ছবি সংগৃহীত।
লক্ষ্য, ২০৬০ সাল। তাহার মধ্যেই চিন ‘কার্বন নিউট্রাল’ অর্থব্যবস্থা হইয়া উঠিবে বলিয়া জানাইয়াছেন প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং। তাঁহার দাবি, ২০৩০ সালের মধ্যে চিনে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাইবে। অতঃপর সেই রেখচিত্র আর উঠিবে না, বরং নামিয়া ২০৬০ সালের মধ্যে কার্বন-নিরপেক্ষ হইবে। অর্থাৎ, চিনের অর্থনৈতিক কাজকর্মের ফলে পৃথিবীতে কার্বনের বোঝা আর বাড়িবে না— যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ ঘটিবে, তাহা শোষণ করিবার ব্যবস্থাও চিনই করিয়া দিবে। চিনের প্রতিশ্রুতিকে কতখানি গুরুত্ব দেওয়া বিধেয়, সেই সংশয় অনিবার্য; কিন্তু একই সঙ্গে স্মরণ করা প্রয়োজন, ২০৩০ সালে সর্বোচ্চ কার্বন নিঃসরণের স্তরে পৌঁছাইবার প্রতিশ্রুতিটি হইতে চিন এখনও সরে নাই। অর্থাৎ, কার্বন নিঃসরণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করিতে চিন কিছু ব্যবস্থা করিতেছে। তাহার কিয়দংশ দৃশ্যমান। বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির উপর কঠোরতর পরিবেশ-বিধি আরোপ করা হইতেছে। বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার বাড়িতেছে, কয়লা-নির্ভরতা কমিতেছে।
এক্ষণে দুইটি প্রশ্ন। এক, চিনের এই আকস্মিক পরিবেশ-সচেতনতার কোনও গূঢ় অর্থ আছে কি? উন্নত বনাম উন্নয়নশীল বিশ্বের পরিবেশ-দায়িত্বের মধ্যে কিয়োটো প্রোটোকল যে ফারাক করিয়াছিল, চিন ছিল তাহার অতি সরব সমর্থক। উন্নয়নের অধিকারের দাবিই ছিল তাহাদের দূষণের বৈধতা অর্জনের হাতিয়ার। এখন চিন অর্থনৈতিক মহাশক্তি হইয়া উঠিয়াছে— কার্যত বিশ্বের প্রথম আসনটির দাবিদার। অন্য দিকে, পরিবেশ-আলোচনার সুরটিও কিয়োটো প্রোটোকলের ধ্রুবপদ ছাড়িয়া অন্য খাতে বহিতেছে— এখন আর ঐতিহাসিক দায়িত্ব এই আলোচনার নির্ণায়ক যুক্তি নহে। এই মুহূর্তে অর্থনৈতিক বিশ্ব-নেতা হইয়া উঠিতে চাহিলে পরিবেশ-সচেতন ও দায়িত্ববান ভাবমূর্তির বিকল্প নাই। ঠিক এখনই চিনের এই ‘দায়িত্বশীল’ অবস্থানের কূটনৈতিক তাৎপর্য সম্ভবত বিপুল। ভারত বা ব্রাজিলের ন্যায় দেশের উপর নৈতিক চাপ তৈরি করা, বা তাহাদের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হারে লাগাম পরাইতে বাধ্য করিবার তাগিদটিও যে নাই, সেই বিষয়ে নিঃসংশয় হওয়া মুশকিল।
দ্বিতীয় প্রশ্ন, কার্বন-নিরপেক্ষ হইবার জন্য চিন কি সত্যই কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমাইবে, বা তাহা শোষণের ব্যবস্থা করিবে— না কি, দূষণটিকে শুধু দেশের সীমান্তের বাহিরে ঠেলিয়া দিবে? গত ত্রিশ বৎসর ধরিয়া জীবাশ্ম জ্বালানি চিনের অর্থনৈতিক উন্নতির মূল কারণ। এবং, ইহার কারণেই বিশ্বের মোট গ্রিনহাউস গ্যাসের এক-তৃতীয়াংশই চিন উৎপন্ন করিয়া থাকে। নিজ দেশের পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখিবার তাগিদে চিন অন্য দেশের পরিবেশকে দূষিত করিবার অঘোষিত পন্থা অবলম্বন করিতেছে কি না, ইতিমধ্যেই সেই প্রশ্ন উঠিয়াছে। বিশ্বে নূতন গড়িয়া উঠা বিদ্যুৎশক্তি কেন্দ্রগুলি, যাহারা মূলত কয়লাকে কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করিয়া থাকে, তাহার প্রায় ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রেই অর্থের জোগান আসিতেছে চিন হইতে। আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চিন কার্যত বাণিজ্যিক উপনিবেশ স্থাপন করিতেছে এবং দূষণ-নিবিড় শিল্পগুলি ক্রমে সেই উপনিবেশে সরাইয়া লইয়া যাইতেছে। অর্থাৎ, চিন নিজে দূষণমুক্ত হইলেও গোটা দুনিয়ার দূষণের পরিমাণ কমিবে না, হয়তো বাড়িবে— এই আশঙ্কা থাকিতেছে।