রাজ্যের বিজেপি সভাপতি ঘোষণা করেছেন, এক কোটি মুসলমান ‘অনুপ্রবেশকারী’-কে পশ্চিমবঙ্গ থেকে এনআরসি করে তাড়ানো হবে। বলা হচ্ছে যে মুসলমানদের চার জন করে স্ত্রী, অতএব তাঁদের পরিবারে অনেক সন্তান জন্ম নেয়, ফলে অদূর ভবিষ্যতে তাঁরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হবেন। অনেক ‘শিক্ষিত’ মানুষও এই লাগাতার প্রচারে বিশ্বাস করে ফেলছেন। আসল সত্যটা কী?
২০১৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর এই পত্রিকাতে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে আমরা লিখেছিলাম যে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু ও মুসলমান, উভয় গোষ্ঠীরই জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার লাগাতার কমছে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলির ক্ষেত্রেও মুসলমানদের জনসংখ্যাবৃদ্ধির হারের কোনও স্পষ্ট প্রবণতা নেই। কিছু সীমান্তবর্তী জেলার ক্ষেত্রে এই বৃদ্ধির হার রাজ্যে মুসলমানদের গড় বৃদ্ধির হারের থেকে বেশি, আবার কিছু জেলায় কম। উল্লেখযোগ্য ভাবে দেখা যাচ্ছে, যে জেলাগুলিতে হিন্দুদের জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার বেশি, সেই জেলাগুলিতেই মুসলমানদের জনসংখ্যাবৃদ্ধির হারও বেশি। ‘ব্যাপক অনুপ্রবেশ’-এর তত্ত্ব পরিসংখ্যানের ধোপে টেকে না। এই নিবন্ধে আমরা আরও বিস্তৃত তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করেছি।
পশ্চিমবঙ্গের জনশুমারির ফল অনুযায়ী ১৯৫১-৬১ দশকে জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার ছিল ৩২.৮%, ভারতের ক্ষেত্রে যা ছিল ২১.৬৪%। অর্থাৎ, ভারতের থেকে পশ্চিমবঙ্গে জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার বেশি ছিল। এর জন্য অনেক কারণ দায়ী— যেমন, পূর্বপাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তুদের আগমন। আবার দেশের অন্যান্য প্রান্ত থেকে শ্রমজীবী মানুষের পশ্চিমবঙ্গে চলে আসাও একটি কারণ। কিন্তু ১৯৬১-৭১ দশকেই দেখা যাচ্ছে যে পশ্চিমবঙ্গে জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার (২৪.৮%) প্রায় ভারতের বৃদ্ধির হারের (২৬.৮৭%) সমান হয়ে গিয়েছে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ১৯৭১-৮১ দশকে পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার (২৩.১৭%) ভারতের তুলনায় (২৪.৬৬%) কমে গিয়েছে এবং এই প্রবণতা বজায় রেখে পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার ভারতের থেকে লাগাতার কম থেকেছে শুধু নয়, ভারত এবং আমাদের রাজ্যের জনসংখ্যাবৃদ্ধির হারের মধ্যে ফারাক বেড়েছে। ২০০১-১১ দশকে ভারতের জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার ছিল ১৭.৬৪%, যেখানে পশ্চিমবঙ্গের বৃদ্ধির হার ১৩.৯৩%।
অর্থাৎ, ১৯৫১-৭১ সালে পূর্বপাকিস্তান থেকে মানুষ এই রাজ্যে এলেও তার পরে কোনও বড় ‘অনুপ্রবেশ’ ঘটেনি। ঘটলে, পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার ভারতের থেকে কম হত না। জনসংখ্যাবৃদ্ধির তথ্য থেকে উদ্বাস্তু আগমন বা অনুপ্রবেশের সম্পূর্ণ চিত্র নির্মাণ করা সম্ভব নয়, কারণ এই হার রাজ্যের উন্নয়ন, শিক্ষা, মহিলাদের ক্ষমতায়ন ইত্যাদির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই আমাদের তাকাতে হবে ‘অনুপ্রবেশ’-এর তথ্যের দিকে।
এই তথ্য সহজলভ্য নয়। তবু বিভিন্ন গবেষক যে তথ্যভাণ্ডার নির্মাণ করেছেন, আমরা তার দিকে তাকাব। ২০০৮ সালে হার্ভার্ড, ইয়েল এবং শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন অধ্যাপক গবেষণা করে দেখার চেষ্টা করেন যে দেশভাগের পরে পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশে পরিব্রাজনের চিত্র কেমন। তাদের গণনা বলছে, ১৯৩১ থেকে ১৯৫১ সালের মধ্যে গোটা ভারতে আগত মোট পরিযায়ী মানুষের সংখ্যা ৭৩ লক্ষ। আবার বহু মানুষ ভারত থেকে চলেও গিয়েছেন। অর্থাৎ, বিজেপি যে এক কোটি ‘অনুপ্রবেশ’-এর গালগল্প শোনাচ্ছে, এই তথ্য তাকে মিথ্যা প্রমাণ করে।
১৯৭১ সালে প্রকাশিত বই দি অ্যাগনি অব ওয়েস্ট বেঙ্গল-এ রণজিৎ রায় সংসদে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন সংক্রান্ত রিপোর্ট উদ্ধৃত করে জানান যে পূর্বপাকিস্তান থেকে ১৯৬০ সাল অবধি ভারতে আগত মানুষের সংখ্যা ৪১.১৭ লক্ষ, যাঁদের মধ্যে ৩১.২১ লক্ষ মানুষকে এই রাজ্যেই পুনর্বাসন দেওয়া হয় এবং বাকি প্রায় ১০ লক্ষ মানুষকে ভিন্রাজ্যে পাঠানো হয়। ১৯৭০ সাল অবধি পূর্বপাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের সংখ্যা হয় ৫২.১৪ লক্ষ। এই উদ্বাস্তুদের অধিকাংশই হিন্দু। বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় ১ কোটি উদ্বাস্তু ভারতে চলে আসতে বাধ্য হন। এঁদের অধিকাংশই স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন হওয়ার পরে ফিরে যান বলে সরকার দাবি করে।
২০১১ সালের জনগণনার সময় পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী প্রায় ২২ লক্ষ মানুষ জানান যে তাঁদের জন্ম বাংলাদেশে। এঁদের মধ্যে ৫০% (১১ লক্ষ) মানুষ নদিয়া এবং উত্তর ২৪ পরগনার বাসিন্দা। অনুমান করা চলে, তাঁরা মূলত মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষ। মুসলমান প্রধান জেলাগুলি যেমন মালদহ, মুর্শিদাবাদে বাংলাদেশকে নিজের জন্মস্থান বলা মানুষের সংখ্যা নগণ্য। বাংলাদেশে জন্মেছেন বলেই এই মানুষগুলি বেনাগরিক হতে পারেন না। দেশভাগ এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ থেকে মানুষ এই রাজ্যে এসেছেন। কিন্তু জনসংখ্যাবৃদ্ধির হারের তথ্য, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা প্রকাশিত গবেষণাপত্র, রণজিৎ রায় প্রদত্ত সরকারি তথ্য এবং ২০১১ সালের জনগণনার রিপোর্ট জানাচ্ছে— পশ্চিমবঙ্গে কয়েক কোটি অনুপ্রবেশকারী আছে, এ কথাটি ডাহা মিথ্যা।
১৯৯১ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে রাজ্যে হিন্দু জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার ছিল ১৪.২%, যা ২০০১ থেকে ২০১১ সালে কমে হয় ১০.৮%। একই সময়ে মুসলমানদের জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার ২৫.৯% থেকে কমে হয় ২১.৮%। অর্থাৎ, সম্প্রদায়-নির্বিশেষে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার হ্রাস পেয়েছে।
২০০১ সালে পশ্চিমবঙ্গে সার্বিক জন্মহার (টোটাল ফার্টিলিটি রেট বা টিএফআর, অর্থাৎ এক জন মহিলা তাঁর জীবনে গড়ে মোট যতগুলি সন্তানের জন্ম দেবেন) ছিল ২.৬, যা ২০১১ সালে কমে হয় ১.৭ এবং ২০১৫-১৬ সালে হয় ১.৮। হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে জন্মহার এই বছরগুলিতে ছিল যথাক্রমে ২.২, ১.৭ এবং ১.৬। মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ২০০১ সালে জন্মহার ছিল ৪.৬, যা মাত্র দশ বছরে কমে হয় ২.২ এবং ২০১৫-১৬ সালে হয় ২.১। অর্থাৎ, প্রতি মুসলমান মায়ের সন্তানসংখ্যা বিগত ১৫ বছরে কমেছে দুইয়ের বেশি। পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের মধ্যে জন্মহারের পতনের পরিমাণ দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। যার ফলে মুসলমানদের জন্মহার প্রায় হিন্দুদের জন্মহারের কাছাকাছি চলে এসেছে। শিক্ষার প্রসার, গর্ভনিরোধকের ব্যবহারবৃদ্ধি, সন্তানদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার আকাঙ্ক্ষা জন্মহারের এই তাৎপর্যপূর্ণ পতনের জন্য দায়ী।
যদি জেলাভিত্তিক হিসেব নিই, দেখব যে মুসলমান প্রধান জেলা, অর্থাৎ যেখানে জনসংখ্যায় মুসলমানদের অনুপাত ২০% বা বেশি, সেখানেও মুসলমানদের জন্মহার দুইয়ের কাছাকাছি। এই জেলাগুলোর মধ্যে কোচবিহার, দক্ষিণ দিনাজপুর, বর্ধমান, কলকাতা এবং উত্তর ২৪ পরগনাতে এই হার দুইয়ের চেয়ে কম। ২০০১ থেকে ২০১৫-১৬ সালের মধ্যে এই মুসলমান প্রধান জেলাগুলির অধিকাংশের ক্ষেত্রেই এক জন মুসলমান মায়ের সন্তানসংখ্যা কমেছে গড়ে দুইয়ের বেশি।
প্রচুর সন্তানের জন্ম দেওয়ার যে অপবাদ মুসলমান সমাজ সম্পর্কে দেওয়া হয়, তা ভিত্তিহীন। হিন্দুদের জন্মহার অনেক বছর ধরেই নিম্নগামী। ২০০১ সালের পর থেকে মুসলমানদের জন্মহার দ্রুত কমার ফলেই পশ্চিমবঙ্গের সার্বিক জন্মহার কমে বর্তমানে ভারতে সর্বনিম্ন হয়েছে।
অনেক শিক্ষিত বাঙালি হিন্দুর মুখেও প্রায়ই শোনা যায় যে মুসলমানেরা নাকি চারটে করে বিয়ে করেন। ২০১৫-১৬ সালের জাতীয় স্বাস্থ্য সমীক্ষা রিপোর্টের ভিত্তিতে গণনা করে দেখা যাচ্ছে যে পশ্চিমবঙ্গে ১.৬৪% হিন্দু স্ত্রী জানিয়েছেন যে তাঁদের স্বামীদের আরও অন্তত এক জন বিবাহিত স্ত্রী আছেন। গোটা দেশে এই গড় ১.৪৪%। মুসলমান নারীদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে ২.৭৭% স্ত্রী জানিয়েছেন যে তাঁদের স্বামীদের আরও অন্তত এক জন বিবাহিত স্ত্রী আছেন। সর্বভারতীয় গড় ২.০৫%। অর্থাৎ, মুসলমান সমাজে স্বামীর একাধিক স্ত্রীর সঙ্গে বসবাস করা মহিলার সংখ্যা ৩ শতাংশের কম। অধিকাংশ মুসলমান পুরুষের চারটে বিয়ে, এই কথাটা নিখাদ মিথ্যা। উল্লেখযোগ্য হল, পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু ও মুসলমান, উভয়ের ক্ষেত্রেই একাধিক স্ত্রী থাকার অনুপাত ভারতের গড় অনুপাতের থেকে বেশি। সার্বিক ভাবে রাজ্যে মহিলাদের ক্ষমতায়ন এবং তাঁদের অধিকারের বিষয়ে আরও বিস্তৃত আলোচনা জনপরিসরে হওয়া প্রয়োজন।
মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে প্রচারের একটিও পরিসংখ্যানের ধোপে টেকে না, সেগুলির ভিত্তিতে যে রাজনীতি চলে, তার স্বরূপ বুঝতে সমস্যা হয় না।
অর্থনীতি বিভাগ ও জনসংখ্যাতত্ত্ব বিভাগ, ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ়, কলকাতা