এই প্রথম নাগরিক সমাজ সাংবাদিকদের শত্রু হিসেবে দেখল

মোদীরা সংবাদমাধ্যমের বিশ্বাস কেড়ে নিতে পেরেছেন

এনআরএস-কাণ্ড চলাকালীন, এবং তার পরেও, চিকিৎসকরা তো বটেই, শিক্ষিত, আলোকপ্রাপ্ত জনসমাজের একটা বড় অংশ সোশ্যাল মিডিয়ায় বিষোদ্গার করলেন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে।

Advertisement

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০১৯ ০০:০৩
Share:

সা‌ংবাদিকরা মার খেলেন, এটা আর খবর নয়। রাজনৈতিক দল মারে, পুলিশও বেধড়ক মারে। মাফিয়া-টাফিয়াদের কথা না-হয় বাদই দিলাম। এনআরএস-এ সাংবাদিক নিগ্রহের মধ্যে নতুন কিছু যদি থাকে, তবে তা হল এই— এই প্রথম বার কোনও অরাজনৈতিক, নাগরিক সমাজের একাংশের আন্দোলনে মার খেলেন সাংবাদিকরা। ডাক্তাররা মারলেন।

Advertisement

অবশ্য, শুধু মার খাওয়াটুকুই নয়। এনআরএস-কাণ্ড চলাকালীন, এবং তার পরেও, চিকিৎসকরা তো বটেই, শিক্ষিত, আলোকপ্রাপ্ত জনসমাজের একটা বড় অংশ সোশ্যাল মিডিয়ায় বিষোদ্গার করলেন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। নিজেদের শত্রু ঠাহরালেন সংবাদমাধ্যমকে, তার বেতনভুক কর্মীদের। আগেও রাজনৈতিক দলের মিটিংয়ে কোনও সংবাদপত্রকে ঝাঁজালো আক্রমণের মুখে পড়তে দেখেছি। সাধারণ মানুষকেও দেখেছি বিশেষ কোনও কাগজের নিন্দেমন্দ করতে। কিন্তু, এই পনেরো বছরের কর্মজীবনে ব্যক্তি হিসেবে সাংবাদিকদের ওপর এমন প্রবল বিদ্বেষ আগে কখনও দেখিনি। কোনও বিশেষ ব্যক্তির প্রতি বিদ্বেষের কথা বলছি না— পেশায় সাংবাদিক, পরিচিত-অপরিচিত এমন সবার প্রতি বিদ্বেষ। কখনও দেখিনি সাংবাদিকরা কার্যত গণশত্রুতে পরিণত হয়েছেন। ‘ইয়েলো জার্নালিজ়ম’, ‘টাকা খেয়ে লেখা’র মতো অভিযোগ এমন পাইকারি হারে নিক্ষিপ্ত হতে দেখিনি।

হঠাৎ কী বদলে গেল এমন? সাংবাদিকরা নিরপেক্ষতা হারিয়েছেন? পরিণত হয়েছেন দলদাসে? ‘রাজনৈতিক প্রভু’র বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছেন? এই অভিযোগগুলোর সত্যাসত্য বিচার আমার কাজ নয়। শুধু মনে করিয়ে দিই, অভিযোগগুলোর একটাও নতুন নয়। এখন ভারত যে পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তার সঙ্গে তুলনা হতে পারে কেবলমাত্র ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থার। ইন্দিরা গাঁধীর বিরোধিতা করে জেল খেটেছিলেন সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার। দেশের সাংবাদিকদের সম্বন্ধে তাঁর একটি প্রবাদপ্রতিম উক্তি— ‘হোয়েন দে ওয়্যার আস্কড টু বেন্ড, দে ক্রলড’। তাঁদের যখন শুধুমাত্র ঝুঁকতে বলা হয়েছিল, তাঁরা মাটিতে শুয়ে পড়ে বুকে হেঁটেছিলেন, স্বেচ্ছায়। আজকের সাংবাদিকরা কি তার চেয়েও বেশি ‘ক্রল’ করছেন? বেশির ভাগ সাংবাদিক সম্বন্ধে তাঁদের প্রবলতম বিরোধীরাও সম্ভবত এই অভিযোগ করবেন না। তা হলে? জরুরি অবস্থার সময়ও যদি মানুষ সাংবাদিকদের ওপর বিশ্বাস না হারান, এখন কী এমন হল যে সাংবাদিকরা গণশত্রু হয়ে উঠলেন? শুধুমাত্র আন্দোলনরত ডাক্তারদের চোখেই নয়, তার বাইরে থাকা অসংখ্য সাধারণ মানুষের চোখেও— সামান্য দ্বিমত হলেই যাঁরা সটান হোয়াটসঅ্যাপ করে জানিয়ে দিতে পারেন, বিকিয়ে যাওয়া কলম থেকে এর চেয়ে ভাল কিছু বেরোনো সম্ভব নয়।

Advertisement

হঠাৎ কী হল, সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একটা ব্যক্তিগত গল্প বলি। এনআরএস-কাণ্ড তখন তুঙ্গে। সাংবাদিক-নিগ্রহ হয়ে গিয়েছে, ভাঙা হয়ে গিয়েছে ক্যামেরা। ফেসবুকে আমার এক অতি সজ্জন, সুভদ্র ও পণ্ডিত বন্ধু খতিয়ান দিলেন, গত কয়েক বছরে পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন পেশার মানুষের ওপর কতগুলো আক্রমণ হয়েছে। সেই তালিকায় ডাক্তাররা আছে, পুলিশ আছে, শিক্ষক-অধ্যাপক, উকিল, বিডিও— সব আছে, নেই শুধু সাংবাদিকদের উল্লেখ। জানতে চাইলাম, সাংবাদিকদের কথা নেই কেন? বন্ধুবর উত্তর দিলেন, মিসটেক, মিসটেক! সেই ‘মিসটেক’ অবশ্য তাঁর একার নয়— রাজনীতির হাতে, এমনকি অ-রাজনীতির হাতে মার খাওয়া পেশাদারদের তালিকায় সাংবাদিকদের উল্লেখ করতে ভুল হয়ে যাচ্ছে অনেকেরই। ডাক্তাররা কেন সাংবাদিকদের শত্রু ঠাহরালেন; সাধারণ মানুষ কেন সোশ্যাল মিডিয়া থেকে ব্যক্তিগত আলাপচারী, সর্বত্র কাঠগড়ায় তুলল সাংবাদিকদের; কেন প্রবল রাজনীতিসচেতন নাগরিকও ভুলে গেলেন মার খাওয়া পেশাদার হিসেবে সাংবাদিকদের কথা, সব ক’টা প্রশ্নের উত্তর বাঁধা আছে একটা সুতোয়।

সেই সুতোর দৈর্ঘ্য মাত্র কয়েক বছরের। যখন থেকে ‘ফেক নিউজ়’ কথাটা প্রচলিত হল। ট্রাম্প থেকে মোদী, তাবৎ নেতারা মিডিয়াকে দেগে দিলেন মিথ্যে খবরের কারবারি বলে। সুযোগ পেলেই তাঁরা মিডিয়াকে মনে করিয়ে দিলেন তাদের দায়িত্বের কথা। নরেন্দ্র মোদী মিডিয়াকে মিথ্যাবাদী বলেন বলেই হঠাৎ সবাই মিডিয়াকে মিথ্যেবাদী ভেবে বসল, খড়্গহস্ত হল সাংবাদিকদের ওপর, এমন অদ্ভুতুড়ে দাবি করছি না। আমার যে বন্ধুটির ফেসবুক পোস্টের কথা লিখলাম, তিনি নির্ভেজাল মোদী-বিরোধী। মোদীর কথায় ভেসে যাওয়ার সম্ভাবনাটুকুও নেই তাঁর। কিন্তু, গোয়েব্‌ল্‌স সাক্ষী, বারে বারে একই কথা বলতে থাকলে এক সময় মানুষ বিশ্বাসও করে ফেলেন সেই কথায়। প্রথমে অল্প কয়েক জন করেন। তার পর, তাঁদের মুখে সেই বিশ্বাসের কথা শুনে আরও কিছু লোক বিশ্বাস করেন। তার পর আরও অনেকে। গোয়েব্‌ল্‌সের যা ছিল না, এখনকার নেতাদের আছে— তার নাম সোশ্যাল মিডিয়া, আইটি সেল। গত কয়েক বছরে এমন কতগুলো মেসেজ পেয়েছেন, যার মূল বক্তব্য— প্রথাগত সংবাদমাধ্যম এই খবরগুলো দেখায় না, তাই মেসেজ ফরওয়ার্ড করে অনেক সংখ্যক লোককে জানাতে হবে? হয়তো সেই ফরওয়ার্ডগুলোয় বিশ্বাস করেননি— অনেকেই যদিও করেছেন— কিন্তু, ক্রমাগত মেসেজ পেতে পেতে মনের কোথাও যে সংবাদমাধ্যম সম্বন্ধে অবিশ্বাস তৈরি হয়নি, সে কথাই বা জোর দিয়ে বলি কী করে? ‘প্রেস্টিটিউট’ কথাটা তো আর অকারণে ছড়িয়ে পড়েনি।

এ দিকে, সাংবাদিকদের একমাত্র পুঁজি মানুষের মনে তাঁদের প্রতি, তাঁদের নিরপেক্ষতার প্রতি, বিশ্বাস। তাঁরা মানুষের স্বার্থে কথা বলবেন, এই বিশ্বাসই সাংবাদিকতাকে বৈধতা দেয়। মোদীদের কৃতিত্ব, তাঁরা এই বিশ্বাসের জায়গাটাকে ভেঙে দিতে পেরেছেন, কেড়ে নিতে পেরেছেন সংবাদমাধ্যমের বৈধতা। বুঝিয়ে দিতে পেরেছেন, সাংবাদিকরা আসলে শত্রু— যখনই তাঁরা কারও অবস্থানের বিরুদ্ধে লেখেন, সেই বিরুদ্ধতা নৈতিকতাপ্রসূত নয়, সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে নয়, নেহাতই শত্রুতার কারণে, শত্রুপক্ষের দালালি করতে, তাদের টাকা খেয়ে লেখা। অতএব, নরেন্দ্র মোদীর সমালোচনা করে কোনও উত্তর-সম্পাদকীয় লিখলে এখন অনেকেই নিঃসংশয়ে জানতে চান, কংগ্রেস কত টাকা দিল? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোনও সিদ্ধান্তের নেতিবাচক রিপোর্টিং হলে ধরে নেওয়া যায়, সাংবাদিকটি বিজেপির খাতায় নাম লিখিয়েছেন। এনআরএস-এর বিক্ষোভরত ডাক্তাররাও সাংবাদিকদের শত্রু ভাববেন, তাতে অবাক হব কেন?

সোশ্যাল মিডিয়া এসে আরও একটা সুবিধা করে দিয়েছে। আগে নিজের কথা অনেকের কাছে পৌঁছে দিতে গেলে সংবাদমাধ্যমের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। এখন নরেন্দ্র মোদী জানেন, এনআরএস-এর ডাক্তাররাও জানেন, এখন আর খবরের কাগজ, টিভির দরকার নেই— ফেসবুক-টুইটারে ছড়িয়ে যেতে পারবে সে কথা। এখানেই ভেঙে গেল শেষ আগলটাও। যে শত্রুর সঙ্গে স্বার্থের সম্পর্কেরও প্রয়োজন নেই, তার সঙ্গে প্রকাশ্যেই শত্রুতা করা যায়। অতএব, কারণে হোক বা অকারণে, সাংবাদিকদের ওপর ক্ষোভ উগরে দিতে দ্বিতীয় বার ভাবেনি এই আন্দোলন।

তবে, নাগরিক সমাজের জন্য একটা দুঃসংবাদ আছে। সংবাদমাধ্যম বৈধতা হারালে সবচেয়ে বেশি লাভ রাজনীতিকদের। নরেন্দ্র মোদীদের। সোশ্যাল মিডিয়া তো আসলে ততখানিও গণতান্ত্রিক নয়। সবাই যতই ভাবুন, সবার গলার আওয়াজ সমান দূরে পৌঁছয় না। সবচেয়ে বেশি দূরে পৌঁছয় নরেন্দ্র মোদীদের কণ্ঠস্বরই। কারণ সহজ— তাঁদের ‘ফলোয়ার’-এর সংখ্যা অগণিত, আর তাঁদের হাতে আইটি সেলের ‘অ্যাম্পলিফায়ার’ আছে, যা তাঁদের যে কোনও কথাকেই পৌঁছে দিতে পারে সাড়ে বাষট্টি কোটি মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর কাছে। নাগরিক সমাজের কোনও আন্দোলনের আওয়াজ, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া, এই দূরত্ব পাড়ি দিতে পারবে না। বেশ কিছু বছর হল, সনাতন সংবাদমাধ্যমকে সরিয়ে নরেন্দ্র মোদী সোশ্যাল মিডিয়াকেই জনসংযোগের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এখন বিশ্বাস হারিয়ে নাগরিক সমাজও সরিয়ে দিচ্ছে মেনস্ট্রিম মিডিয়াকে, সোশ্যাল মিডিয়াকে সংবাদ দেওয়ার ও নেওয়ার নির্বিকল্প মাধ্যম হিসেবে দেখছে। কোনও তির্যক, অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখোমুখি না হয়েই নরেন্দ্র মোদীরা অসংখ্য মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারছেন নিজেদের ‘মন কি বাত’। গণতন্ত্রে সংবাদমাধ্যমের প্রধানতম কাজ ছিল ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা— সংবাদমাধ্যমকে অবৈধ প্রতিপন্ন করে ক্ষমতা সেই কঠিন প্রশ্নগুলোকে ফেলে দিতে পেরেছে বাতিল নিউজ়প্রিন্টের গাদায়।

আজ না হোক, পরশুর পরের দিন নাগরিক সমাজকে যখন এই রাজনৈতিক ক্ষমতার উল্টো দিকে দাঁড়াতে হবে, তাঁদের কথা পৌঁছবে তো বৃহত্তর জনসমাজের কাছে? সেই কথা ‘বৈধ’ বলে গণ্য হবে তো? আইটি সেল তখন তাঁদের অবস্থানকেও ফেক নিউজ় বলে দেগে দেবে না তো?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement