সম্মান ও হত্যা

ইহার মূলে কুসংস্কার, অশিক্ষা, অপরিচয়ের দরুন অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি অস্বস্তি ভীতি ঘৃণা— এইগুলি তো রহিয়াছেই, আর রহিয়াছে এই ধারণা— এই দেশে একটি সম্পর্ক, ব্যক্তির সহিত ব্যক্তির হয় না, গোষ্ঠীর সহিত গোষ্ঠীর, পরিবারের সহিত পরিবারের হয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:১২
Share:

তেলঙ্গানায় এক পিতা ক্রুদ্ধ হইল, তাহার প্রাপ্তবয়স্ক কন্যা এক দলিত পুরুষকে বিবাহ করিয়াছে। সে জামাতাকে তিন কোটি টাকা দিতে চাহিল, কন্যাটিকে যদি ছাড়িয়া দেয়। তাহাতে কাজ না হওয়ায়, গর্ভিণী কন্যার ভ্রূণ নষ্ট করিবার চেষ্টা করিল। উহাও ফলপ্রসূ না হইলে, একটি হত্যাকারী ভাড়া করিল, যে জামাতাকে খুন করিয়া ‘অশুভ সম্মিলন’-এর ইতি ঘটাইল। এই ঘটনা ১৪ সেপ্টেম্বরের, আর ১৯ সেপ্টেম্বর আর এক পিতা তাহার কন্যা ও জামাতাকে ছুরি লইয়া আক্রমণ করিল (জামাতা দলিত), মেয়েটি গুরুতর আহত। ভারত জুড়িয়া ‘সম্মান রক্ষার্থে খুন’ বা খুনের প্রয়াস এত পরিমাণে ঘটিয়া চলিয়াছে, তাহা প্রথম পৃষ্ঠার সংবাদও আর হয় না। অনেকে মনে করেন, ইহা গ্রামে ঘটিলেও, নগরে ঘটিতেছে না। নগরের মানুষগুলি অনায়াসে চলমান সিঁড়িতে উঠিয়া পড়িতে পারে বটে, কিন্তু বাড়িতে প্রাচীন চণ্ডীমণ্ডপের আসরই বসাইয়া থাকে, সেইখানে চেনা ভাবনার বাহিরের ধারণাকে ঢিল মারিবার চেষ্টা চলে। তাই শিক্ষিত ভদ্র বাড়িতেও অনায়াসে বলা হয়, অন্য জাতের মানুষকে বিবাহ করিয়ো না। আপত্তি না শুনিলে হয়তো কন্যাকে সারা রাত্রি কলঘরে বন্দি রাখা হয়, বা জব্বলপুরে মাতুলালয়ে প্রেরণ করা হয়। নিপীড়নটি হত্যা অপেক্ষা ন্যূন, কিন্তু মানসিকতাটি সমরূপ।

Advertisement

ইহার মূলে কুসংস্কার, অশিক্ষা, অপরিচয়ের দরুন অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি অস্বস্তি ভীতি ঘৃণা— এইগুলি তো রহিয়াছেই, আর রহিয়াছে এই ধারণা— এই দেশে একটি সম্পর্ক, ব্যক্তির সহিত ব্যক্তির হয় না, গোষ্ঠীর সহিত গোষ্ঠীর, পরিবারের সহিত পরিবারের হয়। এই দেশে, একটি লোক খায় ঘুমায় হাঁটে না, তাহার সহিত হাঁটে তাহার পূর্বপুরুষ, তাহার বংশ, তাহার পিতামাতার অভ্যাস, পছন্দ, রুচি। তাই কোনও মানুষ যখন প্রণয় করিতেছে, ভাবিতেছে ঘরে কেহ নাই প্রেমাস্পদ ব্যতীত, আসলে রহিয়াছে তিন সহস্র প্রেত, তাহারা সেই আশ্লেষ অনুমোদন করিতেছে, বা করিতেছে না। এই ঐতিহ্যন্যুব্জ দেশে, ব্যক্তি এমন কিছু করিতে পারে না, যাহা তাহার গোষ্ঠীর মানসজগৎটি নাড়াইয়া দেয়। ব্যক্তির মতামতকে সম্মান না দিয়া, পরিবারকে তাহার স্কন্ধে চাপাইয়া দিবার এই অভ্যাস, আর ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ করিবার ধর্ষকামী মজা, এইগুলি মিলিয়া এই সম্মান রক্ষার্থে অত্যাচারের প্রথা গড়িয়া উঠিয়াছে।

তবে ব্যক্তিস্বাধীনতার কথা তো উঠিবে ব্যক্তির ক্ষেত্রে। এই মহান দেশের বহু অঞ্চলে, নারী ‘ব্যক্তি’ নহে, ‘সম্পত্তি’। সম্পত্তি বিবাহের সময় হাতবদল হইতে পারে, কিন্তু কোন হাত, তাহা নির্ণয় করিবার অধিকার তো সম্পত্তির নিজের থাকিতে পারে না। তাই নারী নিজে তাহার জীবনসঙ্গী পছন্দ করিয়া লইলে, ইহাই তাহাকে শাস্তি দিবার যথেষ্ট কারণ। সমীক্ষায় দেখা গিয়াছে, সম্মানরক্ষার্থে খুনের অধিকাংশ ক্ষেত্রে কারণগুলি হইল, পরিবারের ঠিক করিয়া দেওয়া সম্বন্ধ না মানা, বেজাতে বিবাহ করা, ধর্ষিতা হওয়া (সে ক্ষেত্রে সম্পত্তিটি ‘খুঁতো’ হইয়া যাইল)। কিছু ক্ষেত্রে সমকামীদের হত্যা করা হয়, ব্রাজ়িল আর্জেন্টিনার মতো কিছু দেশে ইহার জন্য স্বতন্ত্র সংগঠনও আছে। মেয়েলি ছেলে দেখিলে পিটাইয়া বা হত্যা করিয়া সংগঠনগুলিই সমাজের ‘সম্মান রাখিবে’। ইংল্যান্ডে প্রতি বছর গড়ে ২০-২২টি এমন হত্যা ঘটে, প্রায় প্রতিটিই আরব দেশ বা দক্ষিণ এশিয়া হইতে আসা পরিবারে। এবং প্রায় প্রতি ক্ষেত্রে হন্তারক পিতার মূল অভিযোগ: কন্যা ‘পাশ্চাত্যায়িত’ হইয়া যাইতেছে। হয়তো ছোট স্কার্ট পরিতেছে, বা পুরুষবন্ধুর সহিত ঘুরিতেছে। সৌদি আরবে, মেয়ে অধিক সময় ফেসবুকে কাটাইতেছে বলিয়াও পিতা তাহাকে খুন করিয়াছে। আসলে, যে কোনও পরিবর্তনরোধী সমাজ আধুনিক সময়টিকে তীব্র ভয় পাইতেছে। কারণ সন্তানকে শারীরিক ভাবে আটকাইয়া সে সন্তানের যোগাযোগ, বাহিরের জানালা রুদ্ধ করিতে পারিতেছে না। মোবাইল ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপ আসিয়া, ব্যক্তিকে অচেনা বাতাসে আবাহন করিতেছে, বাহির হইবার সুযোগ দিতেছে। প্রবল নিরাপত্তাহীনতায় ভুগিয়া ‘খাপ পঞ্চায়েত’গুলি অতিপ্রতিক্রিয়া দেখাইয়া ফেলিতেছে, একটি চপেটাঘাতে শান্তি হইতেছে না, একশতটি মারিতেছে। এই সকল অশিক্ষাকে গুঁড়াইয়া দিতে হইলে, রাষ্ট্রকে অগ্রসর হইতে হইবে। যে রাষ্ট্র বিপরীত পথে হাঁটিয়া, বস্তাপচা ধারণার বশে মানুষের হিংস্র হইয়া উঠাকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন করিতেছে, তাহার সম্মান রাখিবে কে এবং কী উপায়ে?

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement