মাসখানেক হল, প্রায় ২১ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। জিডিপি-র প্রায় ১০ শতাংশ। মার্চের শেষে ঘোষিত ১.৯ লক্ষ কোটি টাকার ত্রাণ প্রকল্পটিও এই প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত। কিছু দিন ধরেই পূর্বাভাস মিলছে, স্বাধীনতা-উত্তর সময়ের মারাত্মকতম মন্দার সম্মুখীন হতে চলেছে ভারতীয় অর্থনীতি। আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার জানিয়েছে, চলতি অর্থবর্ষে এ দেশের বৃদ্ধির হার প্রায় ৪.৫ শতাংশ পর্যন্ত নামতে পারে। এই পরিপ্রেক্ষিতে প্যাকেজটির গুরুত্ব স্বভাবতই আরও বেড়েছে।
এই অবস্থায় সরকারের কর্তব্য নিয়ে কোনও সংশয় নেই— অর্থব্যবস্থার পুনরুজ্জীবনে যথেষ্ট আর্থিক স্টিমুলাস বা উদ্দীপকের ব্যবস্থা করতে হবে। উন্নত দেশগুলিতে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে বিভিন্ন উদ্দীপক প্যাকেজের ব্যবস্থা হয়েছে। এমনকি, আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারও (আইএমএফ) বলছে, এ অবস্থায় সরকারকে অনেক বেশি ভূমিকা নিতে হবে। বাজারে ন্যূনতম সরকারি উপস্থিতির নিদান আপাতত শিকেয় তোলা। আইএমএফ-এর পরামর্শ, অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে সরকার যে টাকা খরচ করবে, তা স্বাস্থ্য, পরিকাঠামো, পরিবেশ-বান্ধব প্রযুক্তি, শিক্ষা ও গবেষণা ইত্যাদি খাতে লগ্নি হোক। এতে উৎপাদনশীলতা বাড়বে। তাদের আরও প্রস্তাব, সরকার প্রোগ্রেসিভ ট্যাক্সের বন্দোবস্ত করুক— যার যত বেশি আয়, তার থেকে তত বেশি কর নিক; যাঁরা কাজ হারিয়েছেন, তাঁদের আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা হোক। এবং, তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, আইএমএফ বলেছে, এই সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির গুরুত্ব অনেক।
ভারতে ঘোষিত আর্থিক প্যাকেজটির সবচেয়ে লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য: এটি উদ্দীপক প্যাকেজমাত্র নয়। প্যাকেজটিতে বেশ কিছু নীতি ঘোষিত হয়েছে, যেগুলো কবে বাস্তবায়িত হবে, বোঝার উপায় নেই। যেমন কয়লা, পারমাণবিক শক্তি, মহাকাশ প্রভৃতি বেশ কিছু ক্ষেত্রে বেসরকারি পুঁজিকে ছাড়পত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত। বেশির ভাগ দেশে বেসরকারি ক্ষেত্রগুলি সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ পেতে সরকারের সাহায্য চাইছে। ভারতে মনে হচ্ছে গল্পটা উল্টো।
অর্থনৈতিক প্যাকেজের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক— অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এমএসএমই)-সহ ব্যবসা খাতে ৩.৭ লক্ষ কোটি টাকার ঋণ। এই ঋণের সিংহভাগ, অর্থাৎ ৩ লক্ষ কোটি টাকা হল ব্যবসার প্রাত্যহিক কাজকর্ম চালাতে প্রয়োজনীয় পুঁজির জোগানের জন্য সহযোগিতা। দেশে এমএসএমই ক্ষেত্রের অধীনে রয়েছে প্রায় ৬.৩ কোটি শিল্প (২০১৫-র হিসেব)। কর্মসংস্থানের দিক দিয়ে ক্ষেত্রটি প্রভূত সম্ভাবনাময়। সরকারের এই ঋণ ঘোষণায় এমএসএমই ক্ষেত্রটি আসলে কতখানি হাঁপ ছাড়তে পারে, একটু খতিয়ে দেখা যাক।
এমএসএমই ১১ কোটিরও বেশি মানুষের মুখে অন্ন জোগায়। এই শিল্পক্ষেত্রের ৯৯ শতাংশেরও বেশি হল অতিক্ষুদ্র সংস্থা; ৮৪ শতাংশ সংস্থায় কোনও স্থায়ী কর্মী নেই। এবং, অধিকাংশ এমএসএমই ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নেয়নি। কারণ, তাদের ধার করার মতো সামর্থ্যই নেই। ২০২০-তে এসে পরিস্থিতি রাতারাতি বদলে গিয়েছে? মনে তো হয় না!
বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থা ও এমএসএমইগুলির জন্য যে অর্থসাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিল সরকার, অন্তত দুটো কারণে সেগুলি এই ক্ষেত্রের প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। প্রথমত, শিল্প সংস্থাগুলির যদি অতিরিক্ত কার্যকরী মূলধন লাগে, তবে তারা কম সুদে ঋণ পাবে— ব্যাঙ্কে যত টাকা ঋণ আছে, তার ২০ শতাংশ। অর্থাৎ, এই ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ঋণ পাওয়ার শর্ত হল, সংস্থাগুলোর আগে থেকেই কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, যে সংস্থা নিয়ম মেনে জমাখরচের হিসাবনিকাশ রাখে, ঋণ পাবে শুধু তারাই। অধিকাংশ এমএসএমই-ই এই দুটো শর্তের একটাও পূরণ করে না।
আসলে এমএসএমই বলতে এত দিন ধরে যাদের বোঝানো হত, সরকারের লক্ষ্য আদৌ তারা নয়। সরকার এমএসএমই-র সংজ্ঞা বদলে দিতেই বিষয়টি জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। নতুন সংজ্ঞায় এমএসএমই-র প্রতিটি ধাপের, অর্থাৎ অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিনিয়োগের পরিমাণের মাপ বাড়ানো হয়েছে। তা ছাড়াও, বাৎসরিক লেনদেনের পরিমাণকেও সংজ্ঞার আওতাভুক্ত করা হয়েছে। ফলে, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি— কোন স্তরে কোন সংস্থা পড়বে তার পরিধিও অনেক বিস্তৃত হয়েছে। নতুন সংজ্ঞা অনুযায়ী, কোনও সংস্থায় ২০ কোটি টাকা পর্যন্ত লগ্নি এবং ১০০ কোটি টাকা পর্যন্ত বাণিজ্যিক লেনদেনের পরিমাণ হলে এখন থেকে তাকে মাঝারি শিল্পের বর্গে ফেলা যাবে। অর্থাৎ, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে যে ৩.৭ লক্ষ কোটি টাকার আর্থিক সহায়তা দেওয়া হল, অনেক ‘বড়’ সংস্থাও এ বার সেই প্যাকেজে লাভবান হতে পারবে। অসংগঠিত ক্ষেত্রের ভাগ্যে জুটল লবডঙ্কা।
প্যাকেজের আর একটি বড় ঘোষণা: কিসান ক্রেডিট কার্ড-এর (কেসিসি) মাধ্যমে আড়াই কোটি কৃষককে কম সুদে ঋণ দিতে ২ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। কেসিসি কৃষকদের বরাবরই ভাল পরিষেবা দিয়েছে। কিন্তু এই দুর্যোগপ্রহরে যখন অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ পাহাড়সমান হওয়ার আশঙ্কা, ব্যাঙ্কগুলো কি তখন এই বাড়তি দায়িত্বের বোঝা বইতে চাইবে? সরকারি নজরদারি জরুরি।
কৃষি ও সহযোগী কার্যক্ষেত্রকে (মৎস্যসম্পদ-সহ) ১.৮ লক্ষ কোটির সহায়তার অঙ্গীকার করা হয়েছে। গোটা আর্থিক প্যাকেজের মাত্র ৯ শতাংশ। পরিকাঠামোগত সহায়তা, ঋণ ও খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ শিল্প (অ্যাগ্রো-প্রসেসিং সেক্টর) ইত্যাদিকেও এর মধ্যেই ধরা হয়েছে। এই পরিকাঠামো ঠিকঠাক তৈরি করা গেলে ছোট চাষি এবং কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন মৎস্যজীবীদের সুবিধাই হবে। ঘরে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকদের চাপ গ্রামীণ ক্ষেত্রের ওপরেই পড়ছে, ফলে গ্রামীণ অর্থনীতির জোর বাড়ানো ভিন্ন উপায়ান্তর নেই। দুর্ভাগ্য, এই প্যাকেজও গ্রামীণ অর্থনীতিকে অবজ্ঞাই করল।
বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থাগুলিকে ৯০,০০০ কোটি টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হল। মধ্যবিত্তের গৃহঋণের সুদের ওপর ভর্তুকির মেয়াদ বাড়ল। সরকারের আশা, ভর্তুকির ফলে বাড়ি নির্মাণশিল্পে ৭০,০০০ কোটি টাকার নতুন লগ্নি হবে। কিন্তু ধুঁকতে থাকা আবাসন শিল্প তহবিলের জোরে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে?
এ বার প্রশ্ন, আর্থিক প্যাকেজের মূলধন জোগাবে কে? অর্থমন্ত্রী বলেছেন, সরকার প্রায় ১১ লক্ষ কোটি টাকা সরবরাহ করবে। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক আট লক্ষ টাকা দেবে। অর্থাৎ, খাতায় কলমে বেশির ভাগ উন্নত দেশের মতো ভারতও মনিটারি পলিসি বা মুদ্রা নীতির চেয়েও ফিসক্যাল পলিসি বা রাজস্ব নীতিকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। রাজস্ব নীতিকে প্রাধান্য দেওয়াই ঠিক রাস্তা। এতে তাড়াতাড়ি চাহিদা বাড়ে, সঙ্কটের সময় বাজারকে চাঙ্গা করে। অন্য দিকে, বাজার যখন অনুকূল স্রোতে তরতর এগোচ্ছে, শুধু তখনই মুদ্রা নীতির সেরা ফলটা মেলে।
সরকার কী করছে, আর রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের জন্য কোন দায়িত্ব বরাদ্দ হয়েছে, ভেঙে দেখলে গল্পটা স্পষ্টতর হবে। সরকারের দায়িত্ব-তালিকায় থাকা বেশ কিছু জিনিস— যেমন, বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির জন্য তিন লক্ষ কোটি টাকা, কিসান ক্রেডিট কার্ডের জন্য দু'লক্ষ কোটি টাকা— নির্ভর করছে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের ওপর। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক নগদের ব্যবস্থা করতে পারলে তবে সরকার খরচ করবে, এই প্যাকেজে থাকা এমন খরচের পরিমাণ সাত লক্ষ কোটি টাকা। মনে রাখা ভাল, এই এপ্রিলে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক ভারতীয় অর্থব্যবস্থায় ৮.৪ লক্ষ কোটি টাকার অতিরিক্ত নগদ জোগানের ব্যবস্থার কথা ঘোষণা করেছিল।
সরকারের প্রকৃত ব্যয় যখন চার লক্ষ কোটি টাকার বেশি নয়, তখন বোঝা সম্ভব, এই প্যাকেজ কোনও ভাবেই ভারতীয় অর্থব্যবস্থার স্বাস্থ্যোদ্ধারে যথেষ্ট হতে পারে না। প্যাকেজের জন্য বাজেট-বহির্ভূত টাকার সংস্থান করতে হবে। সরকার মে মাসেই জানিয়েছিল যে বাজার থেকে ৪.২ লক্ষ কোটি টাকা অতিরিক্ত ঋণ নেওয়া হবে। তার বাইরে প্যাকেজের জন্য যত টাকা দরকার, তা জোগাবে ব্যাঙ্ক। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক মে মাসেই মনিটারি স্টিমুলাস বা মুদ্রা-উদ্দীপক ঘোষণা করেছিল। সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, সরকার নতুন করে যে উদ্দীপকের ব্যবস্থা করল, তা কোনও মতেই জিডিপি-র দুই থেকে তার শতাংশের বেশি নয়। প্রধানমন্ত্রী জিডিপি-র দশ শতাংশ উদ্দীপকের যে ঢাক পিটিয়েছিলেন, সেটা নেহাতই ফাঁকা আওয়াজ। দেশ যখন গভীর মন্দার দিকে এগোচ্ছে, তখন এই রাষ্ট্রীয় তঞ্চকতা বিপদ আরও বাড়াবে বলেই আশঙ্কা।
অর্থনীতি বিভাগ, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়