হুঙ্কার: বৈশালীর কাছে এক জনসভায় সিএএ-র পক্ষে বক্তব্য রাখছেন অমিত শাহ। ছবি: পিটিআই
আপনারা কি দেশের অর্থনীতির করুণ অবস্থা থেকে নজর সরাতে নাগরিকত্ব আইন, এনপিআর, এনআরসি-র মতো বিতর্কিত বিষয় সামনে নিয়ে আসছেন? প্রশ্ন শুনে অমিত শাহ জবাব দিয়েছিলেন, “আপনারা আগামিকাল থেকেই সিএএ-র বদলে দিনভর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে চর্চা করুন। আমরা তৈরি।” এবিপি নিউজ-এর শিখর সম্মেলনে মোদী সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর যুক্তি ছিল, নয়া নাগরিকত্ব আইন ও অর্থনীতির মধ্যে কোনও লেনদেন নেই। আইনকানুন নিজের জায়গায়, অর্থনীতি তার আপন জায়গায়।
সত্যিই কি তাই?
গত অগস্টে জম্মু-কাশ্মীরে ৩৭০ রদের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রতিশ্রুতি ছিল, ঝিলম নদীর তিরে এবার বিনিয়োগের ঢেউ উঠবে। দেশ-বিদেশের শিল্পপতিদের ডেকে এনে কাশ্মীরে লগ্নিকারীদের সম্মেলন বসানোরও পরিকল্পনা করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। বছর গড়িয়েছে। লগ্নির শিল্প সম্মেলন হয়নি। হবে কী করে? কাশ্মীর জুড়ে ইন্টারনেট বন্ধ থাকলে, শ্রীনগর শহরে কার্ফু জারি থাকলে, ১৪৪ ধারা জারি করে লোহার ব্যারিকেড, কাঁটাতার বিছিয়ে রাখতে হলে, বিনিয়োগ তো দূর, বিনিয়োগকারীদের সম্মেলন বসানোই মুশকিল।
এখন দিল্লি মুম্বই কলকাতা বেঙ্গালুরুর রাস্তাতেও যত্রতত্র লোহার ব্যারিকেড। ১৪৪ ধারা। দিল্লিতে ইন্টারনেট বন্ধ রাখার বিরল পদক্ষেপ করতে হয়েছে। এই অস্থির পরিস্থিতিতে কি অর্থনীতির কাজকর্ম স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারে? সাধারণ বুদ্ধিই বলে, চলতে পারে না। আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার-এর মুখ্য অর্থনীতিবিদ গীতা গোপীনাথ সতর্ক করেছেন, সামাজিক অস্থিরতা বিশ্বের নানা দেশের অর্থনীতিতে ধাক্কা মারছে। কিন্তু মোদী-শাহ তা মানতে নারাজ!
ফেব্রুয়ারির পয়লা তারিখে বাজেট। দ্বিতীয় মোদী সরকারের দ্বিতীয় বাজেট। অর্থনীতিতে যে ভালমতোই ঝিমুনি ধরেছে, তাতে এখন আর কোনও সন্দেহ নেই। খোদ সরকারই মনে করছে, এ বছর আর্থিক বৃদ্ধির হার ৫ শতাংশে আটকে থাকবে। আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার (আইএমএফ)-এর পূর্বাভাস আরও কম। নতুন লগ্নি আসছে না। বাজারে চাহিদা নেই। রফতানি কমছে। অর্থনীতির চার ইঞ্জিনের মধ্যে তিনটিই অচল। বাকি থাকে সরকারি খরচ। কিন্তু রাজকোষেও টান পড়েছে। সরকার নিজেই খরচে রাশ টানছে।
সমাধান একটাই। আর্থিক সংস্কার। লোকসভা নির্বাচনের আগে ‘টাইম’ পত্রিকা লিখেছিল, ভারতে আর্থিক সংস্কারের জন্য নরেন্দ্র মোদীই সেরা বাজি। নতুন সরকারের ছয় মাস কেটে যাওয়ার পরে সেই পত্রিকাই শঙ্কিত, হিন্দু জাতীয়তাবাদ অর্থনীতির ঘাড়ে চেপে বসেছে। অর্থনীতিতে আতসবাজির রোশনাই ছিল না বলে ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের আগে নরেন্দ্র মোদী হিন্দু জাতীয়তাবাদের তাস খেলেছিলেন। প্রত্যাশার তুলনায় ভাল ফল মিলেছিল। কিন্তু গদিতে ফিরেও নরেন্দ্রভাই সেই হিন্দু জাতীয়তাবাদের কাঁধেই ভার দিয়ে রয়েছেন।
শুরুটা কিন্তু এমন হয়নি। ২০১৪-য় নরেন্দ্র মোদী আর্থিক সংস্কারের বিপুল আশা জাগিয়েই ইনিংস শুরু করেছিলেন। প্রথমেই শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের পথ সহজ করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক বিরোধিতার মুখে পিছু হটতে হয়েছিল। মোদী সরকারের কৌশল ছিল, বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে অন্তত কাজটা সেরে ফেলা হবে। গত সাড়ে পাঁচ বছরে দেশের সিংহভাগ রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে। আবার ক্ষমতা হারিয়েও ফেলেছে। মোদী সরকারের নজর পড়েনি। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে যিনি শিল্পপতিদের বন্ধু ছিলেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সেই নরেন্দ্র মোদীই স্পর্শকাতর— সরকারের গায়ে যেন কোনও ভাবেই ‘স্যুট-বুট কি সরকার’-এর তকমা না লেগে যায়।
এখন সিংহভাগ রাজ্যেই বিজেপি ক্ষমতাচ্যুত। নরেন্দ্র মোদী ‘কোঅপারেটিভ ফেডেরালিজ়ম’-এর মন্ত্রে কাজ শুরু করেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে তাঁর বৈঠকের সময় দেওয়ালে ঝোলানো ব্যানারে লেখা হয়েছিল, ‘টিম ইন্ডিয়া’। নয়া নাগরিকত্ব আইন, এনপিআর নিয়ে এখন কেন্দ্রের সঙ্গে বিরোধী রাজ্যগুলির সংঘাত তুঙ্গে। কেন্দ্রের আইনের বিরুদ্ধে একের পর এক রাজ্যের বিধানসভায় প্রস্তাব পাশ হচ্ছে। সংসদে কেন্দ্রের পাশ করানো আইনকে চ্যালেঞ্জ করে রাজ্য সুপ্রিম কোর্টে যাচ্ছে। রাজ্যগুলির সঙ্গে কথা বলার বদলে বিজেপির কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে তোপ দাগছেন। এখনও পর্যন্ত ঐকমত্য গড়ে তোলার চেষ্টাই দেখা যায়নি।
যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় এ দেশে যে কোনও আর্থিক সংস্কার বা উন্নয়নের কাজ করতে হলে কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির এক অবস্থানে আসা প্রয়োজন। তা সে জিএসটি-র মতো কর ব্যবস্থার সংস্কারই হোক বা আয়ুষ্মান ভারতের মতো জনমুখী প্রকল্প। আয়ুষ্মান ভারতের প্রকল্পেও অভিযোগ উঠেছিল, রাজ্যের সঙ্গে কথা না বলেই কেন্দ্র নিজের মতো প্রকল্প চালু করেছে। জিএসটি-র ক্ষেত্রে এখন আর লটারিতে কী হারে কর বসবে, সেই সিদ্ধান্ত নিতে গিয়েও কেন্দ্রের অর্থমন্ত্রীর পক্ষে ঐকমত্য গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। জিএসটি পরিষদে ভোট দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে মোদী সরকার যদি এখন শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ আইনে সংশোধনের মতো সাহসী সংস্কার করতে চান, ক’টি রাজ্যকে পাশে পাবেন? তার থেকেও বড় প্রশ্ন, মোদী সরকার কি আদৌ সংস্কারের পথে হাঁটতে চায়?
বাজেটের আগে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে বার্তা দেওয়া হচ্ছে, নরেন্দ্রভাই এ বার নিজেই হাল ধরছেন। প্রথম সারির শিল্পপতিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। অর্থনীতিবিদদের সঙ্গেও বৈঠকে বসেছেন তিনি। মুশকিল হল, এত দিন আন্তর্জাতিক অর্থনীতির গতি শ্লথ হয়ে পড়লেও দেশের বাজারে চাহিদা এ দেশের অর্থনীতির পতন রুখে দিয়েছিল। এখন দেশের বাজারেই ভাটার টান। কোনও উন্নয়নশীল দেশই শুধুমাত্র দেশের বাজারের ভরসায় থাকতে পারে না। রফতানিতে নজর দিতে হয়। ইউপিএ-সরকারের আমলে বৃদ্ধির হার যে ৮ শতাংশ ছাপিয়ে গিয়েছিল, তা সেই রফতানিতে ভর করেই। কিন্তু মোদী সরকার মুক্ত-বাণিজ্যের বাধা সরানোর বদলে উল্টে পাঁচিল তুলেছে। প্রধানমন্ত্রী আমেরিকায় গিয়ে ‘হাউডি মোদী’ করেছেন, কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বাণিজ্য-চুক্তি হয়নি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি থেকে সরে এসেছে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে আরসেপ বাণিজ্য চুক্তি থেকেও শেষ পর্যন্ত সরে এসেছে। খোলা বাণিজ্যের বদলে রক্ষণশীল মনোভাব নিয়ে সরকার দেশীয় শিল্পকে বাঁচানোর যুক্তিতে নানা শুল্ক বসিয়েছে।
প্রয়োজন ছিল, দেশের শিল্প যাতে দুনিয়ার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে পারে, তার জন্য আর্থিক সংস্কার। শিল্পপতিরা যাতে কারখানা তৈরির জন্য সহজে জমি অধিগ্রহণ করতে পারেন, উৎপাদনের খরচ কমাতে পারেন, তার জন্য সংস্কার। কিন্তু কর ফাঁকি, কালো টাকার বিরুদ্ধে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে যুদ্ধে নেমে সরকার উল্টে শিল্পমহলে আতঙ্ক তৈরি করেছে। দেশের শিল্পমহল খোলসের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে। কর্পোরেট কর কমলেও বাজারে চাহিদা নেই বলে তারা লগ্নি করতে নারাজ।
এই হাল শোধরাতে হবে নরেন্দ্র মোদীকেই। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী, ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’-এর জনক, ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’-এর প্রচারক, নরেন্দ্র মোদী বারে বারেই নতুন অবতারে আবির্ভূত হয়েছেন। আর্থিক সংস্কারের দরজা খোলার চাবিকাঠি তাঁরই হাতে। তিনি না পারলে বুঝতে হবে, গেরুয়া রাজনীতির খেলায় নেমে তাঁর হাতের সেই চাবিকাঠি হারিয়ে গিয়েছে।