ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে রাষ্ট্র কতটা ছড়ি ঘুরাইতে পারে? এই একটি প্রশ্ন যে এ দেশে কত অশান্তির সৃষ্টি করিয়াছে, তাহার ইয়ত্তা নাই। ইংরাজ প্রভুরা ভারত শাসনের দুই শতক ধরিয়া এই প্রশ্নে নাজেহাল হইয়াছেন। দেশীয় সমাজ-সংস্কারকরাও এক শত রকম দার্শনিক ও সামাজিক বাধার সম্মুখীন হইয়াছেন। এখন সত্তর বৎসরের স্বাধীন দেশেও বিচারবিভাগ আবার সেই প্রশ্নের সামনে হাবুডুবু খাইতেছে। হাবুডুবুই বটে। সাম্প্রতিক কালের ‘দহিহান্ডি’র দৃষ্টান্তই তাহা প্রমাণ করে। জন্মাষ্টমীর সময়ে পশ্চিম ও মধ্য ভারত জুড়িয়া দহিহান্ডি নামক যে ঐতিহ্যবাহী উৎসবটি পালিত হয়, গত কয়েক বৎসর যাবৎ সেই উৎসবে নিষেধাজ্ঞা জারি করিবার আবেদন এই আদালত হইতে ওই আদালতে ঘুরিতেছে, বিভিন্ন আদালতের সিদ্ধান্তের মধ্যে প্রভেদও ঘটিতেছে। উৎসবটি যেহেতু যথেষ্ট বিপজ্জনক, প্রাণহানির আশঙ্কা পদে পদে, আবার উৎসবের মূল বক্তব্য তুলিয়া ধরিতে যেহেতু অল্পবয়সিদেরই অংশগ্রহণকারী হিসাবে বাছিয়া লইয়া বিপদের মুখে তাহাদের ঠেলিয়া দেওয়া হয়, নিষেধাজ্ঞা দাবি করিয়া যাঁহারা মামলা ঠুকিয়াছিলেন, তাঁহাদের যুক্তি বুঝিতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু উল্টা দিকের যুক্তিটিও ফেলনা নহে। যে সমাজ জানিয়া বুঝিয়া দীর্ঘ কাল এই বিপজ্জনক উৎসব পালন করিয়া আসিতেছে, তাহার সমালোচনা বা ভর্ৎসনা চলিতে পারে, কিন্তু আইন বানাইয়া তাহাকে প্রতিরোধ করা যায় কি? তাহা কি এক ধরনের রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদ নয়? জাল্লিকাট্টুর সময়েও এই প্রশ্নে বিচারবিভাগ জেরবার হইয়াছিল। দহিহান্ডিকে কেন্দ্র করিয়াও বিভ্রম-আবর্তে ঘুরিতেছিল মুম্বই হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট।
মুম্বই হাইকোর্টের প্রাথমিক মত ছিল, ১৮ বৎসরের কম বয়সিদের ইহাতে অংশ লইতে দেওয়া উচিত নয়, এবং দহির ভাণ্ড পাড়িবার জন্য যে উচ্চ মানব-পিরামিড তৈরি হয়, তাহার উচ্চতাও ২০ ফুটের বেশি হওয়া উচিত নয়। কিন্তু গত বৎসরের অগস্টে সুপ্রিম কোর্ট দুটি ক্ষেত্রেই নিজের ঠিক বিপরীত বক্তব্য পেশ করে, এবং বিষয়টি পুনর্বিচারের জন্য মুম্বই হাইকোর্টে পাঠায়। সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্য যথার্থত অনুধাবন করিয়া চলতি অগস্টে মুম্বই হাইকোর্টের নূতন সিদ্ধান্ত দাঁড়ায়: ১৪ বৎসরের কম বালকদের অংশগ্রহণ চলিবে না, কিন্তু পিরামিডের উচ্চতা বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপের দরকার নাই। কত উঁচু মানব-পিরামিডে অনুষ্ঠানের জাঁক বাড়ানো হইবে, তাহা অনুষ্ঠানকারী সমাজের সিদ্ধান্ত। বিপদ আছেই, কিন্তু বিপদ বুঝিয়া নিজেদেরই সাবধান হইতে হইবে। কোন পর্যায়ে নিজের দেখভাল নিজেকেই করিতে হয়, আর কোন পর্যায়ে আইন বলবৎ করিয়া সমাজের সংবিৎ ফিরাইতে হয়, তাহার মধ্যে একটি সূক্ষ্ম সীমারেখা থাকা দরকার।
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই বিবেচনা। অপ্রাপ্তবয়স্কদের বিপজ্জনক খেলার মধ্যে টানিয়া আনা এক রকমের সমস্যা, কিন্তু বিপদ সত্ত্বেও বিপজ্জনক খেলা বা অনুষ্ঠান চালাইবার সমস্যা আর এক রকমের। প্রাপ্তবয়স্কদের যদি বলপ্রয়োগ না করিয়া খেলা বা অনুষ্ঠানে শামিল করা হয়, তাহাতে আদালত আপত্তি করিতে পারে না। কিন্তু বিরাট পিরামিড তৈরি করিয়া দহিহান্ডি খেলার দুর্ঘটনার সম্ভাবনাটি অন্য রকম। তেমন দুর্ঘটনা নিশ্চয়ই আরও অনেক ক্ষেত্রেই ঘটিতে পারে, এমনকী দুর্গম তীর্থযাত্রার ক্ষেত্রেও। দেশের বহু মন্দিরে প্রত্যহ পতাকা পরিবর্তনের রেওয়াজ, মন্দিরের উচ্চতা খেয়াল রাখিলে যাহা কম বিপজ্জনক নহে। কিন্তু তাই বলিয়া আইন করিয়া তাহা বন্ধ করা যায় কি? আদালত বা আইন এমন বস্তু যাহার অপব্যবহার করিতে চাহিলে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আইন জারি সম্ভব। কিন্তু একটি সুষ্ঠু সচেতন সবল সমাজের জন্য তাহা কাম্য নয়। দেশের বিচারবিভাগ দেশের সমাজের অভিভাবক। নীতিদণ্ড লইয়া আস্ফালন করা জেঠামহাশয় নয়।