ছবি: সংগৃহীত
সাজেলার বিশিষ্ট সংস্কৃত গবেষক শ্রীরাম শিরোমণির কন্যা এবং প্রখ্যাত আইনজীবী ও প্রাক্তন সাংসদ শশাঙ্কশেখর সান্যালের জননী কালিদাসী সান্যালের বাড়িটি যেন ছিল বিপ্লবীদের নিশ্চিন্ত আশ্রয়স্থল। পুত্রবধূ ঊষারাণী সান্যালের লেখা থেকে জানা যায় যে, দেশ ও দশের কাজকে নিজের সংসারের কাজ বলেই কালিদাসী মনে করতেন। এক বার গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে আত্মগোপনের জন্য এক বিপ্লবী ছাত্র তাঁর কাছে আশ্রয় প্রার্থণা করলে তিনি তাকে নিজগৃহে অত্যন্ত সঙ্গোপনে আশ্রয় দেন। একটি চৌকির তলায় সারা দিন ছাত্রটিকে লুকিয়ে রেখে রাতে পরিবারের সকলে নিদ্রিত হলে তাকে বাইরে এনে খাওয়া ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করেন কালিদাসীদেবী। পর দিন তাঁকে এক নিরাপদ স্থানে প্রেরণের বন্দোবস্তও করেন দেশপ্রেমিক এই মহিলা। পাড়ায় কেউ অভুক্ত থাকলে নিজের খাবার এনে তাঁকে খাইয়ে দিতেন, কেউ অসুস্থ হলে অক্লান্তভাবে তার সেবা যত্ন করতেন এই মহীয়সী নারী। সুভাষচন্দ্র বসু, শরৎ বসুর মত প্রখ্যাত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কালিদাসীর আতিথ্য গ্রহণ করেছেন বিভিন্ন সময়ে।
উনিশ শতকের নারী সাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বহরমপুরের নিরুপমা দেবী। সাহিত্যমনস্ক ভট্ট পরিবারের কন্যা নিরুপমা মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে বিধবা হয়ে পিতৃগৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্নেহধন্যা নিরুপমা দেবী তাঁর ‘দেবত্র’ উপন্যাসে রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামসংস্কারের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি তুলে ধরেছিলেন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রেক্ষিতে রচিত তাঁর ‘নতুন পূজা’তে বিদেশী দ্রব্য বর্জন, দেশীয় শিল্পের উন্নতি, পুরুষের সহযোগী হিসাবে নারীর ভূমিকা প্রভৃতি সামাজিক, রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি তিনি আলোকপাত করেছিলেন। তবে শুধু সাহিত্যরচনাই নয়, দেশের মুক্তি সংগ্রামেও নিরুপমা দেবী সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। জানা যায়, ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের নজর এড়িয়ে বিপ্লবীদের নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিতে তিনি বেশ কয়েকবার সাহায্য করেছিলেন। পরিবারের অনেকেই অনুশীলন সমিতির সঙ্গে যুক্ত থাকায় তাদের বাড়িতে রাজনৈতিক কর্মীদের যথেষ্ট যাতায়াত ছিল। সেই কারণেই রাজনৈতিক সচেতনতা ছিল তাঁর মজ্জাগত।
নিরুপমা দেবীর ভাই ডা: পঞ্চানন ভট্টের স্ত্রী ছিলেন সুবর্ণলতা ভট্ট। সমাজসেবী সুবর্ণলতা নিরক্ষর মহিলাদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেছিলেন নিজগৃহে। মদের সর্বনাশা নেশামুক্তির জন্য পাড়ায় পাড়ায় প্রচার চালাতেন মানুষকে সচেতন করার উদ্দেশ্যে। রাজনৈতিক বা ধর্মীয় কোন ছুঁৎমার্গে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। তাই গাঁধী অনুরাগী হয়েও চরমপন্থী বিপ্লবীদের সাহায্য করতে দ্বিধাগ্রস্ত হননি। একই ভাবে নবদ্বীপের বৈষ্ণব পরিবারের কন্যা হয়েও প্রতিবেশী শেখপাড়ার মুসলিম পরিবারগুলির বিপদে আপদে সাহায্য করতে সদা তৎপর ছিলেন সুবর্ণলতা ভট্ট।
১৯৭৫ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকায় ঊষারাণী সান্যালের লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধে মহিলা—
রত্নগর্ভা চুন্নুকুমারী’ শীর্ষক রচনাটি পড়ে জানা যায় জিয়াগঞ্জের সওদাগরি গদির কর্মচারী বালকিষণ পাণ্ডের স্ত্রী চুন্নুকুমারী সাংসারিক দায়িত্বপালনের পাশাপাশি স্বাধীনতা সংগ্রামে একনিষ্ঠ ভাবে অংশ নেন। স্বামীর মৃত্যুর পর ছয় পুত্র ও এক কন্যাকে প্রতিপালনের সঙ্গে সঙ্গে তিনি অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করেন। জিয়াগঞ্জের কংগ্রেস নেতা জগদানন্দ বাজপেয়ী, দুর্গাপদ সিংহ, জগৎ সিং লোঢ়া প্রমুখের সংস্পর্শে চুন্নুকুমারী দেবী ধীরে ধীরে প্রথমসারির নেত্রী হয়ে ওঠেন। দেশমাতৃকার বন্ধনমুক্তির সংগ্রামে নিজের পুত্রদের এবং একমাত্র জামাতাকেও জেলের পথে পাঠাতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করেননি এই তেজস্বিনী।
শশাঙ্কশেখর সান্যালের সহধর্মিণী ঊষারাণী সান্যালের মত লেখিকার কলমে লিপিবদ্ধ না হলেও অগ্নিযুগের অসিলতাদের অনেক কাহিনী আজও থেকে যেত সকলের অগোচরে। শাশুড়ি কালিদাসী সান্যালের অনুপ্রেরণায় স্বামীর সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের তিনি হয়ে উঠেছিলেন যোগ্য সহযোগী।
১৯৪২ এর ভারতছাড়ো আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে যোগদান করেছিলেন। এছাড়াও কৃষ্ণনাথ কলেজের অধ্যাপক রামচন্দ্র দুবের বোন সবিতা গুপ্ত স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নিয়ে পরবর্তীসময়ে বিপ্লবী সাম্যবাদী দল (আরসিপিআই) এর সঙ্গে যুক্ত হন।
গাঁধীর লবণ সত্যাগ্রহের সমর্থনে জিয়াগঞ্জের কিরণ দুগর, সুনীতা শেঠিয়া প্রমুখগণ পুলিশের নিষেধ অমান্য করে মহিলা মিছিল সংগঠিত করেন এবং জিয়াগঞ্জের বারোয়ারিতলায় পতাকা উত্তোলন করেন। মুর্শিদাবাদ জেলা কংগ্রেসের প্রাক্তন সম্পাদক সনৎ রাহা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ফলে যখন জেলে গিয়েছিলেন তখন তার মা সরোজিনী রাহা ধানদূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, ‘‘আমাদের জন্য ভেবো না। দেশমাতৃকার সেবায় যখন নেমেছে, তখন এগিয়ে যাও, পিছন ফিরে তাকিও না।’’
আজ যখন আইসিস জঙ্গিদের হাতে লাঞ্ছিতা, নিগৃহীতা সাহসিনী নাদিয়া মুরাদ, মালালারা নোবেল প্রাইজের জন্য মনোনীত হয়ে নিজের ও নারীদের যন্ত্রণার কথা বিশ্ববাসীর সামনে জানাতে একটি উপযুক্ত মঞ্চ পেয়েছেন, তখন মনে হয় এই জেলার কত অগ্নিকন্যা নিজেদের অব্যক্ত যন্ত্রণা ও অপমান সহ্য করে দেশমাতৃকার বেদীমূলে আত্মবলিদান করেছেন। স্বাধীন ভারতের একজন নারী হিসাবে তাদের আপসহীন সংগ্রামকে জানাই সহস্র কুর্ণিশ।
শিক্ষিকা, কান্দি রাজা মণীন্দ্রচন্দ্র গার্লস হাইস্কুল