National news

প্রধানমন্ত্রীও নিজের মতো করে ‘সাজিয়ে’ নেবেন সত্যটাকে?

গণতন্ত্রের সৌন্দর্য এখানেই। মতানৈক্য বা মতবিরোধ থাকবেই। কিন্তু সে সব উত্তীর্ণ হওয়ার প্রয়াসও নিরন্তর বহাল থাকবে, আলাপে-আলোচনায় সমঝোতা সূত্রে বা মতান্তর নিরসনের সূত্রে পৌঁছনোর প্রয়াস সর্বদা জারি থাকবে।

Advertisement

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:৩০
Share:

নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।

অচলাবস্থা কাম্য নয়। দেশের সর্বোচ্চ গণতান্ত্রিক সভায় তো আরওই নয়। কিন্তু প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অবমাননাকর মন্তব্য সেই অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতিকেই অবধারিত করে তুলেছিল।

Advertisement

শাসক অবশেষে মাথা নোয়ালেন। সংসদের উচ্চকক্ষের নেতা অরুণ জেটলি বিবৃতি দিয়ে জানালেন, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের অবমাননার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর। জাতির প্রতি মনমোহন সিংহ-হামিদ আনসারিদের দায়বদ্ধতাকে যে শাসক দল শ্রদ্ধা করে, সে কথাও জেটলি স্পষ্ট উচ্চারণেই জানালেন।

বিরোধীও সুর নামালেন। শাসকের বিবৃতিকে স্বাগত জানালেন। সংসদের অচলাবস্থা নিরসনে পূর্ণ সহযোগিতার পথে এগিয়ে গেলেন।

Advertisement

সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

গণতন্ত্রের সৌন্দর্য এখানেই। মতানৈক্য বা মতবিরোধ থাকবেই। কিন্তু সে সব উত্তীর্ণ হওয়ার প্রয়াসও নিরন্তর বহাল থাকবে, আলাপে-আলোচনায় সমঝোতা সূত্রে বা মতান্তর নিরসনের সূত্রে পৌঁছনোর প্রয়াস সর্বদা জারি থাকবে। কারণ যাবতীয় মতান্তর বা মতানৈক্যও অভিন্ন এক লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্যই। জাতির অগ্রগতি, সমৃদ্ধি, শ্রীবৃদ্ধিই লক্ষ্য যে কোনও দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দলের। কোন পথে লক্ষ্যে পৌঁছতে হবে, মতান্তর মূলত তা নিয়েই হয়ে থাকে। তাই তর্কে-বিতণ্ডায় পথ হারিয়ে ফেলা নয়, চর্চায়-আলোচনায় পথ খুঁজে বার করার উপরেই দৃষ্টি নিবদ্ধ হওয়া উচিত।

বিসম্বাদ এড়িয়ে এ বারও দু’পক্ষই সংসদ সচল রাখার পথে পা বাড়াল, এ নিশ্চয়ই ইতিবাচক এক ভঙ্গি। কিন্তু নেতির আবহ থেকে একটা প্রশ্নও উঁকি দিচ্ছে নিরন্তর, অস্বস্তিটা তাই কাটতে চাইছে না। সংসদের অন্দরে এ বার যে বিষয় নিয়ে বিবাদে জড়িয়েছিল দু’পক্ষ, তার সঙ্গে জাতির অগ্রগতির কোনও সম্পর্ক কিন্তু নেই। সংসদীয় এবং রাজনৈতিক সৌজন্যের অবিশ্বাস্য উল্লঙ্ঘন ঘটিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এবং প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপতি দেশের প্রতি দায়বদ্ধ নন এবং তাঁরা বহিঃশক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের অংশীদার— এমন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তিনি। একটি অঙ্গরাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারাভিযান থেকে এমন গুরুতর অভিযোগ নরেন্দ্র মোদী জাতির স্বার্থে করেছিলেন, নাকি নিছক দলীয় স্বার্থে, সে নিয়ে বিতর্ক নিষ্প্রয়োজন। মোদীর সমর্থক-বিরোধী নির্বিশেষে সকলের কাছেই খুব স্পষ্ট ওই সব মন্তব্যের উদ্দেশ্য। নেতিবাচক প্রশ্নটা সেখানেই উঁকি দেয়। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বা প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপতির অবমাননা নরেন্দ্র মোদী করতে চাননি, এ কথা না হয় মেনে নেওয়া গেল। নিজের পদকে কি অবমাননার হাত থেকে বাঁচাতে পারলেন মোদী? নির্বাচনী ময়দানে প্রতিপক্ষকে পিছনে ফেলার তাগিদে আদ্যন্ত ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে নির্বাচন মেটার পর সে অবস্থান থেকে পিছিয়ে আসা কি প্রধানমন্ত্রীকে শোভা পায়? মোদী নিজে কোনও বিবৃতি দেননি, বিবৃতি দিয়েছেন অরুণ জেটলি। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর অনুমোদন ছাড়াই ওই বিবৃতি রাজ্যসভায় উপস্থাপিত হয়েছে, এমন তত্ত্ব আশা করা যায় কেউ খাড়া করবেন না। দৃশ্যপটটা কি খুব দৃষ্টিনন্দন রইল সে ক্ষেত্রে?

আরও পড়ুন: মনমোহনের দায়বদ্ধতা নিয়ে কোনও সংশয় নেই, আমরা শ্রদ্ধাশীল: জেটলি

নির্বাচনী প্রচার মঞ্চ থেকে নরেন্দ্র মোদীর অভিযোগ ছিল— পাকিস্তান তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। ষড়যন্ত্র তত্ত্বের সঙ্গে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল মনমোহন সিংহ এবং হামিদ আনসারির নাম। তাঁদের দেশভক্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেওয়া হয়েছিল। পরে জানা গেল, মনমোহন সিংহ বা হামিদ আনসারির দেশভক্তি বা দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কোনও সংশয় নেই। প্রধানমন্ত্রী বরং তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাশীলই। প্রশ্ন হল, এই কথাগুলো পরে স্পষ্ট করা হল কেন? বিতর্কের আগুনটা যখন উস্কে দেওয়া হয়েছিল, তখন এই শ্রদ্ধাশীলতার কথা উহ্য রাখা হয়েছিল কেন? শব্দচয়নের কারসাজিতে জনসাধারণের ভাবাবেগ নিয়ে যে ভাবে খেললেন প্রধানমন্ত্রী, তা কি তাঁকে শোভা পায়?

‘পোস্ট-ট্রুথ’— আজকের যুগটাকে এই নামেই ডাকছেন অনেকে। সত্যের সংজ্ঞাটা কেমন যেন বদলে গিয়েছে এ যুগে। নির্মোহ ভঙ্গিতে সত্যকে খুঁজে নেওয়ার প্রয়াস অন্তর্হিত অনেকটাই। যা শুনতে ভাল লাগে, যা বিশ্বাস করতে ভালবাসি, যা আমার পক্ষে সুবিধাজনক, তাকেই ‘সত্য’ হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতা আজ। তাই ‘সত্য’কে নিজের মনের মতোন করে গড়ে-পিটে, সাজিয়ে-গুছিয়ে নেওয়া হচ্ছে এ যুগে।

এ প্রবণতা যে বিপজ্জনক, সে নিয়ে সংশয় থাকা উচিত নয়। বিকৃত বাস্তবকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা কখনওই কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। আমজনতা থেকে সর্বোচ্চ প্রশাসক, সকলেরই বোঝা দরকার এ কথা। কিন্তু বোঝা-না বোঝার প্রশ্নে আমজনতা আর সর্বোচ্চ প্রশাসকের মধ্যে বিস্তর ফারাকও রয়েছে। কোনও এক সাধারণ নাগরিক বিকৃত বাস্তবকে সত্য হিসেবে গ্রহণ করলে তার ফল খুব সুদূরপ্রসারী হয় না। কিন্তু দেশের প্রধানমন্ত্রী যদি নিজের মনের মতোন করে সাজিয়ে নিতে চান ‘সত্য’, তা হলে গোটা জাতিকে মারাত্মক বিভ্রান্তির দিকে ধাবিত হতে হয়।

বিভ্রান্তির নিরসন এ বারের মতো হল হয়ত। সংসদও সচল হল। কিন্তু বিভ্রান্তির উপরে দাঁড়িয়ে যে কার্যসিদ্ধিটি হল, তার কী হবে? নৈতিক দংশন অনুভূত হবে না তো? অন্তঃসারশূন্যতার বোধ গ্রাস করবে না তো? নরেন্দ্র মোদী যদি পোস্ট-ট্রুথ যুগের বাসিন্দা না হয়ে উঠে থাকেন এখনও, তা হলে এই দুটো প্রশ্ন তাঁর জন্যও রইল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement