতির আয়তন আমাদের পাঁচ গুণ, প্রতিরক্ষাক্ষেত্রে তাদের ব্যয় ভারতের চার গুণ। এই বৈষম্য যে সব সময় দু’দেশের সামরিক দক্ষতার ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়েছে, এমনটা যদিও নয়। দেং জিয়াওপিং রাজীব গাঁধীকে বলেছিলেন, একুশ শতককে এশিয়ার শতক করে তুলতে ভারত-চিন সহযোগিতা আবশ্যক একটি শর্ত। অনেক দিন হয়ে গেল এই কথা শুনে চলেছি।
প্র: প্রতীকী অর্থ ছাড়া ওই সফরের প্রাসঙ্গিকতা কি এখনও রয়েছে?
উ: সীমান্তে পাকাপাকি সমাধানের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। দু’দেশ একমত হয়েছিল, পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে সুষ্ঠু, যুক্তিপূর্ণ এবং দুই তরফের কাছেই গ্রহণযোগ্য সমাধানসূত্র খোঁজা হবে। যত দিন না চূড়ান্ত সূত্র পাওয়া যাবে তত দিন সীমান্তে শান্তি ও সুস্থিতি বজায় রাখতে ব্যবস্থা ও প্রকরণ তৈরি করা হবে। সব শেষে বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, এবং অন্যান্য দ্বিপাক্ষিক আদানপ্রদানকে বাড়ানো হবে। সেগুলি যাতে সীমান্তের জটে আটকে না থাকে সেটাও নিশ্চিত করা হবে। এই পরের দুটি ট্র্যাকে যথেষ্ট অগ্রগতি হলেও প্রথম ট্র্যাকটিতে বলার মতো কোনও কিছু হল না। সম্ভবত চূড়ান্ত সমঝোতার প্রথম ধাপ হিসাবে একে দেখা হয়েছে বলেই এলএসি-র সুনির্দিষ্ট চেহারা দেওয়া আজও হয়ে উঠল না। আর সে কারণেই সীমান্তে শান্তি এবং সুস্থিতির অন্যান্য প্রক্রিয়াগুলিতেও সমস্যা রয়েই গিয়েছে। আমরা এটাও জানতাম যে সিয়াচেন সেটলমেন্ট এবং জম্মু ও কাশ্মীর সংলগ্ন নিয়ন্ত্রণরেখা এন জে ৯৮৪২ পয়েন্ট ছাড়িয়ে বাড়ানো, পাকিস্তানের পক্ষ থেকে চিনের কাছে কারাকোরাম লাইন বরাবর ভূখণ্ডের দাবি ছেড়ে দেওয়া— এ সবই চিনের সঙ্গে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত।
প্র: অর্থনীতি থেকে করোনাভাইরাস, বিভিন্ন প্রশ্নে চিন যখন গোটা দুনিয়ায় কোণঠাসা, তখন লাদাখ সীমান্তে এতটা আগ্রাসী ভূমিকা নিচ্ছে কেন?
উ: সত্যিই এর কোনও উত্তর নেই আমার কাছে। অনেকে বলছেন এলএসি-র স্থিতাবস্থা নষ্ট করার জন্য চিনের সুপরিকল্পিত অভিযানের সঙ্গে আমাদের ঘরোয়া আইন প্রণয়ন এবং লাদাখ ও গিলগিট-বালটিস্তানের অংশ হিসাবে আকসাই চিনকে নীতিগত ঘোষণা করার সম্পর্ক রয়েছে। কেন তারা এ ভাবে এগোলো, আমি বলতে পারব না। তা নিয়ে অন্ধকারে ঢিল ছুড়তেও চাই না। তবে এটা ঠিক, সাম্প্রতিক কালে দেখা যাচ্ছে, গোড়ায় এশিয়া এবং পরে গোটা বিশ্বে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তারের প্রশ্নে চিন অনেক বেশি আগ্রাসী, দৃঢ়সঙ্কল্প। করোনাভাইরাস নিয়ে যা হয়েছে তা চিনের পক্ষে নেতিবাচক। তবে, সেই কারণে বেশির ভাগ দেশ নিজের নীতি পরিবর্তন করবে, এটা বলে দেওয়া যায় না— বিশেষত এখন, যে সময়টায় সব দেশই অতিমারি সামলাতে নাজেহাল, আন্তর্জাতিক সংযোগ নিয়ে বিচলিত। এটা ঠিক যে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এখন আমাদের হাতে আগের তুলনায় অনেকগুলি বাছাইয়ের সুযোগ রয়েছে। আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ঘটেছে, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে কোয়াড্রিল্যাটারাল সিকিয়োরিটি ডায়লগ বা কোয়াড তৈরি হয়েছে ইত্যাদি। কিন্তু যেহেতু আমেরিকা-চিন ও আমেরিকা-রাশিয়া সম্পর্ক এখন গভীর গাড্ডায়, এবং পাশাপাশি চিন-রাশিয়া কৌশলগত সম্পর্ক শক্তিশালী হচ্ছে, ফলে আমাদের খেলার সুযোগ অনেকটাই সীমাবদ্ধ। অন্য দেশগুলির কাছ থেকে সুনিশ্চিত প্রতিশ্রুতি এবং সুস্পষ্ট অবস্থান দাবি করব, অথচ নিজেদের অবস্থান, কৌশলগত অধিকার অক্ষুণ্ণ রাখার স্বার্থে ধোঁয়াশা রেখে দেব— এমনটা হলে চ্যালেঞ্জ বেড়েই যায়। আর একটা কথা বলা প্রয়োজন— বাইরের শক্তিগুলির মধ্যে ভারসাম্য রচনা করা জরুরি ঠিকই, তবে অন্যের সাহায্য ছাড়াও আমরা নিজেরা নিজেদের জন্য কী করতে পারছি, তার ওপর সমস্ত বাহ্যিক সহযোগিতার উৎকর্ষ ও মান নির্ভর করে।
প্র: জাতীয় নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও জনস্বাস্থ্য— এই ত্রিমুখী চ্যালেঞ্জের মোকাবিলার জন্য আমাদের সামনে কী করণীয় আছে বলে মনে করেন?
উ: সরকারে যাঁরা রয়েছেন তাঁরা পথনির্দেশিকা দিচ্ছেন। অবশ্যই সার্বিক জাতীয় কর্মসূচি তৈরি হবে যেখানে ঘরোয়া ও বিদেশনীতি, জাতীয় নিরাপত্তা, আর্থ-সামাজিক সমীকরণ, বাণিজ্য, অর্থনীতি, প্রযুক্তি, সংস্কৃতি সব একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত থাকবে।
সম্প্রতি যা ঘটেছে, তাতে চিনের সঙ্গে অবশ্যই আগের মতো সম্পর্ক রাখা সম্ভব হবে না। তবে অধৈর্য হয়ে চটজলদি প্রতিক্রিয়া দেওয়াটাও কোনও কাজের কথা নয়। আমাদের মিডিয়া কভারেজ, বিশেষ করে কিছু চ্যানেল এবং সোশ্যাল মিডিয়ার কর্কশ চিৎকার বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কহীন এবং যার ফলাফল উল্টোও হতে পারে। লক্ষণীয়, চিনের সরকারি মাধ্যম কিন্তু গোটা বিষয়টির একটা ঝাপসা ছবি প্রকাশ করছে, এমন কোনও মন্তব্য করছে না যাতে ভবিষ্যতে নিষ্পত্তির সম্ভাবনাগুলি কমে আসে। আমাদের জবুথবু হয়ে থাকার প্রয়োজন নেই, অথবা সমঝোতা করারও। কিন্তু সেই সঙ্গে আলোচনার দরজা বন্ধ করাও কাজের কথা নয়। এখন অগ্রাধিকার হল বর্তমান সঙ্কট কাটিয়ে ওঠা। ঘরোয়া এবং বিদেশনীতির মধ্যে ধারাবাহিক এবং মসৃণ সংযোগ গড়া প্রয়োজন। সেই সঙ্গে কড়া হাতে নিজেদের নীতিগুলির পুনর্বিবেচনারও প্রয়োজন রয়েছে। আমার ধারণা এ সবই এখন হচ্ছে।
প্র: দেশের ভিতরে রাজনীতির লড়াই দেখতে পাচ্ছি, তাতে কি পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে না?
উ: জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে দেশের ভিতর বড় মাপের রাজনৈতিক মতপার্থক্য নতুন কিছু তো নয়। উদাহরণ হিসাবে আমাদের শ্রীলঙ্কা নীতির কথা বলা যায় যা ১৯৮৯ সালে বিশাল নির্বাচনী বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফের ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তির সময়ে বিজেপি তাদের আদর্শগত বিরোধী বামেদের হাত ধরে, সরকার ফেলে দেওয়ার জন্য। বিজেপি-র বক্তব্য ছিল জাতীয় নিরাপত্তাকে বিক্রি করে দিচ্ছে সরকার। পরে অবশ্য তারা স্বীকার করে নেয় যে আমেরিকার সঙ্গে ভারতের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ভরকেন্দ্র এটিই। রাজীব গাঁধীর চিন যাত্রার আগেও এই নিয়ে কংগ্রেস দলের মধ্যেই ঐকমত্য ছিল না। অবশ্য অটলবিহারী বাজপেয়ী ঘরোয়া আলোচনায় একে সমর্থন করেছিলেন।
বর্তমানের কৃতিত্বকে তুলে ধরতে অতীতের নেতাদের ছোট করা অথবা অতীতের কাল্পনিক ত্রুটি নিয়ে কথা বলার প্রবণতা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বরং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে, সমস্ত রাজ্যের সঙ্গে আরও বেশি আলোচনা করা প্রয়োজনীয়।
কূটনীতিক, প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত
সাক্ষাৎকার: অগ্নি রায়