রবীন্দ্রনাথ কার্ল মার্ক্স নন। সাধারণ জনের পালনীয় বৈপ্লবিক ইস্তাহার তিনি রচনা করেননি। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় মিনার্ভায় পঠিত ‘স্বদেশী সমাজ’ রচনাটির মধ্যে ইস্তাহার-সুলভ নানা নির্দেশ ছিল থাকলেও তাকে ইস্তাহার বলা চলে না। আবার, জীবনের শেষ প্রান্তে জনসাধারণের অধিকার রক্ষার জন্য ইন্ডিয়ান সিভিল লিবার্টিজ় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন, কিন্তু সেটাও বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে পড়ে না। ‘লিবারাল বুর্জোয়া’ রবীন্দ্রনাথের জীবনে নানা সময়ে নানা পিছুটান। প্রগতিশীল ভাবনার সঙ্গে সবসময় কাজের মিল নেই। পিছুটানের উদাহরণ আছে তাঁর সাংস্কৃতিক ভাবনাতেও। কিন্তু এই সব মনে রেখেও তাঁর নামে একটি ম্যানিফেস্টো লিখতে সাধ হয়। তার কারণ, রবীন্দ্রনাথ নিজেকে সংশোধন করেন। কোনও স্থির মতের কারাগারে তিনি বদ্ধ নন। তিনি ‘অনাগারিক’। এই অনাগারিকতাকেই তিনি মানুষের ধর্ম বলে মনে করতেন।
‘অনাগারিকতা’ শব্দটি রবীন্দ্রনাথ বৌদ্ধ-দর্শন থেকে গ্রহণ করেছিলেন। অনাগারিক মানে যার আগার নেই। অনাগারিক বলেই এক সময়ের মানুষ যে ভাবনাকে মাথায় করে রেখেছিল অন্য সময়ের মানুষ সেই ভাবনাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করতে পারে। কেন মানুষ সেটা করে, তার একটি ইঙ্গিত ছিল তাঁর কম বয়সে লেখা বিবিধ প্রসঙ্গ-এর অন্তর্গত ‘মনোগণিত’ রচনায়। লিখেছিলেন, যুগযুগান্তর ধরে পৃথিবীর মানুষ একটি অঙ্ক কষছে। তার আদর্শ ফল ‘পূর্ণ সুখ’ বা ‘মঙ্গল’। সেই ঈপ্সিত ফল কী ভাবে যাওয়া যায় তা-ই নানা পদ্ধতিতে অঙ্ক কষে কষে দেখার কথা। ‘এখনো কষা ফুরোয় নি, কবে ফুরাইবে কে জানে! তাহার এক একবার যখনি মনে হয় অঙ্ক ভুল হইল, তৎক্ষণাৎ সে সমস্তটা রক্ত দিয়া মুছিয়া ফেলে। ইহাকেই বলে বিপ্লব।’ এই ছোট লেখাটিতে অনেক কিছুই তিনি বিস্তারে বলেননি। যেমন পূর্ণ সুখ বা মঙ্গলের ধারণা মানুষের ব্যক্তিগত ও শ্রেণিগত অবস্থান অনুসারে আলাদা। ফরাসি বিপ্লবের সময় রাজপ্রাসাদে ষোড়শ লুই যাকে সুখ বলে ভাবছিলেন বা ফার্স্ট-সেকেন্ড এস্টেটের মানুষেরা যাকে মঙ্গল বলে ভাবছিলেন তাকে থার্ড এস্টেট সুখ-মঙ্গল বলে ভাবেনি। ফলে রক্ত দিয়ে অভিজাতদের ভুল অঙ্ক থার্ড এস্টেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে মুছে দিতে হল। আবার থার্ড এস্টেটের মধ্যে পরে হত্যা ও নৈরাজ্য— স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্বের নীতি ঘোষণা করেও ফ্রান্সের মানুষ সামাজিক মঙ্গল প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। রক্ত দিয়ে ভুল অঙ্ক বার বার মুছলেই যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পূর্ণসুখ মিলবে এমন নয়। মানবসভ্যতা ‘পূর্ণসুখ’ নামের স্বর্গে পৌঁছে থেমেও যাবে না। সেই চেষ্টা আজীবন করে যেতে হবে, তবে তার জন্য মেনে চলা চাই কতগুলি নীতি। সেগুলিকেই বলা চলে রাবীন্দ্রিক ম্যানিফেস্টোর মূল সূত্র। আপাতত দেখা যাক নেশন, প্রকৃতি ও ধর্ম— এই তিনটি বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা কী ছিল।
মার্ক্সের মতোই রবীন্দ্রনাথও ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার সমালোচক ছিলেন। নেশন-এর কদর্য রূপ বিষয়ে তাঁর ধারণা ছিল স্পষ্ট। নানা লেখাতে তিনি পাশ্চাত্যের যুদ্ধকামী নেশনের বিরোধিতা করেছেন। তার আদলে প্রাচ্যে নেশনতন্ত্র গড়ে উঠলে তিনি তার তীব্র সমালোচনা করেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে তবু ‘নেশন-বিরোধী’ বলা যাবে না। নেশনের বিশেষ ধনতান্ত্রিক রূপের তিনি সমালোচক। তারই প্রতিষেধক হিসেবে সচেতন হিতবাদী গ্রামকেন্দ্রিক এক সমাজব্যবস্থার পুনর্নবীকরণ করতে চেয়েছিলেন তিনি। আবার, সেই পরিকল্পনা যে যথেষ্ট ঘাতসহ নয়, জীবনের শেষে এসে সে কথা বুঝতে কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন কবির অসুবিধে হয়নি। তাই আশি বছরের রবীন্দ্রনাথ বিকল্প এক নেশনের সন্ধানে ব্রতী। শেষ ভাষণ ‘সভ্যতার সংকট’-এ তাঁর নেশন-ভাবনার শেষ পরিচয় রয়েছে। রাষ্ট্রশক্তি রাষ্ট্রিক-সম্বন্ধ স্থাপনের জন্য বলপ্রয়োগ করবে না, এই হল তাঁর আদর্শ। রবীন্দ্রনাথের এই বিকল্প নেশন-ভাবনার সঙ্গে নেহরু পরিচিত ছিলেন। সে আদর্শ কতটা রূপায়িত করতে পেরেছিলেন সে অন্য কথা, কিন্তু তিনি রাবীন্দ্রিক মডেল মাথায় রাখচেন। এ দেশের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা কবি-কথাকে স্বীকার করলে কিছুতেই ভারত উগ্র-নেশনবাদী হয়ে উঠতে পারে না।
রাবীন্দ্রিক ইস্তাহারের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ধাপ প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক। ধনতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার উন্নয়নের মডেল যে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করছে এবং এর ফলে যে মানবসভ্যতা ধ্বংসের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাবে, বিজ্ঞানীরা সেটা বলছেন। যে পর্বে ধনতান্ত্রিক আধিপত্যকামী নেশনের বিরোধিতা করছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সেই পর্বেই ভূ-সম্পদের বিত্তহরণের প্রতিবাদ করছিলেন তিনি। প্রাকৃতিক সম্পদকে কুক্ষিগত করে মুনাফা আদায়ের কল নির্মাণ করার ঘোর বিরোধী তিনি। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের বিযুক্তি চাননি, প্রকৃতির পেট কেটে সমস্ত সোনার ডিম নিয়ে নেওয়ার অর্থনীতি তাঁর বিরক্তির কারণ। মুক্তধারা বা রক্তকরবী-তে সে কথা উচ্চারিত। একমাত্রিক হিন্দু-ভারত কল্পনার প্রবল ব্যাধি থেকে মুক্ত হয়ে বহুত্ববাদী পুরনো ভারতের দিকে তাকালে দেখা যাবে সেখানে ভূ-সম্পদের বিত্ত রক্ষণের কথাই নানা ভাবে বলা হয়েছে।
ধর্ম সম্বন্ধেও রবীন্দ্রনাথের নীতি নানা স্তর অতিক্রম করে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। তিনি ধর্ম-বিবিক্ত মানুষ ছিলেন না, প্রাতিষ্ঠানিক বিভেদকামী ধর্মের বিরোধী ছিলেন। ১৯৩৭–এ সুভাষচন্দ্র বসুকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশের একদল মুসলমানের মধ্যে যখন অযথা গোড়ামির জেদ দেখতে পাই তখন সেটা আমাদের পক্ষে অসহ্য হয়, তাদের অনুসরণ করে আমরাও যখন অন্যায় আবদার করি তখন সেটা আমাদের পক্ষে লজ্জার বিষয় হয়ে ওঠে।’ প্রাতিষ্ঠানিক সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে ব্যক্তিগত উপলব্ধির ধর্মকে কিন্তু তিনি অস্বীকার করেননি। ‘সেকুলারিজম্ এবং জওয়াহরলাল নেহেরু’ প্রবন্ধে আবু সয়ীদ আইয়ুব লিখেছিলেন, ‘ভারতীয় মনের অন্তরতম স্তরে রয়েছে এমন এক আধ্যাত্মিকতার আমেজ যাকে মুছে ফেলা আমার মতে সম্ভবও নয়, বাঞ্ছনীয়ও নয়।’ প্রগতিশীল সেকুলারিজ়মের দোহাই দিয়ে এই ‘আধ্যাত্মিক’ ভারতীয় মনকে নির্বিচারে অবজ্ঞা করার ফলেই হয়তো আজ তার বিপরীত প্রতিক্রিয়া হিসেবে ধর্মান্ধতার প্রকাশ ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথ রাষ্ট্রিকতায় শান্তি, ঐক্য, শুভবুদ্ধিকে চেয়েছিলেন, হিন্দু-মুসলমানের ‘কোনো এক পক্ষের জিদকে দুর্দম করে হারজিতের অন্তহীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা’ চাননি। তাই বলে ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মের স্থান থাকবে না এমন নাস্তিক্যেও তাঁর বিশ্বাস ছিল না।
নেশন-প্রকৃতি-ধর্ম নিয়ে রবীন্দ্রনাথের এই সব সিদ্ধান্ত মেনে চললে ভারতীয় রাজনীতিতে পূর্ণসুখ বা মঙ্গল স্থাপনের অঙ্কটি কষা হয়তো সহজ হবে।
বাংলা বিভাগ, বিশ্বভারতী