সব রকম পণ্যের সরবরাহের ক্ষেত্রে চিনের একচেটিয়া আধিপত্য নেই। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
কথিত আছে, মানবচরিত্র সম্পর্কে ইংরেজ কবি জন ডান একদা বলেছিলেন, কোনও মানুষই স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো নয়। অর্থনীতির ক্ষেত্রেও একই ভাবে বলা যায়, কোনও অর্থনীতিই বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো টিকে থাকতে পারে না। অর্থাৎ কিছুতেই তাকে ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ’ বলা যায় না। সে দিক থেকে দেখলে, স্বনির্ভরতা (অথবা ‘আত্মনির্ভর ভারত’)-র অর্থ ‘স্বয়ংসম্পূর্ণতা’ হতে পারে না। স্বনির্ভরতা সম্পর্কে জওহরলাল নেহরুর প্রচেষ্টা যখন তার সর্বোচ্চ সীমায় অবস্থান করছিল, তখনও ভারতকে যন্ত্রপাতি, পুঁজি থেকে শুরু করে প্রযুক্তি ও যুদ্ধাস্ত্র, এমনকি, কলম পর্যন্ত আমদানি করতে হত। দেশজ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় স্থবিরতা দেখা দিলে আমদানি-নির্ভরতা বৃদ্ধি পায়। এমনকি, আজকেও দেশের সব থেকে ‘স্বনির্ভর’ প্রতিরক্ষা এবং মহাকাশ গবেষণার প্রকল্প লক্ষণীয় ভাবে আমদানির উপর নির্ভরশীল। তেজস যুদ্ধবিমানের ইঞ্জিন জেনারেল ইলেক্ট্রিকের মতো আমেরিকান বহুজাতিক সংস্থার বানানো। ‘ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন’ (ইসরো)-এর উপগ্রহ সংক্রান্ত আমদানি-নির্ভরতা ৫০-৫৫ শতাংশ। দেশের পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন কেন্দ্রগুলি অতিমাত্রায় আমদানিকৃত ইউরেনিয়ামের উপরে ভর করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর যদি খনিজ তেলের কথা ওঠে দেখা যাবে যে, সেখানে আমদানির পরিমাণ প্রায় ৮৫ শতাংশ।
নীতিগত ভাবে ‘আত্মনির্ভরতা’ বিষয়টির যথাযথ যত্নের সঙ্গে বিশদে ব্যাখ্যার বা তার সংজ্ঞা নির্ধারণ করার অবকাশ থেকেই যায়। এই কাজটি সরকারের মন্ত্রীরাই করবেন, এমন আশা করা ভুল হবে। এর মানে কি এই যে, কৌশলগত দিক থেকে আমদানি-নির্ভরতা কমিয়ে আনা অথবা অন্য ভাবে বললে, এই মুহূর্তে রাশিয়ার উপর যে সব অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তেমন ঝুঁকিকে যথাসাধ্য কমিয়ে আনা? উত্তরে বলা যায়, পরিস্থিতি অনুযায়ী এই সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা নির্ধারিত হবে। এক দিক থেকে দেখলে, ১৯৬০-এর দশকে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন এক দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতিতে গম সরবরাহ কমিয়ে ভারতকে প্যাঁচে ফেলতে চেয়েছিলেন, তখন সবুজ বিপ্লব দেশকে সেই দশা থেকে মুক্ত করে।
অন্য দিকে, ইলেক্ট্রনিক চিপ-ই অথবা সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের প্যানেলের মতো স্বনির্ভর প্রকল্প কার্যত কিন্তু সরবরাহ অর্থনীতির আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলের সঙ্গে দেশের দৃঢ়তর সংযোগের কথাই বলে। সে দিক থেকে দেখলে দেশজ উৎপাদন কেন্দ্রগুলির দুর্বলতা এবং বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে আমদানির উপর নির্ভরতার বিষয়টিই প্রকট হয়ে ওঠে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, পাকিস্তান চিনের সহায়তায় তাদের জেএফ-১৭ যুদ্ধবিমান নির্মাণ করে। সেই সূত্র ধরে কি ইসলামাবাদকে বেজিংয়ের উপরে কম বা বেশি নির্ভরশীল বলা যায়? এবং প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত উৎপাদনের ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতার বিষয়টিকে কি যথাযথ বলা সম্ভব, যখন সরবরাহ অত্যন্ত ধীর গতিসম্পন্ন? বাণিজ্য-ঘটিত আপস সর্বদাই এবং সর্বত্রই বিদ্যমান থাকে।
এ কথাও সত্য যে, ভারতের পণ্য উৎপাদনগত কর্মক্ষমতা সমস্যামুক্ত নয়। ফাইল চিত্র
এক পুরনো কবিতায় বলা হয়েছিল, কী ভাবে একটিমাত্র পেরেকের অভাবে একটি গোটা রাজ্য হারাতে হয়েছিল। কারণ, ঘোড়ার খুরে নাল পরাতে গেলে পেরেকের প্রয়োজন। সেই ঘোড়ার পিঠে চেপেই নাইটরা যুদ্ধ করতে যেতেন। পেরেক না মেলায় অশ্বারোহণ অসম্ভব হয়ে পড়ে এবং অনিবার্য ভাবে যুদ্ধে রাজ্যটি পরাস্ত হয় এবং বেহাত হয়ে যায়। আজ হয়তো পেরেক জোগাড় করা তেমন দুরূহ কাজ নয়। কিন্তু ক্ষুদ্র ইলেক্ট্রনিক চিপের অভাবে মোটরগাড়ি শিল্প বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে বাধ্য। আগামী কাল যে কোবাল্ট বা লিথিয়ামের অভাবে ব্যাটারি নির্মাণে ধস নামবে না, এ কথা কে বলতে পারে? ‘ফুল ভ্যালু চেন’ বা ধারণাগত পর্যায় থেকে কোনও বস্তুকে সাকার রূপদানের যে শৃঙ্খলাবদ্ধ পদ্ধতি, তার ওঠানামার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়া অসম্ভব। বাণিজ্য ক্ষেত্রে অংশীদারিত্বের উপর নির্ভরশীলতা আধুনিক অর্থনীতির অন্যতম অঙ্গ বিশেষ।
এ বিষয়ে আর একটি সম্ভাব্য যুক্তি হল, বৈরী ভাবাপন্ন চিনের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে ভারতের জন্য অন্যত্র সরবরাহকারীর অনুসন্ধান। সব রকম পণ্যের সরবরাহের ক্ষেত্রে চিনের একচেটিয়া আধিপত্য নেই। কিন্তু বলা যায় যে, সরবরাহের পরিধিতে চিন সব থেকে বড় প্রতিযোগী মনোভাবাপন্ন। পণ্য-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তেল-সমৃদ্ধ নয়, এমন দেশগুলির তুলনায় ভারতের উদ্বৃত্তের পরিমাণ বেশি। যখন কেউ পণ্য ও পরিষেবা সংক্রান্ত বাণিজ্যকে বৃহত্তর পরিসরে দেখতে চাইবেন, তখন দেখা যাবে দেশের সাম্প্রতিক ঘাটতি কিন্তু নিরাপদ সীমাতেই রয়েছে। ঘাটতি পূরণে মোট পুঁজির প্রবাহ কিন্তু যথেষ্ট বেশিই। ভারতের শক্তি উৎপাদন সংক্রান্ত অভাব রয়েছে এবং সেই সঙ্গে রয়েছে চিনের প্রতি নির্ভরতার সমস্যা। কিন্তু বৃহত্তর বাণিজ্য সংক্রান্ত কোনও সমস্যায় এ দেশ ভোগে না।
এ কথাও সত্য যে, ভারতের পণ্য উৎপাদনগত কর্মক্ষমতা সমস্যামুক্ত নয়। এবং দেশজ সামর্থ্যকে উন্নীত করার ক্ষেত্রেও এ দেশের সমস্যা রয়েছে। এখানেই ‘প্রোডাক্টিভিটি-লিঙ্কড ইনসেন্টিভস’ (পিএলআই) প্রকল্পের (যে প্রকল্প দ্বারা বিদেশি বিনিয়োগের দ্বারা দেশের ভিতরে কর্মী নিয়োগ এবং একই সঙ্গে দেশজ তথা আঞ্চলিক উৎপাদনের দ্বারা অর্থনীতির ক্ষুদ্রতম স্তরে কর্মনিযুক্তির বিষয়ে ভারত সকার উৎসাহ দেয়) প্রসঙ্গটি আসে। যদি প্রতি বছর ৫০ হাজার কোটি টাকা দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদন-সহায়ক পরিস্থিতি তৈরির কাজে পাঁচ বছর ব্যয় করা যায়, তা হলে সেই অঙ্কটিকে কেউ ‘বিপুল’ বলে দেগে দেবেন না। কিন্তু এর বিপদ অন্যত্র। বিষয়টিকে যথাযথ প্রমাণ করতে আঞ্চলিক স্তরে যে গুণগত মানের সংযুক্তিকরণ প্রয়োজন, তার পরিমাণ ভর্তুকির তুলনায় নগণ্য। আমদানি সংক্রান্ত সুবিধাভোগী সম্প্রদায় যে পরিবর্ধিত ভর্তুকি-সময়সীমার সুফল ভোগ করে, যারা করের ক্ষেত্রে ছাড় পায়, তারা বাণিজ্যের উদারীকরণের প্রক্রিয়াটিকে উল্টে দিতে পারে। এই সব বিপদগুলির একটি বা বেশ কয়েকটি ইতিমধ্যেই কিন্তু দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।
বৃহত্তর অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে ঝুঁকিটি থেকে যায়, সেটি এই যে, এ ধরনের সমালোচনা নীচের মহল থেকে শুরু করে উচ্চমূল্যের যাবতীয় সরবরাহকে জনসমক্ষে নিয়ে আসবে এবং এর ফলে অনিবার্য ভাবে দেখা দেবে প্রতিযোগিতাহীন এক পরিস্থিতি। যা কার্যত স্বনির্ভরতার একেবারে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে। কিছু দিন আগে এমন পরিস্থিতি দেখা গিয়েছিল এবং তা আবার দেখা দিতে পারে। পিএলআই-এর বিপক্ষে আর একটি কথা বলা যায়। তা এই যে, এই প্রকল্প মূলধন-নিবিড় ক্ষেত্রগুলিকেই গুরুত্ব দেয়, যার মধ্যে আবার দ্রুত অপ্রচলিত হয়ে পড়ার জটিলতা ভাল রকম রয়েছে। ফলে প্রযুক্তি এবং যন্ত্রপাতি, উভয়ের পুনর্নবীকরণের প্রয়োজনীয়তা সর্বদা থেকে যায়। এমন পরিস্থিতি কি কাঙ্ক্ষিত? ইতিমধ্যে শ্রমনিবিড় ক্ষেত্রগুলিতে বৃহত্তর হারে এবং সুপরিকল্পিত ক্ষেত্রগুলিতে কর্মনিযুক্তির বিষয়টি ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। এই দুই সমস্যার মধ্যে (বাণিজ্য-ঘাটতি ও কর্মনিযুক্তিহীনতা) ভারতের কাছে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হল দ্বিতীয়টি। কৌশলগত স্বনির্ভরতা সংক্রান্ত বিষয়ে পিএলআই-এর সন্ধানকার্যে সম্ভব-অসম্ভবের প্রশ্নটি যাতে হারিয়ে না যায়, সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে।