রাজনৈতিক মারামারি ও হানাহানিতে পশ্চিমবঙ্গ যে পয়লা নম্বর রাজ্য তা কোনও নতুন ঘটনা নয়। গণতন্ত্রের তিনটি উপাদান: সাম্য, স্বাধীনতা ও সৌভ্রাত্র। অম্বেডকর বলেছিলেন, এরা হল ত্রিমূর্তি, এক-কে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে ‘সৌভ্রাত্র’ সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, সাম্য বা স্বাধীনতা রক্ষা করতে সৌভ্রাত্র চাই-ই, কারণ সেটি না থাকলে অপর দু’টিকে বাঁচাতে ‘কনস্টেবল-এর প্রয়োজন হতে পারে’। এই রাজ্যে সৌভ্রাত্রের অভাব এতই প্রকট যে এখানে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের আদেশাধীন হাজার হাজার পুলিশের উপস্থিতি ছাড়া অবাধ নির্বাচন সম্ভব নয়। নইলে, আশঙ্কা প্রবল, শাসক দল তার ‘লেঠেল বাহিনী’ প্রয়োগ করে নিজের জয় সুনিশ্চিত করবে।
কোনও বিপজ্জনক স্থানে— যেমন পাহাড়ের খাদের ধারে মারামারি করার বিপদ হল, এতে দু’পক্ষেরই পারস্পরিক হনন সম্ভব। পশ্চিমবঙ্গের যুযুধান রাজনৈতিক নেতারা এ বার লড়াইটি নিয়ে গিয়েছেন একদম খাদের ধারে। তাঁরা এমন একটি সংগঠনের কাছে রাজ্যের শাসনভার হারানোর আশঙ্কায় ভুগছেন যে শুরু থেকেই চেয়েছে ভারত হোক একটি একধর্মীয় রাষ্ট্র, যেমন পাকিস্তান। শুধু সেই ধর্মটি পৃথক। এত দিন বাংলার রাজনৈতিক মল্লবীরেরা নিজেদের মধ্যে যতই লড়ুন, ওই সম্প্রদায়গত বিভেদকামী দল ভারতীয় জনতা পার্টির জন্য রাজ্যে কোনও জায়গা ছাড়েননি। কিন্তু এ বার খাদের ধারে পৌঁছে সকলেরই পা হড়কাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি বর্তমান শাসক দল তৃণমূলের, কারণ তারাই তো মল্লভূমির প্রায় সবটাই অধিকার করে রেখেছিল।
বিরোধীদের জন্য জমি ছাড়ব না এক ইঞ্চিও, এই ‘মেজরিটেরিয়ানিজ়ম’ বা ‘সংখ্যাগুরুবাদ’-এর জনক নিশ্চয়ই সিপিএম। তার আমল থেকেই শুরু হয় রাজনৈতিক বিরোধীদের বছরের পর বছর ‘ঘরছাড়া’ করার রীতি। কিন্তু সেটি যদি প্রাইমারি বিদ্যে হয়, তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাকে নিয়ে গিয়েছেন উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার (অভিযোগটি ১০০ শতাংশ সত্য)— এই কথাটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রত্যহ উচ্চারণ করেন। কিন্তু রাজ্য স্তরের যে সব পদের সাংবিধানিক তকমা আছে, যেমন কলকাতার পুলিশ কমিশনার, তাঁদের স্বাতন্ত্র্য কতটুকু, তা এখন শীর্ষ আদালতের অনুমতিক্রমে কেন্দ্রীয় দুর্নীতিদমন সংস্থা তদন্ত করে দেখছে। আর একটি রাজ্য স্তরের সাংবিধানিক সংস্থা রাজ্য নির্বাচন কমিশন তার ঝুঁকে পড়ার প্রবণতাটির প্রমাণ রেখে গিয়েছে গত বছরের পঞ্চায়েত নির্বাচনে। মোট ৪৮,৬৫০ গ্রাম পঞ্চায়েত আসনের ১৬,৮১৪টি তৃণমূল জেতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। পোষা লেঠেল ও বশংবদ পুলিশ মিলে নিশ্চিত করে বিরোধীরা যাতে মনোনয়ন পত্রটি পর্যন্ত ছুঁতে না পারে। সৌভ্রাত্রের এক জ্বলন্ত নিদর্শন!
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বিজেপির বর্তমান দাপট, এবং তার ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা, রাজ্যের রাজনীতিতে এক সম্পূর্ণ নতুন অধ্যায় সংযোজন করতে চলেছে। রাজ্যের এক-চতুর্থাংশ অধিবাসী মুসলমান হলেও, এবং তাদের আর্থ–সামাজিক মান তলানিতে ঠেকে থাকলেও, এত দিন সব দলই তাদের অন্তত ভোট ব্যাঙ্ক হিসেবে সম্মানটুকু দিয়েছে। বিজেপিই একমাত্র ভারতীয় রাজনৈতিক দল যাদের দৃষ্টিতে মুসলমানেরা ভোট ব্যাঙ্ক নয়, এবং তা যে নয় সেটি তার শ্লাঘার বিষয়, অনুশোচনার নয়। কারণ সেটিই তার বিভাজনের রাজনীতির মূল হাতিয়ার। এ বারের লোকসভা নির্বাচনে রাজ্য থেকে জয়ী বিজেপির ১৮ জন সাংসদের মধ্যে এক জনও নেই মুসলমান (৩০৩ জনের দেশব্যাপী বিজেপি বিজয়ীদের অবস্থাও তথৈবচ)। কিন্তু পরিবর্তে রাজ্যের ৫৮ শতাংশ হিন্দু ভোট যূথবদ্ধ হয়েছে ‘পদ্মফুল’-এর বোতামে। মুসলমান ভোট অবশ্য প্রথম চার পর্যায়ের নির্বাচনে তেমন সঙ্ঘবদ্ধ ছিল না। কিন্তু শেষ তিন পর্যায়ে উপায়ান্তর না দেখে তারা তৃণমূলের পাশে দাঁড়ায়। এই কারণেই কলকাতার আশপাশে কোথাও বিজেপি তেমন অনুপ্রবেশ করতে পারেনি (শুধু ব্যারাকপুর ছাড়া, যেখানে তৃণমূলের পরাজয়ের মূল কারণ গৃহবিবাদ)।
আগেই বলেছি, বাংলার মুসলমান সমাজকে (বিজেপি ব্যতীত) সব দল ভোট ব্যাঙ্ক হিসেবেই দেখতে অভ্যস্ত। কিন্তু ২০০৬ সালের নভেম্বর মাসে সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশের পর যখন ধরা পড়ে যে তথাকথিত ‘প্রগতিশীল’ পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের অবস্থা দেশের অন্যত্র যা, তার চাইতেও করুণ, তখন রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকার নড়েচড়ে বসে, ধর্মীয় শ্রেণিবিভাগ সম্পর্কে তাদের আদর্শগত অনীহা সত্ত্বেও। ২০০৬-১২ সালের মধ্যে মুসলমানদের অবস্থার সামান্য যেটুকু উন্নতি হয়েছে, তার একটি বড় কারণ সম্প্রদায়টিকে ওবিসি (অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি)-তে অন্তর্ভুক্ত করা। তার আইনটি মুসাবিদার পর পাশ করানোর আগেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকার নির্বাচনে পরাজিত হয়ে বিদায় গ্রহণ করে। তৃণমূল ক্ষমতাসীন হওয়ার পর মুসলমান সম্প্রদায়ের উপর সামান্য কিছু হলেও সরকারি চাকরি ও পেশাগত বিদ্যায়তনে ভর্তিতে ওবিসি সংরক্ষণের প্রভাব লক্ষিত হয়। এ ছাড়া বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আমলেই ছাড়পত্র পাওয়া সংখ্যালঘু শ্রেণির জন্য পুনর্গঠিত আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় তৃণমূল সরকারের আর্থিক দাক্ষিণ্যে বাংলার মুসলমান শ্রেণির মধ্যে এক মধ্যবিত্ত সমাজের আবির্ভাবের সূচক হয়ে ওঠে।
এ সবই বাঙালি হিন্দুর চোখে ক্রমশ মুসলমান সমাজকে দৃষ্টিগোচর করে তোলে। প্রাক্-পার্টিশান বাংলায় হিন্দু মানে জমিদার ও মহাজন এবং মুসলমান অর্থে ‘প্রজা’ (যদিও ইতিহাসবিদরা লিখেছেন এর বিপরীতও অনেক ক্ষেত্রে সত্য)। যেই এল ১৯৩০-এর দশকের কমিউনাল অ্যাওয়ার্ড ও সংরক্ষিত নির্বাচকমণ্ডলী, এবং পরবর্তী কালে বাংলায় মুসলমান রাজনৈতিক নেতৃত্ব, তৎক্ষণাৎ নেমে এল মানসিক বিভাগ— দেশবিভাগ তো পরের কথা। বিভক্ত পশ্চিমবঙ্গেও মুসলমান রয়ে গেল অদৃশ্য মানুষ হয়েই। তারা থাকে নিজেদের মতো, নিজেদের ডেরায়, কার কী বলার আছে! কিন্তু সাচার কমিটি-উত্তর কিছু কিছু সরকারি পদক্ষেপের ফলে বাঙালি হিন্দুর দৃষ্টিপটে মুসলমান পুনর্বার অবয়ব গ্রহণ করতে শুরু করল।
ঠিক সেই সময়েই বিজেপি দ্রুত পুনর্মূল্যায়ন করল বাংলায় তাদের নির্বাচনী সম্ভাবনার। হয়তো না বুঝেই সেই আকাঙ্ক্ষার আগুনে ঘি ঢেলেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং। ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের সরকারি তহবিল থেকে ভাতা প্রদান। মস্তকে হিজাব টেনে মসজিদ-মাজারে হাজিরা দেওয়া। কিছু ধর্মীয় নেতাকে তৃণমূলের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক স্থান দেওয়া। পুলিশকে অলিখিত নির্দেশ, ‘উপর’-এর আদেশ ছাড়া একটি সম্প্রদায়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে যখন তখন যেন অভিযোগ গ্রহণ না করা হয়।
এ সব হয়ে দাঁড়াল বিজেপির ‘হোয়াটসঅ্যাপ’ কারখানায় প্রস্তুত বারুদ। আর অগ্নিশলাকা তো মজুত হয়েই রয়েছে বাঙালি হিন্দু মানসিকতায়। সেখানে উৎকণ্ঠার সঙ্গে লক্ষিত হচ্ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের গতিবিধি। কিন্তু বিজেপির প্রকাশ্য ও পরোক্ষ প্রচারের ফলে মুহূর্তের মধ্যে মমতাই সাব্যস্ত হলেন ‘অপরাধী’। এ বার নির্বাচনে তৃণমূল ৪৩ শতাংশ ভোট পেলেও বিজেপি পেল ৪০ শতাংশ। আরও যা লক্ষণীয়, মাত্র ৩০ শতাংশ হিন্দু ভোট পেয়েছে তৃণমূল। দুই প্রাক্তন শাসক দল কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট পেয়েছে মোট ভোটের মাত্র ১২ শতাংশ। তা হলে বুঝতে বাকি রইল না, কী অভিজ্ঞ শল্যবিদের মতো বিজেপি দু’টি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজন ঘটিয়েছে। আরও অদ্ভুত কাণ্ড, বাঙালি হিন্দু মানে তো শুধু চাটুজ্যে-মুখুজ্যে বা ঘোষ-বোস নয়, আছে অসংখ্য জনজাতি, তফসিলি শ্রেণিভুক্ত ও দলিত মানুষ। তাদের এক বিপুল শ্রেণিকে মুসলমান-বিরোধী ও মমতা-বিরোধী হাওয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে মোদী সাইক্লোন।
মুসলমান ভোট ব্যাঙ্ক আসলে সংখ্যালঘু শ্রেণির নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতির বিনিময়-মূল্য। তা অবশ্য কোনও ফিক্সড ডিপোজ়িট নয় যে মূল্য ফেরত পাওয়া যাবে বিনা শর্তে। প্রথমে কংগ্রেস, পরে সিপিএম। তারও পরে তৃণমূল, এরা সকলেই সংখ্যালঘু সমর্থন ছাড়াও নির্বাচনের পর নির্বাচন জিতেছে যথেষ্ট হিন্দু সমর্থন পেয়ে। সংখ্যালঘুর কী লাভ, সেই দলকে সমর্থন করে; যে সংখ্যাগুরু দ্বারা পরিত্যক্ত?
দু’টি প্রশ্ন। বাংলার মুসলমান কি বিজেপির কাছে নিরাপত্তা ও উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি পাবে? উত্তর: অবশ্যই না। বিজেপির ভারত-ভাবনা অনুযায়ী, মুসলমানকে মনে রাখতে হবে তার ভারতীয়ত্ব সদা প্রমাণসাপেক্ষ। ঠিক যেমন সদা নজরদারিতে ইজ়রায়েলে বাস করেন আরব বংশোদ্ভূতেরা। দ্বিতীয় প্রশ্ন: বাংলায় কি মুসলমান ও হিন্দু নির্বিশেষে দেশের সব সম্প্রদায় একত্র হবে সৌভ্রাত্রের জাদুতে? যেমনটির চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন কিরণশঙ্কর রায় ও শরৎ বসু দেশভাগের অব্যবহিত পূর্বে?
ভারত না বাংলার? কোথাকার মানুষ দেবে তার উত্তর, কত দিন পরে?