কোনও এক অর্থবর্ষে সরকারের মোট আয় কত টাকা হল, আর ব্যয়ই বা কত, তার বিবৃতির নামই বাজেট। প্রতি বছর সংসদে বাজেট পেশ করা ভারতে সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা। সংবিধানের ১১২তম অনুচ্ছেদ অনুসারে, প্রতি বছর কেন্দ্রীয় সরকারকে সংসদে জানাতে হবে, আসন্ন অর্থবর্ষে সরকার রাজস্ব ও রাজস্ববহির্ভূত খাতে মোট কত টাকা আয় করার প্রত্যাশা করছে, এবং অর্থবর্ষে সম্ভাব্য খরচই বা কত। তার সঙ্গে জানাতে হবে, শেষ হতে চলা অর্থবর্ষের আয়-ব্যয়ের সংশোধিত অনুমানের অঙ্ক, এবং তার আগের অর্থবর্ষের প্রকৃত আয় এবং ব্যয়।
অর্থাৎ, গত পয়লা ফেব্রুয়ারি অরুণ জেটলি সংসদে যে বাজেট পেশ করলেন, তাতে যে হিসাবগুলো ছিল, তা এই রকম— ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষের আয় এবং ব্যয়ের আনুমানিক অঙ্ক, ২০১৭-১৮ সালের আয়-ব্যয়ের সংশোধিত অনুমান এবং ২০১৬-১৭ সালের আয়-ব্যয়ের প্রকৃত অঙ্ক। মানে, ২০১৮-১৯ সালের বাজেট বিশ্লেষণ করতে বসে আমরা আসলে যে সংখ্যাগুলো নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি, সেগুলো সরকারের অনুমান— সরকার যে আয় প্রত্যাশা করে, এবং যে ব্যয় করবে বলে ভাবে, তার হিসাব। সত্যিই সেই আয়-ব্যয়ের অঙ্ক কোথায় দাঁড়াল, তার প্রকৃত হিসাব জানা যাবে ২০২০-২১ সালের বাজেট পেশ হওয়ার পর।
তা হলে কি ২০১৮-১৯ সালের বাজেট বিশ্লেষণ করার জন্য ২০২০-২১ অবধি অপেক্ষা করতে হবে? একদম নয়। এই বাজেটে যে কর প্রস্তাব রয়েছে, তা এ বছরের পয়লা এপ্রিল থেকেই চালু হয়ে যাবে। অন্য দিকে, বাজেটে বিভিন্ন প্রকল্পে যে খরচের প্রস্তাব রয়েছে, তা-ও এই বছরই করা হবে। কাজেই, অর্থনীতির ওপর, এমন মানুষের ওপর, বাজেটের কী প্রভাব পড়তে চলেছে, তা বোঝার জন্য চলতি বছরের বাজেট বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু, একই রকম জরুরি প্রকৃত সংখ্যাগুলির বিশ্লেষণও— সরকার যা বলছে, সেটাই করছে কি না, বুঝতে হবে তো! এই লেখায় আমরা একটামাত্র পরিসংখ্যানের বিশ্লেষণ করব— ঘাটতির পরিমাণ। এবং, তার মাধ্যমেই এই বাজেটটিকে বোঝার চেষ্টা করব।
বাজেটের পর যে আলোচনা হয়, তার একেবারে কেন্দ্রে থাকে রাজকোষ ঘাটতি আর রাজস্ব ঘাটতি। রাজকোষ ঘাটতি কাকে বলে? সরকারের আয় আর ব্যয়ের মধ্যে যে ফারাক, সেটাই রাজকোষ ঘাটতি। এই ঘাটতি পূরণ করা হয় ধার করে। রাজকোষ ঘাটতি বাড়লে সরকারের ঋণের পরিমাণও বাড়ে। সরকার যদি বেশি ধার করে, তবে বেসরকারি ক্ষেত্রের জন্য ধার পাওয়ার সুযোগ কমে। আবার, বেসরকারি ক্ষেত্র মোট যত টাকা ঋণ চায়, ঋণ দেওয়ার জন্য তত টাকা যদি বাজারে না থাকে, তবে সুদের হার, অর্থাৎ ধার নেওয়ার খরচ, বাড়তে থাকে। সুদের হার বাড়লে বিনিয়োগের পরিমাণ কমতে পারে। তাতে জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হার ধাক্কা খায়। তাই রাজকোষ ঘাটতি নিয়ে এত আলোচনা।
সরকার রাজস্ব খাতে যে আয় করে, আর যতখানি ব্যয় করে, তার ফারাকই হল রাজস্ব ঘাটতি। রাজস্ব খাতের ব্যয়ের বেশির ভাগটাই যায় চলতি অর্থবর্ষের মেয়াদের মধ্যে বিভিন্ন কনজাম্পশন এক্সপেন্ডিচার বা ভোগব্যয় মেটানোর কাজে, যেমন কর্মীদের বেতন দেওয়া, সুদ মেটানো, পেনশন, ভরতুকি ইত্যাদি। শূন্য রাজস্ব ঘাটতি মানে, সরকার ধার করে এই খরচগুলো করতে পারবে না।
অর্থনীতিতে যেহেতু ঘাটতি বিষয়টি এতখানি গুরুত্বপূর্ণ, তাই সরকার যাতে ঘাটতির পরিমাণ একটি নির্দিষ্ট হারে বেঁধে রাখে, তা নিশ্চিত করার জন্য ২০০৩ সালে ভারত সরকার ‘ফিসক্যাল রেসপন্সিবিলিটি অ্যান্ড বাজেট ম্যানেজমেন্ট (এফআরবিএম)’ আইন তৈরি করে। এই আইন অনুসারে, রাজস্ব খাতে কোনও ঘাটতি থাকা চলবে না, এবং রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি-র তিন শতাংশের বেশি হবে না। প্রকৃত ছবিটা কিন্তু অন্য রকম। সরকার কখনও শূন্য রাজস্ব ঘাটতিতে পৌঁছতে পারেনি; রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণও তিন শতাংশে নামিয়ে আনা যায়নি। ২০১৮-১৯ সালের বাজেট অনুমান হল, রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ হবে ৩.৩ শতাংশ, অর্থাৎ লক্ষ্যসীমার চেয়ে জিডিপি-র ০.৩ শতাংশ বেশি।
২০১৮-১৯ সালের বাজেটে ফিসক্যাল কারেকশন বা রাজকোষ ঘাটতি কমিয়ে আনার জন্য একটি সংশোধিত পথের কথা বলা হয়েছে। এই পথে চললে ২০১৮-১৯ সালে নয়, জিডিপি-র তিন শতাংশ রাজকোষ ঘাটতির লক্ষ্যসীমায় পৌঁছনো যাবে ২০২০-২১ সালে। রাজস্ব ঘাটতির ক্ষেত্রে অবশ্য সে-বছরও লক্ষ্যসীমা অধরা থাকবে— ২০২০-২১ সালে এই ঘাটতির পরিমাণ হবে জিডিপি-র ১.৬ শতাংশ। এই অর্থবর্ষে ঋণের পরিমাণ জিডিপি-র ৪৮.৮ শতাংশ। ২০২০-২১ সালে তা কমে ৪৪.৬ শতাংশে দাঁড়াবে বলে আশা।
এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সরকার এফআরবিএম আইনে একটি সংশোধনী প্রস্তাব করেছে। তার বক্তব্য, সরকার একই সঙ্গে ঋণ ও রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ কমাতে চেষ্টা করবে, কিন্তু রাজস্ব ঘাটতির ক্ষেত্রে কোনও বাঁধাধরা লক্ষ্যসীমা থাকবে না। প্রশ্ন হল, রাজস্ব ঘাটতি যদি এফআরবিএম আইনের এক্তিয়ারের বাইরে চলে যায়, তা হলেও কি সরকারের আর্থিক নীতির দায়বদ্ধতা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এই ঘাটতির গুরুত্বকে অস্বীকার করা যাবে?
এই প্রশ্নের একমাত্র, এবং নির্দ্বিধ উত্তর হল, না। বরং, রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ কমানোর দিকে সরকারের আরও বেশি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। তা হলেই মূলধনী খাতে বিনিয়োগের জন্য হাতে টাকা থাকবে। সরকারি ব্যয়ের বিষয়ে যদি সাবধান হতেই হয়, তবে রাজস্ব ঘাটতি কমানোর দিকে আরও অনেক গুরুত্ব দেওয়াই বিধেয়। আরও একটি কথা মাথায় রাখা প্রয়োজন— এখন চলতি খাতে বেশির ভাগ খরচ, যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জল সরবরাহ ও নিকাশির মতো খাতের খরচের বেশির ভাগই সাংবিধানিক ভাবে রাজ্য সরকারের দায়িত্ব। তা হলে কেন্দ্রীয় সরকারের রাজস্ব খাতে ঘাটতি বাড়ে কী করে?
ধাঁধাটির সমাধান করা প্রয়োজন। তার জন্য সরকারকে নিজের আর্থিক দায়িত্ব বিষয়ে স্বচ্ছ হতে হবে, এবং তা নতুন করে গুছিয়ে নিতে হবে। তার বদলে দায়িত্বটিকেই ঝেড়ে ফেলা মানে মাথাব্যথার চিকিৎসাবাবদ মাথাটিকেই কেটে ফেলা।
দিল্লির ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক ফিন্যান্স অ্যান্ড পলিসি-তে অর্থনীতির শিক্ষক