ইদানীং ‘ভারত-ভারত’ ডাক নানাক্ষেত্রে প্রবল হয়ে উঠছে। ভারতীয় সংস্কৃতির ঐক্যের নামে নেশনবাজরা সরব হয়ে উঠছেন। ভিন্নস্বর, রুচি ও অভ্যেসের ওপর নানা কায়দায় ফতোয়া জারি করা হচ্ছে। এই দমবন্ধ পর্বে অনেকেই রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করছেন। আজ থেকে একশো বছর আগে প্রকাশিত তাঁর ইংরাজি বক্তৃতা নিবন্ধ ‘ন্যাশনালিজম’কে সামনে রেখে নেশনের গলাবাজিকে প্রতিহত করতে চাইছেন তাঁরা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ন্যাশনালিজমের বক্তৃতামালায় নেশন বলতে বুঝিয়েছিলেন নির্দিষ্ট ভূখণ্ডনির্ভর একটি সংগঠনকে। এই সংগঠন নিজেদের ‘রাজনৈতিক’ ও ‘অর্থনৈতিক’ স্বার্থসিদ্ধির জন্য যা খুশি তা-ই করতে পারে— নিজের দেশের ভিন্নমতের মানুষদের চুপ করিয়ে দিতে পারে, অন্য দেশ অধিকার করার জন্য লাফিয়ে পড়তে পারে। এ জন্য নেশনবাজেরা নানা কৃত্রিম উপায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ‘মতের ঐক্য’ গড়ে তোলেন। মতের ঐক্য গড়ে তোলার নানা কায়দাকানুন। যেমন রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্তধারা’ নাটকে ‘বিদেশি প্রজাদের চাপে’ রাখার ‘রাজনীতি’ সম্বন্ধে উত্তরকূটের সবাইকে সহমত করে তোলার জন্য পড়ানো-শেখানো হয়েছিল ‘ওদের (শিবতরাইয়ের লোকদের) ধর্ম খুব খারাপ’। ১৯২২-এর নাটকে লেখা কায়দাটা ২০১৭-তেও কেমন চেনা চেনা লাগে। রবীন্দ্রনাথ এই লোভী বিভেদকামী অমানবিক নেশনের বিরোধী ছিলেন।
অন্য রকম এক সংগঠনের কথা ভেবেছিলেন তিনি, তার নাম ‘সমাজ’। নেশনে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য ভিন্নস্বরকে চেপে দেওয়া হয়। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন সমাজে এমনটি হবে না, ব্যক্তিমানুষ নিজের মত সেখানে প্রকাশ করতে পারবেন। নানা ভিন্নমতের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মানুষের ভাল-র কথা ভেবে সমাজে মানুষ সহমত হবেন। এই সামাজিকতার মধ্য দিয়ে ব্যক্তিমানুষ তাঁর স্বদেশকে অর্জন করবেন।
মানুষের ভাল বলতে রবীন্দ্রনাথ কী বুঝতেন? সোজাসাপটা ভাষায় লিখলে, তিনি মনে করতেন, অপরিসীম ভোগের জন্য মানুষ ইচ্ছে মতো আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাহায্যে প্রকৃতিকে ধ্বংস করতে চাইলে তা ঘোরতর অন্যায়। প্রয়োজনে মানুষ অবশ্যই বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সহায়তা গ্রহণ করবে, রবীন্দ্রনাথ সেটা মনে করতেন। তিনি বিজ্ঞানবিমুখ ছিলেন না। নিজের ছেলেকে কৃষিবিজ্ঞান পড়তে পাঠিয়েছিলেন কবি— তাঁর বিশ্বাস ছিল, কৃষিপ্রধান ভারতে কৃষিবিজ্ঞানের প্রয়োজন। মানুষের অপরিসীম ভোগের চাহিদাকে দমন করার জন্য ধনীর সম্পদ হরণ করে সবাইকে সমান করে দেওয়া হবে এ কথা রবীন্দ্রনাথ বলেননি। ব্যক্তিগত সম্পদের অধিকার তিনি স্বীকার করেছিলেন। একই সঙ্গে খেয়াল করিয়ে দিয়েছিলেন, সম্পদশালী মানুষের সামাজিক দায়িত্ব অনেক বেশি। অপরের সঙ্গে অর্থনৈতিক দূরত্ব কমানোর জন্য সম্পদশালী মানুষ তাঁর অর্থ সামাজিক উন্নয়নের কাজে ব্যয় করবেন।
এবং রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, কোনও কারণেই ব্যক্তিমানুষের স্বাতন্ত্র্যকে বিনষ্ট করা যাবে না। মানুষের ভাল করার জন্য এই নীতিগুলি অনুসরণ করে কাজ করতে হবে। আর কাজের জন্য চাই প্রয়োজনমাফিক শিক্ষা। ব্যক্তিমানুষ সামাজিক পরিসরে কাজকর্মের মাধ্যমে স্বদেশকে নিজের বলে জানতে চিনতে শিখবেন। বাইরে থেকে নানা অনুঘটকের মাধ্যমে নেশনের কল্পনা উসকে দেওয়া হয়, স্বদেশের কল্পনা এমন উসকে দেওয়া হবে না। রবীন্দ্রনাথের এই পরিকল্পনা নিছক কথার কথা ছিল না। তিনি তাঁর বিশ্বভারতীকে কেন্দ্র করে এমনই এক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন। শান্তিনিকেতনে কেবল পড়াশোনার জন্য বিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়নি, শ্রীনিকেতনের মাধ্যমে পল্লি পুনর্গঠনের কাজ করা হয়েছিল।
কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, এই পরিকল্পনা বাস্তবে বৃহত্তর ক্ষেত্রে কতটা প্রয়োগ সম্ভব? আর তা ছাড়া, তিনি নেশনের যে রূপ দেখেছিলেন নেশন কি শুধু তা-ই? তার কি নানা চেহারা হতে পারে না? রবীন্দ্রনাথের সমাজের ধারণা ছোটখাটো পরিসরে কিছু মানুষের মধ্যে খানিকটা কাজে লাগানো যেতে পারে। কিন্তু বহুসংখ্যক মানুষের দেশে এমন কর্মকাণ্ড বৃহৎ পরিসরে কি আদৌ গড়ে তোলা সম্ভব? তা যদি না যায় তা হলে কবির এই ‘সমাজ’ ‘স্বদেশ’ ইত্যাদি ভাবনাকে এ কালের পক্ষে অচল বলে বর্জন করাই ভাল। সমাজ-স্বদেশ ইত্যাদির কথা বলে আজ আর নেশনের বিজয় রথকে আটকানো যাবে না। অন্য রকম নেশনের কথা ভাবতে হবে।
হক কথা। তবে প্রশ্ন হল, রবীন্দ্রনাথ নেশনের উল্টো দিকে যে ‘সমাজ’ ও ‘স্বদেশ’-এর পরিকল্পনা করেছিলেন সেই পরিকল্পনাকেই কি তিনি ‘সর্বময়’ বলে মনে করতেন? তাঁর এই সমাজ ও স্বদেশের মডেলকেই কি তিনি একমাত্র বিকল্প পথ বলে ভেবেছিলেন? এখান থেকেই আলোচনা নতুন করে শুরু করার অবকাশ আছে বলে মনে হয়। পরিণত রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘মানুষের ধর্ম’ নিবন্ধে লিখেছিলেন, ‘মানুষ যথার্থই অনাগারিক। জন্তুরা পেয়েছে বাসা, মানুষ পেয়েছে পথ। মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ যাঁরা তাঁরা পথনির্মাতা, পথপ্রদর্শক। বুদ্ধকে যখন কোনও এক জন লোক চরমতত্ত্বের প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিল, তিনি বলেছিলেন, “আমি চরমের কথা বলতে আসি নি, আমি বলব পথের কথা।” মানুষ এক যুগে যাকে আশ্রয় করছে আর-এক যুগে উন্মাদের মতো তার দেয়াল ভেঙে বেরিয়ে পড়েছে পথে।’ তিনি মানুষের যে ধর্মকে এখানে নির্দেশ করেছেন তা তাঁর নিজেরও ধর্ম। মানুষের ইহজীবনে ‘চরম’ বলে কিছু নেই। এক যুগ থেকে অন্য যুগে সময় ও সমাজ চলে যাচ্ছে আর নতুন নতুন পথ খুঁজতে হচ্ছে মানুষকে। সব ‘ব্যাদে’ আছে বা সব বিজ্ঞানের এই বইতে আছে, এ কথা বলে থমকে দাঁড়ানো মানুষের ধর্ম নয়।
ইউরোপীয় নেশনের মডেলের ত্রুটিগুলি দেখিয়ে অন্য পথ নির্মাণে সচেষ্ট হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই নতুন পথে সমাজ ও স্বদেশ ভাবনা যে ‘চরম’, এ কথা তিনি কিন্তু মনে করতেন না। এক যুগ যাকে আশ্রয় করেছে, আর এক যুগ তার দেয়াল ভেঙে বেরিয়ে পড়েছে— এই ইতিহাসবোধের অধিকারী ‘অনাগারিক’ রবীন্দ্রনাথের ভাবনাকে আমরাই আসলে ‘খোপবন্দি’ করতে চাই। কী হবে ইউরোপীয় নেশনের প্রতিরোধী মডেল? রবীন্দ্রনাথ অন্য অনেকের মতোই তা অনুসন্ধান করছিলেন। সে জন্য তিনি নিজে আক্ষরিক অর্থে নেমেছিলেন পথে। নানা দেশে যাচ্ছিলেন, যতটা সম্ভব খতিয়ে বুঝতে চাইছিলেন সেই সব দেশের বিধিব্যবস্থা। এটাই রবীন্দ্রনাথের পথের সঞ্চয়। এই লেখার দ্বিতীয় অংশে তার কিছু নজির খুঁজব।
(চলবে)
বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক