চিন-ভারতের সীমান্ত সংঘাতের ফলে আর্থিক ত্রিশূল নীতি ঘোষণা করেছে সরকার। উপযুক্ত পদক্ষেপ, সন্দেহ নেই। শত্রুপক্ষ রাতবিরেতে দু’তিনটে দুর্গম জায়গায় ঢুকে পড়লে প্রত্যুত্তরে আরও দশটা দুর্গম জায়গায় পাল্টা ঢুকে পড়া যায় না, উচিতও নয়। ১৯৬২ সালে ভারত এবং তৎপরবর্তী অনেক দেশের সঙ্গে চিনের সম্পর্ক দেখলে বোঝা যায় যে এই অন্যায়টা তাদের পক্ষে নতুন নয়। কিন্তু পরিস্থিতিটাকে চিন-ভারত বাণিজ্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করা দরকার। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অর্থনৈতিক আক্রমণ যথার্থ নীতি, কিন্তু নিজেদের গলদ কত গভীরে, সেটাও আমাদের বুঝতে হবে।
ঘটনা হল, জিনিসপত্র ও পরিষেবা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারত থেকে চিনের রোজগার এবং চিন থেকে ভারতের রোজগারের ফারাক চার গুণের কাছাকাছি। যে দেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি (অর্থাৎ আমদানি-রফতানির ফারাক) দীর্ঘ কাল ধরে ক্রমবর্ধমান, এবং যে দেশ ভারতের অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্য অংশীদার, সেখান থেকে আমদানি কমিয়ে দিলে সমস্যা হতে পারে। কিন্তু প্রশ্নটা হল— অন্যান্য দেশের সঙ্গে যখন ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি তেমন বাড়েনি, তখন কী করে চিনের সঙ্গে এত বেশি বেড়ে গেল? চিন আমাদের রকেট প্রযুক্তি বা সুপার কম্পিউটার সরবরাহ করে না। চিন যা তৈরি করতে পারে সেই প্রযুক্তি আমাদের আছে, কম খরচের শ্রমিক তো আছেই। অথচ আমাদের গণেশের মূর্তি বা বেনারসি শাড়িও চিন থেকে আমদানি হয়। বারাণসীরই শাড়ি তৈরি ও পাইকারি বিক্রির জায়গাগুলোয় চিন থেকে আগত সস্তায় ঝকমকে বেনারসির রমরমা ব্যবসা। কোন রহস্যে চিনা ব্যবসায়ী ভারতের চেয়ে কম পয়সায় একই জিনিস তৈরি করে পাঠায়? এটা বড় সমস্যা। চিন কত ভাল, তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, আমরা কত খারাপ।
দীর্ঘ কাল ধরে শিল্প ক্ষেত্রে এ দেশটা অসুখে ভুগছে। অনেক দিন ধরেই যখন চিনের জাতীয় উৎপাদনে শিল্পের অংশ ৫০ শতাংশের কাছাকাছি, আমাদের ৩০ শতাংশতেও পৌঁছয়নি। চিন থেকে আমদানি করা জিনিসের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে আসে ব্যবসার প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ এবং ওষুধের কাঁচামাল। আমরা এগুলো তৈরি করতে পারি, সস্তায় পারি না। কেন? এ নিয়ে ক্ষমতার অলিন্দে তোলপাড় হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু হয়নি। ক’টা জিনিস আমরা নিজেরা তৈরি করতে পারি এবং পারি না, তার কারণ নিয়ে সরকারি মহলে গভীর আলোচনা দেখিনি। সীমান্তে দু’তিনটে প্যাট্রল পয়েন্ট নিয়ে এত শোরগোল— চিন এ দিকে আমাদের শিল্পের প্রায় সব ক’টি জায়গা দখল করে বসেছে।
আজ আমরা একটা সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। সরকারকে বুঝতে হবে, প্রতিবেশী আগ্রাসী শক্তি আমাদের অর্থনৈতিক ভাবে পরাধীন করে ফেলেছে। তাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর উপায়, দেশে শিল্প বিপ্লব আনার ব্যবস্থা। এখনই চিন থেকে আমদানিকৃত সব জিনিসের দেশে তৈরির খরচ ও দাম নিয়ে সরকারি স্তরে গবেষণা ও বিশ্লেষণ শুরু করা দরকার। চিন আমাদের চেয়ে বড়লোক দেশ, ওদের মজুরি বেশি। অথচ আমরা ১০০ টাকায় যে জিনিস তৈরি করি, চিন সেটা করে ৮০ টাকায়। কী ভাবে? সরকার কি উত্তর জানে? জানলে, আমরা কেন তা শুনতে পাই না? আর না জানলে, সব সরকারের এই উত্তর খোঁজা উচিত। পেশাদারি জ্ঞান অর্জন করে সরকারকেও বুঝতে হবে, কোন কোন জিনিস কী ভাবে প্রচুর পরিমাণে তৈরি করা যায়। শুধু চিনের ওপর নির্ভরতা কমানো নয়, জাতীয় উৎপাদনে শিল্পের অংশ বাড়ানোরও চ্যালেঞ্জ এটা।
যা নিজেরা তৈরি করা যায়, করতে হবে। লক্ষ্য হবে উপভোক্তারা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন। দেশের নেতাদের দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাস ঘেঁটে দেখতে অনুরোধ করব। বাণিজ্য ও বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করে, দেশের শিল্প সংরক্ষিত করে, উদ্ভাবনী শক্তিকে উৎসাহ দিয়ে শিল্প-সাম্রাজ্য তৈরি করল তারা। সারা বিশ্বেই এখন দেশমুখী বাণিজ্য শিল্প নীতি দেখা যাচ্ছে, দেখা যাবে। সে প্রক্রিয়া কোভিডের আগেই শুরু হয়েছে। চিন থেকে আমদানি কমাতেই হবে, কিন্তু প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করে। দেশের ভেতর ঘোষিত এবং অঘোষিত উৎপাদন সাহায্য বাড়াতে হবে, যাতে দেশের ভেতরের চাহিদা বা বাজারকে নিজেরাই জোগান দিতে পারি। অনেকে বলেন, চিন সস্তায় জিনিস দেওয়ায় ভারতের উপভোক্তাদের উপকার হচ্ছে। কথা হল এই যে, সৈন্যরা যদি প্রাণ দিয়ে সীমান্ত রক্ষা করতে পারেন, তা হলে গোটা দেশ অনেক জিনিসের দাম দু’পয়সা বেশি দামে কিনতে পারে। অন্তত সাময়িক ভাবে, যত দিন না আমাদের শিল্প একই দক্ষতায় পৌঁছতে পারে।
আবার এটাও মনে রাখতে হবে, গণতান্ত্রিক অধিকারবোধ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, দেশের সংবিধান, বিচার ব্যবস্থায় চিনের চেয়ে অনেক উন্নত ভারত। যাঁরা শুধু টাকা ও সেনাবাহিনী দেখেন, আর দেখেন আমেরিকার সঙ্গে টক্কর, তাঁরা এটা মানবেন না। গণতন্ত্র আমাদের জন্মগত বলে এই অধিকারকে আমরা বেশি পাত্তা দিই না। তবে, গণতন্ত্র আমাদের দুর্নীতি করতে, আইন ভাঙতে, উচ্ছৃঙ্খল হতে শিখিয়েছে। বিচার ব্যবস্থাকে শ্লথ করেছে। চিনের কাছে অর্থনৈতিক পরাধীনতার কারণগুলোর মধ্যে এগুলোও আছে। সেটাও আমাদের চ্যালেঞ্জ।
সীমান্ত রক্ষার জন্য যেমন সব ধরনের সামরিক ব্যবস্থা করা জরুরি, তেমনই শিল্পনীতি, শিল্পের পরিমণ্ডল, শিল্প দিয়ে বাজার ধরার মেধা ও বুদ্ধি নিয়েও বৈপ্লবিক আপৎকালীন পদক্ষেপ প্রয়োজন। আমাদের বাজার যদি আমরা নিজেদের জিনিস দিয়ে চাঙ্গা রাখতে না পারি, তা হলে অর্থনৈতিক যুদ্ধ আমাদের দশ গুণ কাবু করে ফেলছে এবং ফেলবে।
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ফরেন ট্রেড