China

ড্রাগনের ছায়ায় প্রতিবেশী নীতি

চিনের দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি বিরাট অঞ্চলের নিকটতম সমুদ্রবন্দর হল চট্টগ্রাম, তাই কুনমিং থেকে চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত মহাসড়ক নির্মাণে চিনের বিশেষ আগ্রহ।

Advertisement

তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০২০ ০০:০১
Share:

গত জুনে চিন থেকে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দশ জনের একটি মেডিক্যাল দল পনেরো দিন ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করে। এ দিকে তার আগেই মে মাসে ভারতের পক্ষ থেকে মলদ্বীপের মতো বাংলাদেশেও একটি মেডিক্যাল দল পাঠাবার প্রস্তাব পাঠানো হলেও নানা কারণে তা বাস্তবায়িত হয়নি। এই পরিপ্রেক্ষিতে বুঝতে অসুবিধে নেই, জুলাই মাসে চিন যে বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ পণ্য নিজের দেশে শুল্কমুক্ত আমদানির পথ খুলে দিল, তা নিশ্চয়ই তাৎপর্যবাহী। বাণিজ্যিক সম্পর্কের মধ্যে কূটনৈতিক মাত্রা থাকে, প্রতিবেশী দেশের ক্ষেত্রে তো বটেই। সম্প্রতি পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রীর বৈঠকের সংবাদও এল। ভারতের দিক থেকে সেটাও কম গুরুত্বপূর্ণ খবর নয়।

Advertisement

প্রসঙ্গত, বিআরআই (বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ) প্রকল্পে বাংলাদেশে পরিকাঠামো গড়তে ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগের উদ্যোগ করেছে চিন, পাকিস্তানের পরেই যা সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ। চিনের দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি বিরাট অঞ্চলের নিকটতম সমুদ্রবন্দর হল চট্টগ্রাম, তাই কুনমিং থেকে চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত মহাসড়ক নির্মাণে চিনের বিশেষ আগ্রহ। করোনার কারণে ইউরোপের দেশগুলিতে রফতানি থমকে যাওয়ায় বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্প গভীর সঙ্কটে। এমন সময়ে চিনের বন্ধুত্ব ঢাকার কাছে জরুরি তো বটেই। শুল্কমুক্ত রফতানির বিনিময়মূল্য কালে কালে কী দাঁড়ায়, দেখা যাক।

এই প্রসঙ্গে মনে পড়তে পারে শ্রীলঙ্কার কথা। শ্রীলঙ্কার হাম্বানতোতায় একটি সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য চিন বন্ধুত্বমূলক শর্তে হাত উপুড় করে টাকা দিয়েছিল। অনিবার্য ফল— সেই টাকা পরিশোধ করা শ্রীলঙ্কার পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। সেই মৃতপ্রায় বন্দর ঘিরে পনেরো হাজার একর জমি আজ চিনের দখলে, ভারত থেকে ঢিলছোড়া দূরত্বে।

Advertisement

তাকানো যাক নেপালের দিকে। গত কয়েক মাসে নেপালের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে তৈরি হয়েছে নানা জটিলতা, ভারত-বিরোধিতার সুর চড়ছে সেখানে। নেপালের শাসক দলের মধ্যে তীব্র টানাপড়েন চলছে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর প্রকাশ্য ভারতবিরোধী অবস্থান নিয়ে। যুযুধান দুই পক্ষের মধ্যে দৌত্যের ভূমিকায় এসেছে চিনের দূতাবাস।

পরিস্থিতিটা কী দাঁড়াচ্ছে, বুঝতে হলে আফ্রিকার দিকে তাকানো যাক। মার্কিন ও ইউরোপীয় আধিপত্যে থাবা বসাতে গত দু’দশক ধরে আফ্রিকার অনেকগুলি দেশে বিপুল বিনিয়োগ করেছে চিন। সমুদ্রবন্দর, পরিকাঠামো, প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ, মুক্ত-বাণিজ্য অঞ্চল নির্মাণ। শুরুটা সব ক্ষেত্রেই বন্ধুত্বপূর্ণ শর্তে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ দিয়ে হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যা অনেক ক্ষেত্রেই পর্যবসিত হয়েছে সেই প্রকল্পগুলির মালিকানা দখলে, কারণ সেই টাকা ফেরত দেওয়ার ক্ষমতা দেশগুলির থাকেনি। ফলে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর আফ্রিকার অনেক দেশে চিনের আধিপত্য আজ সুপ্রতিষ্ঠিত।

গত কয়েক বছরে চিন ও আমেরিকার বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব বেড়েছে অনেকটাই। করোনার অভিঘাতেও ইউরোপ ও আমেরিকার চাপ বেড়েছে। তার থেকে নজর ঘোরাতে চিনের তাস এখন— ভারতীয় উপমহাদেশে প্রভাব বিস্তার, সীমা সম্প্রসারণ ও কূটনৈতিক লড়াই।

এই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়াতে গেলে ভারতের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব অপরিসীম। গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও মজবুত করতে ভারত উদ্যোগী, রেল-সড়ক-নদীপথে যোগাযোগ আজ অনেক বেশি, পণ্য পরিবহণ ও ভিসার সংখ্যাও বেড়েছে। তিস্তার জল নিয়ে এখনও সমাধানে আসা যায়নি বটে, কিন্তু আরও কয়েকটি নদীর জলবণ্টন নিয়ে চুক্তি হয়েছে। ছিটমহল হস্তান্তর চুক্তিতে প্রায় নজিরবিহীন ভাবে সাত হাজার একরের বিনিময়ে প্রায় সতেরো হাজার একর জমি বাংলাদেশকে প্রত্যর্পণ করেছে ভারত। চিন-বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের আবহে কয়েক দিন আগেই ভারতের ইন্ডিয়ান অয়েল বাংলাদেশের গ্রামীণ স্তর পর্যন্ত জ্বালানি গ্যাস সরবরাহ করার উদ্দেশ্যে ও দেশের একটি বড় বাণিজ্য সংস্থার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ করেছে। বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের জন্য ভারতের যে আর্থিক সহায়তার তহবিল, তাতে মোট ৩০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ৮ বিলিয়ন শুধু বাংলাদেশের জন্য বরাদ্দ। চিনের মতো মহাশক্তিধর আর্থিক শক্তির তুলনায় তা কম হলেও ভারতের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব তাতে যথেষ্ট স্পষ্ট।

অস্বস্তির জায়গাও আছে। ভারতের নাগরিকত্ব আইনের প্রস্তাবে বা ধর্মীয় মেরুকরণে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ যে ভাবে উঠে এসেছে, তা ওই দেশের পক্ষে অস্বস্তিকর তো বটেই। রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে ভারতের নীতিতেও দু’দেশের টানাপড়েন স্পষ্ট।

এই উপমহাদেশে বাড়তে থাকা চিনা প্রভাবের কারণে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক হয়তো আজ এক সন্ধিক্ষণে— যার ব্যঞ্জনা শুধু দ্বিপাক্ষিক নয়, বহুমাত্রিক। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের হাত ধরে যে সুসম্পর্কের শুরু, তার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের শতবর্ষে দু’দেশের সম্পর্কের চেহারা কেমন দাঁড়াবে— সেটাই ঠিক করে দেবে এই উপমহাদেশের ভবিষ্যৎ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement