Rabindranath Tagore

তাঁর সৃষ্টিরা আজও বাঙ্ময়...

জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আপ্ত বাক্য ছিল, ‘যখন কিছু দেখবে, বাঘের মতো ঘাড় মুচড়ে ধরবে। পিছনে আর তাকাবে না।’ তাঁর সহজিয়া জীবন নিয়ে কতই না কাটাছেঁড়া। কিন্তু ক’জন তাঁর দরাজ গলায় রবীন্দ্রগানকে মনে রেখেছে? জন্মদিন চলে গেল রবিঠাকুরের প্রিয় ভাস্কর রামকিঙ্কর বেইজের। রামকিঙ্কর স্মৃতির অতলে ডুব দেন, হাসতে থাকেন। যেন একটা অবয়ব রূপ পেতে চলেছে।

Advertisement

বিতান ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০২০ ০৬:১৪
Share:

কলের বাঁশি - শান্তিনিকেতনে রামকিঙ্করের সৃষ্ট ভাস্কর্য। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

১৯৭৫ সালে ঋত্বিক ঘটক শান্তিনিকেতনে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ভাস্করকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র করলেন। স্বভাবসুলভ ভঙ্গীতে জড়ানো গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘‘কিঙ্করদা, আপনি যখন রবীন্দ্রনাথের পোর্ট্রেট করছিলেন, তখন উনি আপনাকে কী বলেছিলেন শিল্প সম্পর্কে?’’

Advertisement

রামকিঙ্কর স্মৃতির অতলে ডুব দেন, হাসতে থাকেন। যেন একটা অবয়ব রূপ পেতে চলেছে। তারপর বলেন, ‘‘উনি প্রথমে দেখে নিলেন কোথাও লোক আছে কিনা। কারণ অনেক সময় ওনার সঙ্গে লোক থাকত তো, সেক্রেটারিরা থাকতেন। সেই জন্য সব দেখে নিলেন। আমি ওধারে, পোর্ট্রেট করছি ওঁর। উনি বসে বসে লিখছিলেন আর কী, তারপরই বললেন, দেখো, যখন কিছু দেখবে, বাঘের মতো ঘাড় মুচড়ে ধরবে। পিছনে আর তাকাবে না। এই হল শেষ কথা।’’

এমনই এক গোধূলি বেলায় কোণার্ক বাড়ির বারান্দায় বসে কবি লিখছেন। ঘরের মেঝেতে সোনালি আলো খেলা করছে। রবীন্দ্রনাথ ডেকে পাঠিয়েছিলেন তাঁর তরুণ ভাস্করকে। তাঁকে নিয়ে নানা কথা ভেসে বেড়ায়। তাঁর শিল্প ভাবনা, তাঁর কাজের ধরন, তাঁর ব্যক্তি জীবন –

Advertisement

কিঙ্কর এসে দাঁড়ালেন অবনত হয়ে। রবীন্দ্রনাথ জানতে চাইলেন, ‘‘কার মূর্তি গড়েছ কিঙ্কর?’’ কবির প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে মনে পড়ল মাস্টারমশাই নন্দলাল বসুর কথা। — ‘‘রাতের স্বপ্নগুলোকে মনে রেখো কিঙ্কর। ভুলে যেও না। তেমন হলে, স্বপ্ন ভেঙে গেলে, উঠে স্বপ্নের কথা লিখে রাখবে। কোনও স্বপ্নই ভুলে যেও না। স্বপ্নে ছবি আসে কিঙ্কর, প্রতিমা আসে। স্বপ্ন আঁকবে!’’ তাই মুখ তুলে বললেন, ‘‘আমি ওটাকে জ্ঞান দিয়ে বুঝতে পারি নে। স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে ওই মূর্তি আমার কাছে এসেছিল।’’

লেখার খাতায় নজর কবির। দুই শিল্পীর কথপোকথন চলতে থাকে। কিঙ্করের অস্বস্তি বাড়তে থাকে কবির প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে। খেই হারায়। একসময় রবীন্দ্রনাথ ফিরে তাকান আনমনা কিঙ্করের দিকে। বলেন, ‘‘একটি পাখি কি উড়ে যেতে চায় আকাশে? পাখা তার যেন সেইরকম তুলে দিয়েছে।’’ চোখের পাতা ভিজে আসে তরুণ ভাস্করের। মুখ নামিয়েই অষ্ফূটে বলেন, ‘‘একটি মেয়ে পাখি হয়তো তার বুকের নীচেই আছে!...’’ কবি আর কিঙ্করের কথোপকথন সেদিন যখন থেমেছিল আকাশে তখন সন্ধ্যাতারা জ্বলজ্বল করছে।

যদি সিনেমার মতোই ফ্ল্যাশব্যাকে যাই?

একঢাল কোঁকড়ানো চুল, কালো চেহারার এক কিশোর বাঁকুড়ার যুগীপাড়ার দোলতলা বাজারে একটি গাছের নীচে বসে। তার পায়ের কাছে রাখা কাঠের বাক্সের উপরে ক্ষুর, কাঁচি, নরুন। অপেক্ষা খদ্দেরের। ক্ষৌরকর্মে সে পটু নয়, কিন্তু খদ্দের টানার জন্য কোনও হাঁকডাক নেই। বাক্সের উপরে রাখা একটি নরুন দিয়ে আনমনে গাছের গা কুঁদে নতুন শরীর তৈরি করছে নিজের কল্পনায়। আজন্ম অর্থাভাব কিশোরটির। আমৃত্যুও বলা চলে। বাবা চণ্ডীচরণ দিনভর যজমানদের বাড়ি খেউরি করেও সংসারের জোয়াল টানতে পারছিলেন না। আর কোনও পথ না পেয়ে স্ত্রী সম্পূর্ণাকে একদিন বললেন, ‘‘ছেলে এখন থেকেই উপার্জনে সাহায্য করুক।’’ সম্পূর্ণা স্বামীকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, ‘‘ছেলেটা সবেমাত্র সুরেন পণ্ডিতের পাঠশালা থেকে চতুর্থটা পাশ দিয়ে বঙ্গ বিদ্যালয়ে ঢুকেছে। এখনই যদি ছাড়িয়ে দেওয়া হয়!’’ কিন্তু বাঁচতে তো হয় খেয়ে পরেই। বাবার ইচ্ছেয় ছেলে দোলতলা বাজারে এই গাছের নীচে ক্ষুর, কাঁচি নিয়ে বসে। আর গাছটার গায়েই তার মনের যাবতীয় ভাবনাকে ফুটিয়ে তোলে।

বঙ্গ বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মা’র ইচ্ছেয় সন্ধ্যাবেলায় যেতে হচ্ছে যুগীপাড়া নৈশ বিদ্যালয়ে। যদিও লেখাপড়া বিষয়টাই তাকে তেমন একটা টানে না। তাই এই পরিবর্তন নিয়ে তার কোনও মাথাব্যথা নেই। বরং পড়তে বসে বেড়ার দেওয়ালে টাঙানো দেবদেবীর ছবিগুলোর দিকে চোখ চলে যায়, মন টানে। লেখার স্লেটে আঁকিবুঁকি চলে যেন তার অজান্তেই। বাড়ির বড়দের নজরে পড়লেই বকাবাদ্যিও জোটে দেদার। কিন্তু কি করবে সে, পড়ার থেকে তার ছবি আঁকাতেই আগ্রহ যে বেশি।

কুমোরপাড়ায় অনন্ত জ্যাঠার মূর্তি গড়া দেখতে তার বড্ড ভাল লাগে। সুযোগ পেলেই সে ছোটে সেখানে। পলক পড়ে না, একদৃষ্টে দেখতে দেখতে যেন ঘোর লাগে তার। সেই ঘোরে মূর্তিগুলো তার সঙ্গে কথা বলে! বলে, “কিঙ্কর এসো তোমার হাতের স্পর্শে আমাদের নতুন জন্ম হোক।” রোজ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনন্ত জ্যাঠার কাজ দেখতে দেখতেই তার মূর্তি গড়ার সহজপাঠ। হাত ছোঁয়নি মাটির ছাঁচ। শুধু দেখে দেখেই সে এরমধ্যে শিখে নিয়েছে মূর্তি গড়ার বেশ কিছু কৌশল। কিছুদিন পরে বাড়িতে নিজের হাতে মাটির তাল দিয়ে ছোট-ছোট মূর্তি বানানো শুরু হয়ে যায় তার। নিজের মতো করে বানায় আর সাজিয়ে রাখে বেড়ার দেওয়ালের পাশে। কিন্তু পেটের দায় যে বড় দায়। তাই ইচ্ছে না করলেও তাকে এই গাছতলায় ক্ষুর-কাঁচি নিয়ে বসতে হয়েছে।

যদিও তাতে তার ভাবনাকে ফুটিয়ে তোলায় কোনও খামতি নেই। নিজেই রং বানায়, ছবি আঁকে। তার কল্পনারা ফুটে ওঠে কখনও মাটির তালে, কখনও কাগজে আবার কখনও গাছের গুঁড়িতে।

খেউরির কাজে ছেলের অনীহা দেখে ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হন চণ্ডীচরণ। আবার দুটো বাড়তি আয়ের আশায় ছেলের বানানো মূর্তি নিয়েই মেলায় মেলায় নিজেই পসরা সাজান। বিক্রিও হয় ভালই। মনের ভাল লাগাকেই প্রাধান্য দিয়ে প্রতিকূলতাকে সামলে বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত যুগীপাড়ার সেদিনের সেই কৃষ্ণকায় কিশোরই তাঁর সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হন ভবিষ্যতের প্রথিতযশা শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজ হিসেবে।

স্রোতের বিপরীতে নিজের গতিতে চলা ভাস্করকে অনুভব করতেন কবি। তাই বোধহয় দু’জনের ভাবনায় এত মিল। কাছের মানুষদের চলে যাওয়া বারবার খুব কাছ থেকে দেখা দু’জনের মৃত্যুও ছিল একই রকম। শেষ যাত্রায় শান্তিনিকেতন ছেড়ে যেতে চাননি কবি। যেতে চাননি কবির প্রিয় ভাস্করও। মৃত্যুর দু’দিন আগে কলকাতায় হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে প্রিয় ছাত্র সত্যজিৎ রায়কে বলেছিলেন, ‘‘মানিক, একটা রিকশা ডেকে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দাও!’’

বাঘের মতোই একবগ্গা তিনি সেই শৈশব থেকে। নিজেই বলতেন, ‘‘ধরেছি, আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছি। হজম করে ছিবড়ে করে ছেড়েছি। হজম করার মানে জানো? ও মন্ত্রটা আমার গুরুদেবের কাছে শেখা। তাঁর থেকে জন্ম নিয়েছে আমার অনেক ছবি, মূর্তি, অনেক কল্পনা, আর অনুভব।...’’

সিনেমার মতোই জীবন তাঁর। ফ্রেমের পর ফ্রেম দিয়ে ঋত্বিক যেন তাঁকে গড়তে চেয়েছিলেন তথ্যচিত্রটিতে। মাটির তাল থেকে পূর্ণাবয়ব রূপ পাওয়ার আগেই থেমে যেতে হয়েছিল পরিচালককে।

পর্দাতেও মুখোমুখি দুই শিল্পীর কথোপকথন। অসমাপ্ত। যেমন বাস্তবে।

তথ্য ঋণ : আনন্দবাজার আর্কাইভ ও বিশ্বভারতী

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement