হিমা দাস।
তিন সপ্তাহের ভিতর পাঁচটি স্বর্ণপদক। ভারতীয় অ্যাথলেটিক্স তথা সামগ্রিক ভারতীয় ক্রীড়াজগতের পক্ষে গর্বিত হইবার কারণ ছিল। উনিশ বছর বয়সি ভারতীয় অ্যাথলিট হিমা দাসের প্রশংসায় সংবাদ ও সমাজমাধ্যম পঞ্চমুখ হইবার কথা ছিল। জুলাইয়ে ইংল্যান্ডে ক্রিকেট বিশ্বকাপের প্রথম সেমিফাইনালে ভারতীয় দল বিদায় লওয়ায় দেশ বিমর্ষ হইয়াছিল, হিমার সোনার দৌড় ক্রীড়াপ্রেমীদের মুখে হাসি ফুটাইতে পারিবার কথা ছিল। অথচ ক্রিকেটসর্বস্ব ভারতে তেমন ঘটিল না। কারণটি স্পষ্ট। ভারতীয় ক্রীড়াপ্রেমীদের নিকট এই সকল ক্রীড়া তত আদরণীয় নহে, এমনকি তত গ্রহণীয়ও নহে। ক্রিকেটের বাহিরে একমাত্র হকির ভাগ্যেই এক কালে জাতীয় গর্ব হইবার সৌভাগ্য জুটিয়াছে, ফুটবলের ভাগ্যে এক সময় জাতীয় মনোযোগ ধাবিত হইয়াছে। কিন্তু ক্রমে ক্রমে আর সব খেলা অস্তমিত হইয়া ভারতীয় হৃদয়পটে একচ্ছত্র স্থান করিয়া লইয়াছে ক্রিকেট। কাশ্মীর হইতে কন্যাকুমারী মজিয়াছে এই একটি খেলাতেই। গড় ভারতীয় পিতামাতা পড়াশোনা ব্যতীত যদি একটিমাত্র কিছুতে সন্তানকে জড়াইতে রাজি হইয়া থাকেন, সংশয়াতীত ভাবে তাহা এই খেলাটিই। অথচ মজা এই যে, বহির্বিশ্বে হাতে গোনা কয়েকটি দেশ ব্যতীত ক্রিকেট লইয়া বিশেষ উচ্চবাচ্য হয় না। ক্রিকেট বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী দেশের সংখ্যা মাত্র দশ।
ভারত ক্রিকেটে বিশ্বকাপ জিতে নাই। তবে হিমার কৃতিত্বে প্রীত হইবার সুযোগ ঘটিয়াছে। ক্রিকেটসর্বস্বতা হইতে ভারতের মনোযোগ যদি এই সুযোগে হিমার সূত্রে অ্যাথলেটিক্সের দিকে ফিরিয়া আসে, একটি আনন্দের ঘটনা ঘটিতে পারে। তবে কিনা, হিমার কৃতিত্ব লইয়া কিছু প্রশ্নও উঠিয়াছে। ইউরোপের যেই টুর্নামেন্টগুলির ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড ইভেন্টে হিমা পাঁচটি স্বর্ণপদক জিতিলেন, বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স নিয়ামক সংস্থার কাছে সেই টুর্নামেন্টগুলি কুলীন নহে। বিশেষজ্ঞরা বলিতেছেন, এক জন বিশ্বমানের অ্যাথলিট কখনওই বিশ দিনের ভিতর পাঁচ বার ট্র্যাকে নামিবেন না। তাহাতে চোট লাগিবার সম্ভাবনা প্রবল, এবং তাহাতে অ্যাথলিটেরই ক্ষতি।
সে ক্ষেত্রে কি হিমার কৃতিত্ব নিষ্প্রভ এবং প্রান্তিক হইয়াই থাকিবে? মনে রাখা ভাল, প্রান্তিকতারও বহু প্রকারভেদ। এবং হিমা এখনও অবধি একাধিক প্রকারে প্রান্তিক। ক্রীড়াজগতে তিনি শুধু অ্যাথলেটিক্স-এর মুখই নহেন, একই সঙ্গে তিনি যে রাজ্যটির প্রতিনিধিত্ব করিতেছেন, সেই অসমেরও প্রতিভূ। আর কে না জানে, বর্তমান ভারতের মানচিত্রে অসম-সহ উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলি কেবল ভৌগোলিক নহে, রাজনৈতিক অভিনিবেশের দিক দিয়াও প্রান্তিক। এই মুহূর্তে অসম দুইটি কারণে শিরোনামে: জাতীয় নাগরিক পঞ্জি সংশোধনের জেরে, এবং প্রবল বন্যার কারণে। এবং এই প্রসঙ্গেও ক্রীড়াতারকা হিমার সামাজিক দায়বোধটি উল্লেখ করা জরুরি। নিজের রাজ্য হইতে দূরে থাকিয়াও মাসমাহিনার অর্ধাংশ ত্রাণ তহবিলে দান করিতে তিনি ভুলেন নাই, খেলোয়াড় সত্তাকে ছাপাইয়া গিয়াছে তাঁহার মানবিক সত্তা। তাই নাগরিক এবং খেলোয়াড়, উভয় পরিচয়েই প্রান্তিক হিমাকে লইয়া দেশবাসী গর্বিত হইতে পারেন। এমন আরও কিছু হিমার দেখা মিলিলে হয়তো ভারতের সমাজমনটিও পাল্টাইতে পারে।