The Great Mosque of Ayasofya

শেষ হল মিলনের পবিত্রতা

কলঙ্কিত হয়েছে আয়া সোফিয়ার ইতিহাসও। আজও এর দুটো সরকারি নাম: ‘গ্রেট মস্ক অব আয়া সোফিয়া’ এবং ‘চার্চ অব আয়া সোফিয়া’।

Advertisement

আবাহন দত্ত

শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০২০ ০০:০১
Share:

২৬ মে, ১৪৫৩। পঞ্চাশ দিন ধরে কনস্ট্যান্টিনোপল ঘিরে বসে আছে অটোমান তুর্কিরা। পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের প্রাচীর ঘেরা রাজধানী কিছুতেই দখল করা যাচ্ছে না। রোমানরা দুর্বল হয়ে এলেও মনোবল ভাঙছে না। কিন্তু সে দিন সন্ধেবেলা কুয়াশা সরে যেতে দেখা গেল, শহরের প্রাণ আয়া সোফিয়া ক্যাথিড্রালের গম্বুজের ওপর অদ্ভুত আলোর খেলা। প্রাজ্ঞজনে বললেন, পবিত্র আত্মা শহর ত্যাগ করল। দেবতা হাত ছাড়ার অর্থ, শহর শ্মশান হয়ে যাওয়া। ২৮ মে যখন প্রাচীরের বাইরে চরম আক্রমণের প্রস্তুতি নিল অটোমান সৈন্য, শহরের ভেতর ধর্মীয় শোভাযাত্রার আয়োজন করল রোমানরা। শেষ বারের মতো জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান হল আয়া সোফিয়ায়। লাটিন ও গ্রিক চার্চের অভিজাতরা যোগ দিলেন, সঙ্গে সম্রাট। মাঝরাতে শত্রুর আক্রমণ। বিশাল গির্জার তাম্রনির্মিত দরজার সামনে জড়ো হলেন শহরবাসী। ঈশ্বর রক্ষা করবেন, এই আশায়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মুসলমানদের হাতে চলে গেল তৎকালীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নগরী। আয়া সোফিয়ায় ঢুকলেন সুলতান দ্বিতীয় মহম্মদ। ইমামকে ডেকে কলেমা পড়ালেন। গির্জা হয়ে গেল মসজিদ।

Advertisement

গত শুক্রবার দেড় হাজার বছরের পুরনো এই আয়া সোফিয়াকেই মিউজ়িয়াম থেকে মসজিদে রূপান্তরিত করার অনুমতি দিয়েছে তুরস্কের সর্বোচ্চ আদালত। ১৯৩৫ সালে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ তৈরি করার উদ্দেশ্যে এই মসজিদকে মিউজ়িয়ামে পাল্টে ফেলেছিলেন আধুনিক তুরস্কের জনক মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক। সেই কাজ বেআইনি হয়েছিল বলে জানিয়েছে বর্তমান রাষ্ট্রীয় পরিষদ। তা নিয়ে বিশ্ব জুড়ে হইচই। খ্রিস্টানরা নিন্দা করেছে। ইউনেস্কো বলেছে, ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের ক্ষেত্রে এমন একতরফা সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না।

আরও জরুরি, কলঙ্কিত হয়েছে আয়া সোফিয়ার ইতিহাসও। আজও এর দুটো সরকারি নাম: ‘গ্রেট মস্ক অব আয়া সোফিয়া’ এবং ‘চার্চ অব আয়া সোফিয়া’। ১৪৫৩ সালে অটোমান বাহিনীর দখলের পর আয়া সোফিয়ার গায়ে হাত পড়েনি, এমন নয়। ভেতরে ও বাইরে কিছু বদল ঘটেছিল। কিছু অর্থোডক্স প্রতীক সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, কিছু প্লাস্টারে ঢাকা পড়েছিল। আর বাইরে তৈরি হয়েছিল চারটে মিনার। তার পরেও অসংখ্য বাইজ়ান্টাইন প্রতীক, মোজ়াইক, শিল্পকীর্তি সংরক্ষণ করা হয়েছিল, যা আজও পর্যটকেরা দেখতে যান। অর্থোডক্স চার্চের সে অর্থে কোনও ক্ষতি হয়নি। এবং গ্রিক দার্শনিক গেনাদিয়ুস স্কোলারিয়ুস-কেই শহরের প্যাট্রিয়ার্ক হিসেবে বসিয়েছিলেন সুলতান। মহম্মদ ভয়ানক আগ্রাসী শাসক ছিলেন। কিন্তু সাম্রাজ্য বাড়িয়ে চলার পিছনে তাঁর অন্য রকম ভাবনা ছিল। অটোমান সাম্রাজ্য এত বৃহৎ ও মহান হবে, যে তাতে বাস করবে নানা ধর্ম-সংস্কৃতি-জাতি-ভাষার মানুষ। সেই সাম্রাজ্যের প্রাণ আয়া সোফিয়া গোঁড়া হলে চলে?

Advertisement

মহম্মদেরও অন্যায় ছিল। আধুনিক কালে সে সব শুধরেছিলেন আতাতুর্ক। ইসলামের নিয়ম মেনে জিশু, মেরি ও খ্রিস্টান সন্তদের মোজ়াইক ঢেকে দিয়েছিল অটোমানেরা। মিউজ়িয়াম তৈরির সময় তা পুনরুদ্ধার করা হয়। দেশকে ধর্মনিরপেক্ষ করে গড়ে তুলতে এমন অনেক কাজই করেছিলেন আতাতুর্ক, যা গোঁড়াদের পছন্দ ছিল না। রবীন্দ্রনাথ বলতেন, কামাল নতুন এশিয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

তুরস্কের আদালতের যুক্তি, আয়া সোফিয়া মহম্মদের ওয়াকফ-এর (যে ধর্মীয় অনুদান হস্তান্তরযোগ্য নয়) অংশ। ধর্মপাঠ করে যে কাঠামোকে মসজিদে পরিণত করা হয়েছে, আইন করে তাকে মিউজ়িয়ামে পরিণত করা যায় না। এবং রাষ্ট্র যে হেতু অধিকৃত সম্পত্তিগুলোর অছিমাত্র, তাই অধিকর্তাকে লঙ্ঘন করার অধিকারও তার নেই। অতএব, আতাতুর্কের মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত বাতিল।

আদালতের রায় সব সময়ই শিরোধার্য। শুধু মনে রাখা ভাল যে আয়া সোফিয়ার বিস্ময়যাত্রার শুরু ৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে। এর ভেতরে ঢুকে ঘাড় তুলে তাকালে চোখ ধাঁধিয়ে যায়— উচ্চতা ১০৫ ফুট। যে খিলানগুলোর ওপর গম্বুজ দাঁড়িয়ে আছে, তার গায়ের কাজ মুগ্ধ হয়ে দেখতে হয়। গম্বুজের ছোট ছোট জানালা দিয়ে সূর্যের আলো ঢুকে চাঁদোয়া তৈরি করে। আতাতুর্ক বুঝতেন, আয়া সোফিয়া ধর্মস্থান হলেও শিল্পকীর্তি, সেটাই বড় কথা। তাই পরাভবের আশঙ্কা জেনেও সঙ্কল্প থেকে সরেননি। একুশ শতকে এসে নতুন তুরস্ক আমাদের বিচলিত করল। ধর্মের অন্ধতায় পরাভূত হল ইতিহাস আর শিল্পের ঐতিহ্য।

তবে আয়া সোফিয়ার অতীতকে কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না। গায়ের জোরে তা কারও সম্পত্তি হয়নি, হবে না। তা খ্রিস্টধর্মের, ইসলামের, সকলের। লোকশিল্পী আবদুল আলিমের গান মনে পড়ে— “পরের জায়গা পরের জমিন/ ঘর বানাইয়া আমি রই/ আমি তো সেই ঘরের মালিক নই।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement