কবিতায় ঈশ্বরচন্দ্রকে মাইকেল মধুসূদন দত্ত বিদ্যার সাগর, করুণার সিন্ধু, দীনের বন্ধু বলে সম্বোধন করেছিলেন। ইংরেজি গদ্যে তিনি বিদ্যাসাগরের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন প্রাচীন পণ্ডিতের প্রতিভা ও জ্ঞান, ইংরেজের কর্মশক্তি ও বাঙালি মায়ের হৃদয়— এই গুণগুলি সমাজসংস্কারক ও শিক্ষাবিদ হিসেবে বিদ্যাসাগরের কাজে ছাপ ফেলেছিল।
উনিশ শতকের বাঙালি সমাজে বিদ্যাসাগরের আবির্ভাব রবীন্দ্রনাথের কাছে মনে হয়েছিল যেন এক অতি আশ্চর্য ঘটনা। তাঁর বিখ্যাত ‘বিদ্যাসাগরচরিত’ ভাষণে তিনি লেখেন “আমাদের এই অবমানিত দেশে ঈশ্বরচন্দ্রের মতো এমন অখণ্ড পৌরুষের আদর্শ কেমন করিয়া জন্মগ্রহণ করিল, আমরা বলিতে পারি না। কাকের বাসায় কোকিলে ডিম পাড়িয়া যায়— মানব-ইতিহাসের বিধাতা সেইরূপ গোপনে কৌশলে বঙ্গভূমির প্রতি বিদ্যাসাগরকে মানুষ করিবার ভার দিয়াছিলেন।”
রবীন্দ্রনাথের মতে বিদ্যাসাগর ছিলেন এই বাংলায় ‘একক’, তাঁর স্বজাতি সহোদর কেউ ছিল না। অথচ মানব-ইতিহাসে সম্পূর্ণ একাকীত্ব বিরল, সে কালের বাঙালি সমাজে নিশ্চয়ই একটি দয়ার ঐতিহ্য, উদার মনোভাবের ধারা ছিল, যা ইউরোপ থেকে আমদানি করা লিবারালিজ়ম-এর চেয়ে আলাদা। রবীন্দ্রনাথ নিজেই তাঁর প্রবন্ধে বিদ্যাসাগরের মা ভগবতী দেবীর প্রভাবের দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন: “ভগবতী দেবীর অকুণ্ঠিত দয়া তাঁহার গ্রাম, পল্লী, প্রতিবেশীকে নিয়ত অভিষিক্ত করিয়া রাখিত।” সমালোচকরা হয়তো মনে করতে পারেন যে, জননী সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা খানিকটা ‘পরিমাণ বহির্ভূত’ হয়ে পড়ছে। রবীন্দ্রনাথের দৃঢ় প্রত্যয় যে, জননীর ও পুত্রের চরিত্রে প্রভেদ নেই, তাঁরা ‘পরস্পরের পুনরাবৃত্তি’। অভিমন্যু যেমন জননী-জঠরে যুদ্ধবিদ্যা শিখেছিলেন, বিদ্যাসাগর তেমনই ‘বিধিলিখিত সেই মহাশাস্ত্র মাতৃগর্ভবাসকালেই অধ্যয়ন’ করে এসেছিলেন।
বিদ্যাসাগরের নিজের কোনও সন্দেহ ছিল না যে “বিধবাবিবাহ প্রবর্তন আমার জীবনের সর্বপ্রধান সৎকর্ম। এ জন্মে যে ইহা অপেক্ষা অধিকতর আর কোনও সৎকর্ম করিতে পারিব, তাহার সম্ভাবনা নাই।” এক দিক থেকে তাঁর মহান পূর্বসূরি রামমোহন তাঁর জন্যে এক সমস্যা সৃষ্টি করে গিয়েছিলেন। সতীদাহ প্রথার বিরোধিতা করতে গিয়ে রামমোহন শাস্ত্রের ভিত্তিতে বিধবার সতীত্বের গুণগান করেছিলেন। বিধবাবিবাহের পক্ষে সওয়াল করতে বিদ্যাসাগরকে ১৮৫৫ সালে পরাশর সংহিতার আশ্রয় নিতে হয়। তাঁর এই প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘সংস্কৃতশ্লোক ও বাংলা গালি মিশ্রিত এক তুমুল কলকোলাহল উত্থিত’ হয়েছিল।
আট বছর বয়সি বালক ঈশ্বরচন্দ্র তার পিতৃদেব ঠাকুরদাসের সঙ্গে গ্রাম থেকে কলকাতা যাওয়ার পথে মাইলফলক দেখে ইংরেজি সংখ্যা শিখে নিয়েছিল। সমাজসংস্কারক হিসেবে তাঁর যাত্রার পথ ছিল আরও অনেক দুর্গম। অশোক সেন তাঁর ১৯৭৭-এ প্রকাশিত বইয়ে বিদ্যাসাগরের জীবনে ‘ইলিউসিভ মাইলস্টোন’-গুলির কথা লিখেছেন। তিনি যা চেয়েছিলেন, তা ব্যক্তি ও ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে অধরা থেকে গিয়েছিল। তবে তিনি ছিলেন ভবিষ্যতের দিশারি।
সৎকর্ম ও কীর্তির মধ্যে তফাত আছে। বাংলা ভাষাই তাঁর প্রধান কীর্তি। এই অভিমত আমার নয়, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের সুচিন্তিত মূল্যায়ন— “বিদ্যাসাগর বাংলাভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী ছিলেন।” তিনি আমাদের মাতৃভাষা সরল, সুন্দর ও সুশৃঙ্খল করে পরিবেশন করেছিলেন। বিদ্যাসাগর ছিলেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাণপুরুষ। ১৮৪১-এ ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রধান পণ্ডিত, ১৮৫১-য় সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ, আর তার পরে মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনের প্রতিষ্ঠাতা। সংস্কৃত কলেজে তিনি ইংরেজি শিক্ষা আবশ্যিক করেছিলেন, মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে তৈরি করেছিলেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শিক্ষার সমন্বয়। বিদ্যাসাগর দেখতে চেয়েছিলেন প্রাথমিক ও মেয়েদের শিক্ষার প্রসার। ব্রিটিশ রাজের কার্পণ্যের ফলে তাঁর সেই স্বপ্ন সে ভাবে পূরণ হতে পারেনি। সংস্কৃত কলেজে ব্রাহ্মণ মনোপলি তিনি ভেঙে দিয়েছিলেন।
পাঁচ দশক আগে অতি বামেরা তাঁর মূর্তির মুণ্ডচ্ছেদ করেছিল। তিনি নাকি ইংরেজ রাজত্বের বিরোধিতা করেননি। অশোক সেন দেখিয়েছিলেন যে, উনিশ শতকে ‘লয়ালটি’ ও ‘অপোজ়িশন’-এর মাঝখানের রেখা ছিল খুবই সূক্ষ্ম। বিদ্যাসাগর ইংরেজদের কাছে কখনও মাথা নত করেননি, নিজের ও বাঙালির আত্মমর্যাদার বিষয়ে তিনি সর্বদা সচেতন ছিলেন। প্রমাণ হিসেবে রবীন্দ্রনাথ একটি উদাহরণের উল্লেখ করেন। এক বার হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ কার-সাহেব তাঁর ‘বুটবেষ্টিত দুই পা টেবিলের উপর ঊর্ধ্বগামী’ করে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে সভ্যতার অভিমান দেখিয়েছিলেন। কিছু দিন পরে যখন এই সাহেব সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে দেখা করতে এলেন তখন ঈশ্বরচন্দ্র চটিজুতা সমেত তাঁর ‘সর্বজনবন্দনীয় চরণযুগল’ টেবিলের উপর প্রসারিত করে অহঙ্কৃত ইংরেজের সঙ্গে আলাপ করেন।
আজকের এই মিথ্যার যুগে বিদ্যাসাগর কতটা প্রাসঙ্গিক? বর্ণপরিচয়ে তাঁর ‘সদা সত্য কথা বলিবে’ উপদেশ কি আজকের ছেলেমেয়েদের মনে দাগ কাটবে? তাঁর নীতির পাঠের থেকে হয়তো কেউ মুখ ফিরিয়ে নেবে। হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীরা তাঁকে চিনবে না, তাঁর সাদা চাদর পরিহিত দীপ্ত আবক্ষ মূর্তি ধুলায় লুণ্ঠিত হওয়াই আজকের রীতি। অথচ বাংলার আত্মসম্মান রক্ষার জন্য বিদ্যাসাগরকে স্মরণ করা আজ বিশেষ প্রয়োজন। বাংলার শিক্ষা ও সমাজের ইতিহাসে ঈশ্বরচন্দ্র উন্মুক্ত ও উদার মননের প্রতীক। তাঁর বিদ্যা ও দয়া, কোনওটাই ভুলবার নয়।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর বক্তৃতা শুরু করেছিলেন বিদ্যাসাগরের চরিত্রের সর্বপ্রধান গুণের কথা বলে— “যে গুণে তিনি পল্লী-আচারের ক্ষুদ্রতা, বাঙালীজীবনের জড়ত্ব সবলে ভেদ করিয়া একমাত্র নিজের গতিবেগপ্রাবল্যে কঠিন প্রতিকূলতার বক্ষ বিদীর্ণ করিয়া— হিন্দুত্বের দিকে নহে, সাম্প্রদায়িকতার দিকে নহে— করুণার অশ্রুজলপূর্ণ উন্মুক্ত অপার মনুষ্যত্বের অভিমুখে আপনার দৃঢ়নিষ্ঠ একাগ্র একক জীবনকে প্রবাহিত করিয়া লইয়া গিয়াছিলেন।” বিদ্যাসাগরের জন্মদ্বিশতবর্ষে যদি আমরা উগ্র হিন্দুত্ব ও সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ করে বাঙালি জীবনকে আবার অপার মনুষ্যত্বের দিকে নিয়ে যেতে পারি, তবে সেটাই হবে এই অনন্য ব্যক্তিত্বের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা অর্পণ।
ইতিহাস বিভাগ, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি,
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র