2020 Kolkata International Book Fair

বই কেনা মানেই কি বই পড়া?

পরবর্তী কালে অবশ্য ডিজিটাল দুনিয়ার আবর্তে বিশ্বজনতার পড়ার স্টাইলটাও সম্পৃক্ত হয়েছে প্রযুক্তির সঙ্গে।

Advertisement

অতনু বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:০১
Share:

চুয়াল্লিশতম কলকাতা বইমেলার হইচই, স্টল, রোশনাই, সাংস্কৃতিক আবহ, ভিড়। কিন্তু ঘাড় গুঁজে মোবাইলে মগ্ন এই সমাজ কতটুকু পড়ে সাহিত্য, দর্শন, সমাজ-বিজ্ঞান? অবশ্য যাঁরা মনে করেন আন্তর্জাল, সোশ্যাল মিডিয়া, কিংবা মোবাইল ফোনই আমাদের পাঠাভ্যাস ধ্বংসের জন্যে দায়ী, তাঁরা বোধ হয় পুরোটা ঠিক ভাবছেন না। আন্তর্জালের দুনিয়ায় আত্মসমর্পণের আগে থেকেই বইয়ের সঙ্গে আমাদের আড়ি একেবারে পাকা। ১৯৯১-তে নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার অধ্যাপক মিচেল স্টিফেন্‌স একটি প্রবন্ধ লেখেন ‘লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস’ ম্যাগাজিনে। ‘দ্য ডেথ অব রিডিং’ শিরোনামে। আলোচনাটা মূলত মার্কিন সমাজের প্রেক্ষিতে হলেও, পাঠাভ্যাসের মৃত্যুর সেই অন্ধতামস সমান ভাবে গ্রাস করেছে আমাদের জীবন-প্রবাহকেও। টিভি এবং অন্যান্য বিনোদন কী ভাবে আমাদের পড়ার অভ্যাসে ফাটল ধরিয়েছে, তারই বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন স্টিফেন্‌স।

Advertisement

পরবর্তী কালে অবশ্য ডিজিটাল দুনিয়ার আবর্তে বিশ্বজনতার পড়ার স্টাইলটাও সম্পৃক্ত হয়েছে প্রযুক্তির সঙ্গে। ‘প্রোজেক্ট গুটেনবার্গ’-এর মধ্য দিয়ে এসেছে ই-বুক, ১৯৭১-এ। এ যেন স্তানিস্ল লেম-এর ১৯৬১-র কল্পবিজ্ঞান ‘রিটার্ন ফ্রম দ্য স্টারস’-এর বাস্তবায়ন। সে গল্পে কোনও বই-ই ছাপা হয়নি অর্ধ শতাব্দী। বুকস্টোর আছে, নেই বই হাতে নেওয়ার মজা। বই সেখানে ক্রিস্টালের দানা। স্পর্শ করলেই পাতাগুলো পর পর সরতে থাকে। প্রতিটি বইয়ের থাকে একটাই মাস্টারকপি ‘ক্রিস্টোম্যাট্রিক্স’। সেখান থেকেই ‘কপি’ করে দেওয়া হয় ক্রিস্টাল দানাতে। অফুরান তার জোগান। যা-ই হোক, বেশ কিছু দিন ভাল চলার পরে ব্রিটেন বা আমেরিকার মতো দেশে ই-বুকের বিক্রি কমেছে গত কয়েক বছরে। ই-বই আজ আর ছাপানো বইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, সহযাত্রী।

বই অবশ্য এখনও বিক্রি হয়। বইপাড়ায়, বুকস্টোরে, অনলাইনে, বইমেলায়, দিল্লিতে, কলকাতায়, ঢাকায়, ফ্র্যাঙ্কফুর্টে, লন্ডনে। ২০১৬’য় যখন ন’বছর পর হ্যারি পটারের বই বার হয়, শয়ে শয়ে মানুষ মাঝরাতে লাইন দিয়ে থাকেন বইটি কেনার জন্যে। কিন্তু বই ‘কেনা’ মানেই কি ‘পড়া’? স্টিফেন হকিং-এর ১৯৮৮ সালের বই ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ গোটা পৃথিবী জুড়ে হয়েছে ‘নাম্বার ওয়ান বেস্টসেলার’। ৩৫টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে, বিক্রি হয়েছে এক কোটির বেশি কপি। আবার এই বইটিকেই বলা হয় ‘সর্ব কালের সবচেয়ে না-পড়া বই’। তা-ই হয়তো পাঠকেরা গড়ে কতটা অংশ পড়ে একটা বই পড়া ছেড়ে দেন তা মাপতে ২০১৪-য় যে মজার গাণিতিক পদ্ধতির প্রবর্তন করেন মার্কিন গণিতবিদ জর্ডন এলেনবার্গ, তার নাম ‘হকিং সূচক’ দিতে দ্বিধা করেন না তিনি। ‘ব্রিফ হিস্ট্রি’-র হকিং সূচক ৬.৬%। অর্থাৎ পাঠকেরা গড়ে পড়েছেন বইটির মাত্র পনেরো ভাগের এক ভাগ। এর চেয়েও খারাপ অবস্থা হিলারি ক্লিন্টনের ‘হার্ড চয়েসেস’ (হকিং সূচক ১.৯%) কিংবা টমাস পিকেটির ‘ক্যাপিটাল ইন দ্য টোয়ান্টি-ফার্স্ট সেঞ্চুরি’র (হকিং সূচক ২.৪%)।

Advertisement

১৯৮৫ সালে একটা মজার পরীক্ষা করেছিলেন আমেরিকান ম্যাগাজিন ‘দ্য নিউ রিপাবলিক’-এর মাইকেল কিনস্লে। ওয়াশিংটন ডিসির নামকরা বুকস্টোরে ঢুকে শহর জুড়ে আলোচনার বিষয়বস্তু এমনই ৭০টি বইয়ের প্রত্যেকটির প্রায় তিন-চতুর্থাংশ পৃষ্ঠার পরে একটা করে চিরকুট গুঁজে রাখেন কিনস্লে। তাতে লেখা, চিরকুট পেয়ে প্রকাশককে ফোন করলেই পাওয়া যাবে ৫ ডলার। টাকাটা তখনকার তুলনায় মন্দ নয়। ফোন করেননি কিন্তু কেউই। কিনস্লে লিখছেন, “ভাগ্যক্রমে বই িবক্রেতাদের সমৃদ্ধি নির্ভর করে বই কেনার উপরে, বাস্তবে বই কতটা পড়া হল তার উপর নয়।” আবার দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বুদ্ধদেব বসুর গল্পে দেখি ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ হঠাৎ ধনী-হয়ে-ওঠা লোকজনের বাড়ির সৌন্দর্য-বৃদ্ধির আসবাব মাত্র।

তবু, পড়ার অভ্যাস বাড়ানোর মরিয়া প্রচেষ্টা চলে। ২০১৫ সালে এক অভিনব ব্যবস্থা নেয় রোমানিয়ার শহর ক্লুজ-নাপোকা। বাসে-ট্রামে চলাফেরার সময় কোনও বই পড়লেই ভাড়া মকুব। আবার সম্প্রতি খবরে এসেছে মাদুরাইয়ের সাদামাটা চুল-কাটার দোকানের ৮০০ বইয়ের সংগ্রহ। সেখানে কোনও বই পড়ে মতামত দিলেই ৩০% ছাড়।

বইমেলার বিক্রির হিসেবটা তাই প্রকাশকের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু পাঠাভ্যাসের নির্দেশক নয়। ক’বছর আগেও ট্রেনে বা প্লেনে, এমনকি মেট্রোতেও, প্রচুর সহযাত্রীকে দেখতাম বই পড়তে। অভ্যাসটা বদলেছে, মাথা নিচু করে মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রেখে পথ চলাই আজকের দস্তুর। বইমেলার আলো, কোলাহল, সেমিনার, ভিড় দেখার ভিড়, খাবারের গন্ধ, রাশিয়া, এবং বই, সব ছাড়িয়ে বই-পড়ার সার্বিক ক্লান্তিকর অবক্ষয়ের হতাশার ছবিটা কোথাও যেন মূর্ত হয়ে ওঠে। ‘ব্রিফ হিস্ট্রি’ আর ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’, ‘পুয়োর ইকোনমিক্স’ আর ‘ব্ল্যাক সোয়ান’ পাশাপাশি শোভা পায় বুকশেল্ফে। বড় যত্নে।

একটা বই টেনে নিয়ে ওল্টানো যাক পৃষ্ঠাগুলো। কে জানে কোন পাতায় সযত্নে লুকোনো আছে গোপন চিরকুট!

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট।

মতামত ব্যক্তিগত

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement