India

কোমল গান্ধারের পথ পেরিয়ে

ঋত্বিক ঘটকের ‘কোমল গান্ধারে’ বিয়োগ চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল রেললাইন। সেই ইতিহাস এবার বদলে যাচ্ছে হলদিবাড়ি-চিলাহাটির পথে। নতুনভাবে জেগে উঠছে ষাটের দশকে ছিঁড়ে যাওয়া যোগসূত্র। আবার যুক্ত হচ্ছে দুই দেশ। ভারতীয় রেল হলদিবাড়ি থেকে চিলাহাটি সীমান্ত পর্যন্ত রেললাইন পেতে দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারও শুরু করেছে কাজ। অনেকটা যেন বাইবেলের সেই নোয়ার গল্প। না কি মৎস্য অবতারের? ধর্মে ভাগাভাগি ছিল না, নেইও।

Advertisement

অনির্বাণ রায়

শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২০ ০২:৩৪
Share:

প্রজাপতি এসে বসে তিলফুলে, উড়েও যায়। উড়তে উড়তে কলাগাছের সবুজ পাতায় বসে মুহূর্ত জিরোয়। আবার ওড়ে। কমবয়সি আমগাছের মুকুলের চারপাশে উড়তে থাকে, ঘুরতে থাকে, পাখা ঝাপটায় ঝড়ের মতো। সদ্যফোটা মুকুলের ঘ্রাণ বোধ হয় পাগল করে শুয়োপোকা-জীবন ছেড়ে আসা প্রজাপতিকে।

Advertisement

এ সব অতি সামান্য এবং স্বাভাবিক ঘটনা। সদ্য বৃষ্টি হয়েছে। ধান কাটার পরে ফাল্গুনের রোদ একদিকে ভেজা মাটিতে নিশ্চিন্তে শুয়ে রয়েছে। এক সময়ে যত্ন করে তোলা আল পায়ে পায়ে প্রতিদিন ভাঙছে। জমির অন্য দিকে চাষ হয়েছে তিলের। তিলফুলের রঙে সে দিক সাদা। কিছু দূরে কলাগাছ, আমগাছ। আর একটি অসমাপ্ত রেললাইন। কাঁটাতারের বেড়ার সামনে পর্যন্ত গিয়ে রেললাইন থমকে গিয়েছে। আসলে, রেললাইন থমকে যায়নি। অনেক অনেক দিন, বছর আগে রেললাইনের মাঝবরাবর বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল বেড়া। আজও পাড়াগাঁয়ে বালক-বালিকার দল মুখোমুখি বসে ঢিল ছুড়ে গাছ থেকে পাড়া আমলকী ভাগ করে নেয়। বহু বছর-দিন আগে অনেক বড়দের দল সে ভাবেই আমলকী ভাগ করে নিয়েছিল মাটির। সিমেন্টের খুঁটি পুঁতে বলেছিল— এই হল আমার দেশ, ওই ভাগ তোমার দেশ। একই মাটির বুকে শেকড় নামিয়ে বেঁচে থাকা তিলফুল, কলাগাছ, আমের বাগান ভাগ হয়ে যায় দু’দেশে। মনুষ্যকণ্ঠ বলতে থাকে— এই তিলফুল, এই ধানখেত এ-দেশের, ওই কলাগাছ, ওই আমগাছ ও-দেশের!

প্রজাপতির কাছে ভাগাভাগি নেই। ওর শুধু ফুলের মধুর খোঁজ। এ পারে চষা জমিতে ক্রিকেট খেলতে ব্যস্ত শিশু-কিশোরের দল দেখে, বাঁধাহীন ভাবে প্রজাপতি উড়ে যায়। বড়দের কাছে ওরা শুনেছে, ক’দিন পরে প্রজাপতির মতো মস্ত ধাতব ইঞ্জিনে টানা ট্রেনও এ-পার ও-পারে ছোটাছুটি করবে। অসমাপ্ত রেললাইন তরতর করে এগোতে থাকবে। সমীহ জাগিয়ে তোলা কাঁটাতারের বেড়া অন্তত কয়েক ইঞ্চির জন্য হলেও ফাঁক হবে। তার মাঝ দিয়ে গলে যাবে ট্রেন, পণ্য, কালে কালে হয়তো মানুষও।

Advertisement

অনেকটা যেন বাইবেলের সেই নোয়ার গল্প। না কি মৎস্য অবতারের? ধর্মে ভাগাভাগি ছিল না, নেইও। সব ধর্মের শরীরে একই গল্প নানা চরিত্রে জড়িয়ে রয়েছে। মাটিতেও ভাগাভাগি ছিল না, অন্তত যতদিন মানুষ তাঁর শরীরে সভ্যতার পোশাক গলায়নি। নোয়া বা মৎস্য অবতারের গল্পে পৃথিবীতে তখন প্রলয়ঙ্কর বন্যার কথা বলা রয়েছে। মানুষ, পশু সব ভেসে যাচ্ছে। সে সময় নোয়া নৌকায় বিশ্বসংসারের প্রাণের অস্তিত্বকে আশ্রয় দেন। মৎস্য অবতারও পৃথিবীতে ঘটতে চলা ভয়ঙ্কর বন্যা নিয়ে সর্তক করে সকলকে এক নৌকায় জড়ো হতে বলেছিলেন। সেই নৌকার জেরেই নাকি পৃথিবীর প্রাণ রক্ষা পায়। কবিমন বলতেই পারে, মৎস্য অবতারের সর্তকবাণী শুনেই নোয়া হয়তো নৌকো ভাসিয়েছিলেন। সে যাই হোক। তিলখেতের পাশে দাঁড়িয়ে মনে হল, সেই নোয়া কিংবা মৎস্য অবতারই নৌকার বদলে আধুনিক যুগে রেললাইন পাতছে। দু’দেশের মধ্যে যোগাযোগ ঘটিয়ে স্বপ্ন রক্ষা করবে বহু প্রাণের। সেই সব প্রাণ এখনও স্পন্দিত হয় ফেলে আসা অনেক বছর আগে দ্বিখণ্ডিত হওয়ার যন্ত্রণা নিয়ে।

এ-পারে দাঁড়িয়ে চোখে ভাসে শুধু কাঁটাতার এবং তারের ও-পারে বাংলাদেশ। এ-পার হলদিবাড়ি। ও-পার চিলাহাটি। এক সময়ে কলকাতা থেকে ট্রেন ছাড়ত পার্বতীপুর, নীলফামারি পার হয়ে চিলাহাটি হয়ে হলদিবাড়ি দিয়ে জলপাইগুড়ি টাউন স্টেশন ছুঁয়ে শিলিগুড়ি পৌঁছত। এই রেলপথেই বহুবার এসেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। দার্জিলিং যেতেন তিনি এ পথেই। প্রয়াণের আগে অসুস্থ শরীরে এই পথ দিয়েই গিয়েছেন তিনি। এখন এই পথ ছিঁড়ে দু’দেশে থমকে রয়েছে।

দেশভাগ হওয়ার পরেও এই পথে ট্রেন চলত। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পরে এই পথ বন্ধ হয়ে যায়। সে সময় বাংলাদেশ জন্ম নেয়নি। পরে দু’পারে একই কবির লেখা গান জাতীয় সঙ্গীত হয়েছে। কিন্তু এ-পারের ট্রেন-ইঞ্জিন বাঁশি বাজিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আর ও-পারে যায়নি। হলদিবাড়ি ও চিলাহাটি পর্যন্ত এসে দু’দিকের ট্রেন থেমে গিয়েছে। কয়লা-টানা ইঞ্জিন থেকে বার হওয়া কালো ধোঁয়া এ-আকাশ থেকে ও-আকাশে গিয়েছে। শুধু চাকা গড়ায়নি।

উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তন প্রধান আনন্দগোপাল ঘোষের উপলব্ধি, “মূলত সেনা নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্রিটিশরা রেললাইন বসিয়েছিল। সঙ্গে পণ্য পরিবহণও উদ্দেশ্য ছিল। অর্থাৎ, বাণিজ্য। সেই ধারণা পরবর্তী কালে স্বাধীন ভারতের সরকারও যত্ন করে লালন করেছে। মানে, রেললাইনের প্রথম এবং প্রধান উদ্দেশ্য খুঁজতে হলে শাসকের শাসন করার তাগিদকে বুঝতে হবে।” সংক্ষিপ্ত বাক্যে, থেমে থেমে কথা বলেন আনন্দবাবু। তাঁর মুখনিসৃত বাক্যের মধ্যেকার ফুরসতে বই, প্রবন্ধ, নিবন্ধের পাতায় ছাপার অক্ষরে শুয়ে থাকা ইতিহাস গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। যেন জেগে ওঠা ঘুমন্ত দৈত্য। হাত সোজা করে, পা টানটান করে, ঘাড় ঘোরায় চারদিকে। তারপর শ্রোতাকে কাঁধে বসিয়ে দৌঁড়তে থাকে অতীতের দিকে। সপ্তাহ, মাস, বছর ডিঙিয়ে দৌড়তে থাকে ফেলে আসা দিনের পথে। গতিতে শতাব্দী পার হয়ে যায়, পিছিয়ে যায়। একবিংশ থেকে বিংশ, উনবিংশ। দৃশ্যপট রঙিন থেকে সাদাকালো হয়ে গিয়েছে কখন। আমরা এসে পড়েছি ১৮৪৪ সালে। সে বছর ব্রিটিশ ভারতের গর্ভনর জেনারেল দেশে রেলপথ তৈরির অনুমতি দিলেন। তারও বছর দশক পরে ভারতে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। আমাদের আলোচনার রেলপথ তৈরি হয়েছিল ১৮৭৪ সালে। সে এক নদীর নাম শুনে এখনও এপার বাংলার বহু মানুষের মুখে আলো খেলে যায় আবার দীর্ঘশ্বাসও ঝরে। পদ্মা। পদ্মা নদী। সেই নদীর পাড় থেকে বসানো শুরু হয় রেল লাইন। তখন পদ্মায় সেতু নেই। ও পারে দমুখদহ ঘাট পর্যন্ত রেললাইন রয়েছে। পদ্মা নদীর এ পারে অর্থাৎ বাঁ দিকে রেললাইন বসানো হয়। ছোট লাইন, মিটার গেজ। এ পারের নাম সারাঘাট। সারাঘাট থেকে চিলাহাটি পর্যন্ত রেললাইন বসে। আরও কিছুদিন বাদে চিলাহাটি থেকে হলদিবাড়ি জলপাইগুড়ি হয়ে শিলিগুড়ি পর্যন্ত রেললাইন বসানো হয়। ততদিনে আরও পাঁচ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। জন্মের অপেক্ষা করছে বঙ্গজীবনের আরও এক চলমান মহাকাব্য। দার্জিলিং মেল। কলকাতা থেকে ট্রেন ব্রডগেজে এসে পৌঁছত দমুখদহ ঘাটে। নামতে হত যাত্রীদের। পদ্মার ঘাটে অপেক্ষা করত নৌকো। নদী পার হয়ে নৌকা এসে ভিড়ত সারাঘাটে। সেখান থেকে মিটার গেজ ট্রেনে চেপে আমাদের আলোচ্য রেলপথ পার্বতীপুর, জলপাইগুড়ি হয়ে শিলিগুড়ি পৌঁছত দার্জিলিং মেল।

ঠিক এই জায়গায় আরও একটি গল্প ঘাড় ঘষছে। অতিবড় স্বল্পবাক বাঙালিও যে গল্প বলার সুযোগ ছাড়তে চাইবেন না। পদ্মার এক পাড়ে দার্জিলিং মেল এসে থমকে আছে। অন্যপাড়ে যে ট্রেন অপেক্ষা করছে সেও দার্জিলিং মেল-ই। যাত্রীরা এ ট্রেন থেকে নামবেন, ওই ট্রেনে উঠবেন। মধ্যে পদ্মা নদী। দু পাশে দরমা বেড়ার হোটেল। সেখান থেকে ভেসে আসছে ইলিশ মাছ ভাজার গন্ধ। হোটেলের কর্মীরা হাক পাড়ছেন, গরম ভাতে পদ্মার ইলিশ খেয়ে যান। গভীর রাতে নিশির ডাক, নির্জন দুপুরে প্রেমিকার ডাক এবং পরপারে ফেরার ডাকের মতো গরম ভাতে ইলিশ মাছের ডাকও অনিবার্য, ধ্রুব। সাড়া দিতেই হবে। সাদা ভাতের সঙ্গে কালোজিরে ভাসতে থাকা ইলিশ মাছের ঝোল সঙ্গে ফিনফিনে করে কাটা দু-একটুকরো আলু। মরসুম ভেদে ইলিশের ঝোলে ডুবে থাকে মিষ্টি কুমড়োর সরু খণ্ড, কাঁঠালের বীজ ভাজা। হাতে হাতে, মনে ইলিশ ঝোলের ঘ্রাণ মেখে যাত্রীরা ফের চড়ে বসতেন ট্রেন। এই পথ দিয়ে পদ্মার কাঁচা ইলিশও পৌঁছত উত্তরবঙ্গে। বাণিজ্যের জন্যই গুরুত্ব ছিল এই লাইনের।

ইতিহাস গবেষক আনন্দগোপাল ঘোষ একটি ছড়াও শোনালেন। ‘ধান, পাট গুড়, এই তিনে রংপুর।’ মালগাড়িতে রংপুরের সঙ্গে বাণিজ্য চলত সম্বৎসর। দার্জিলিং মেল ছিল এই লাইনের প্রধান ট্রেন। তা ছাড়াও বহু প্যাসেঞ্জার ট্রেন চলাচল করত। ১৯১২ সালে পদ্মার ওপরে সেতু তৈরি হয়। নাম হয় হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। ব্রিটিশ ভারতে রেললাইনের অন্যতম প্রাণ পুরুষ ছিলেন হার্ডিঞ্জ সাহেব। তার নামেই সেতুর নামকরণ হয়ত। সারাঘাট থেকে জলপাইগুড়ি পর্যন্ত ছোট লাইন তুলে বড় লাইন বসানো হয়। কলকাতা-জলপাইগুড়ি যোগাযোগে এই রেলপথই ছিল ভরসা। রবীন্দ্রনাথ থেকে নেতাজি, গাঁধীজি সকলেই এই রেলপথে জলপাইগুড়িতে এসেছেন, দার্জিলিঙে গিয়েছেন। এরপরেই স্বাধীনতা পেল ভারত। ভাগ হল ভূখণ্ড। তখনও এই পথে ট্রেন যোগাযোগ ছিল। অবিশ্বাস ঘন হল ষাটের দশকে পাকিস্তান যুদ্ধের সময়। অবিশ্বাসের রং গভীর কালো, ট্রেন ইঞ্জিনের ধোঁয়ার থেকেও সেই কালো ঘন এবং জমাট। থেমে গেল ট্রেন। লাইনের ওপর দিয়ে বসল কাঁটাতারের বেড়া। পৃথক হয়ে গেল হলদিবাড়ি-চিলাহাটি। এ আমার দেশ- ওই দেশ তোমার।

থমকে থাকা ইতিহাস ফের চলতে শুরু করেছে। দীর্ঘদিন ট্রেন না চলায় লাইন কোথাও উঠে গিয়েছিল, কোথাও মাটিতে বসে যায়। ভারতীয় রেল হলদিবাড়ি থেকে চিলাহাটি সীমান্ত পর্যন্ত নতুন রেললাইন পেতে দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারও চিলাহাটি স্টেশন থেকে সীমান্ত পর্যন্ত নতুন রেল লাইন বসানোর কাজ শুরু করেছে। মাঝেমধ্যেই বাংলাদেশের রেলমন্ত্রী নিজে এসে কাজ দেখছেন। দু’দেশের সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রথমে মালগাড়ি চলবে। তারপর যাত্রিবাহী ট্রেন চললেও চলতে পারে। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে কলকাতাগামী ট্রেনও এই পথে ফের চলতে পারে। তবে ইতিহাসবিদ আনন্দগোপালবাবুর মনে আশঙ্কাও রয়েছে। এক সময়ে বাণিজ্যের জন্য এই লাইনের কদর ছিল। এখন কি বাণিজ্য হবে? এ দিকের তেমন কোনও পণ্য তো বাংলাদেশে যায় না। তা হলে কী লাভ হবে, প্রশ্ন আনন্দগোপালবাবুর। উল্টে চোরাচালান বাড়বে না তো? তবে কলকাতার ট্রেন চললে যাত্রীদের সময় বাঁচবে, কিন্তু উত্তরবঙ্গের বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষা হবে কি?

এ সব প্রশ্নের উত্তর আপাতত কালের গর্ভে। এক ঐতিহাসিক রোমাঞ্চের অপেক্ষায় হলদিবাড়ি-চিলাহাটি পথ। ছিন্ন হওয়া রেলপথ সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ার সামনে এসে এতদিন নীরব হয়ে যেত। সেই নীরবতা হয়ত শব্দ পাবে। রেলের লাইনে জুড়বে ভাগ হওয়া মাটি। দুরন্ত বেগে ট্রেন যাওয়ার পরে একই ছন্দে দুলে উঠবে হবে এ পারের তিল ফুল, ও পারের আমের মুকুল। এই পাল্টানো সময়ে, সেটুকুও কম প্রাপ্তি নয়!

অঙ্কন: রৌদ্র মিত্র

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement