প্রতীকী ছবি।
২০১৯-২০ অর্থবর্ষের চতুর্থ তথা শেষ ত্রৈরাশিকের পরিসংখ্যান সদ্য প্রকাশিত হইয়াছে— জানুয়ারি হইতে মার্চের মধ্যে ভারতে আর্থিক বৃদ্ধির বার্ষিক হার দাঁড়াইয়াছে ৩.১ শতাংশে। সতেরো বৎসরে সর্বনিম্ন। গত শতকের পঞ্চাশ হইতে সত্তরের দশকে ভারতের জাতীয় আয়ের গড় বার্ষিক সাড়ে তিন শতাংশ হারে বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা দেখিয়া, খানিক পরিহাসচ্ছলেই, অর্থশাস্ত্রীদের কেহ কেহ তাহার নাম দিয়াছিলেন হিন্দু রেট অব গ্রোথ। দেশ জুড়িয়া হিন্দুত্ববাদের মহাপ্লাবনে অর্থব্যবস্থাও সেই হিন্দু বৃদ্ধির হারে— বস্তুত, উগ্র হিন্দু বৃদ্ধির হারে— ফিরিয়া গিয়াছে, ইহা ভিন্ন এই ৩.১ শতাংশ বৃদ্ধির হারে নরেন্দ্র মোদীদের পক্ষে ইতিবাচক কিছু নাই। থাকিতে পারে না। গোটা বৎসরের বৃদ্ধির হার আসিয়া ৪.২ শতাংশে ঠেকিয়াছে— গত এগারো বৎসরে এই হার এত কমে নাই। স্মর্তব্য, সেই এগারো বৎসরের মধ্যে পাঁচ বৎসর ছিল দ্বিতীয় ইউপিএ-র শাসনকাল, যাহার বিরুদ্ধে নীতিপঙ্গুত্ব, আর্থিক গতিহীনতার ইত্যাদির অভিযোগ তুলিয়াই নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রিত্বের পথে যাত্রা শুরু করেন। বলিয়াছিলেন, অর্থনীতির অচ্ছে দিন আনিয়া দিবেন। ফিরাইয়া আনিয়াছেন হিন্দু রেট অব গ্রোথ— মনমোহন সিংহের আমলও নহে, সটান নেহরু-ইন্দিরা জ়মানা। এবং, অদৃষ্টের পরিহাস! মার্চ মাসে যখন লকডাউন ঘোষণা করিতে বাধ্য হইলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, তখন ২০১৯-২০ অর্থবর্ষের শেষ ত্রৈমাসিকটি ফুরাইতে আর মাত্র দিনসাতেক বাকি। অর্থাৎ, এই বিপর্যয়ের দায় লকডাউনের ঘাড়ে চাপাইয়া দিবেন, ক্যালেন্ডারের পাতা সেই উপায়টি রাখিল না। বস্তুত, লকডাউনের সূচনা যেহেতু কার্যত নূতন অর্থবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকের সহিত হইয়াছিল, ফলে ২০১৯-২০ অর্থবর্ষের পরিসংখ্যান একেবারে মাপকাঠি হইয়া থাকিল— কোভিডের কারণে কতখানি ক্ষতি হইয়াছে, আর কতখানি ক্ষতির কৃতিত্ব একান্তই নরেন্দ্র মোদীদের, তাহা মাপিয়া ফেলা সহজ হইবে। এবং, সেই মাপ কেন্দ্রের কর্তাদের মনপসন্দ হইবে বলিয়া মনে হয় না।
অর্থনীতি এমন বেহাল হইল কেন, সেই কারণটি সন্ধান করিলে নয়াদিল্লির দায় আরও স্পষ্ট হইবে। মার খাইয়াছে উৎপাদনক্ষেত্র এবং নির্মাণক্ষেত্র। বাজারে চাহিদা না থাকার কারণে উৎপাদন ক্ষেত্রে সঙ্কোচন ঘটিতেছে। অন্য দিকে, ব্যাঙ্ক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে যে সঙ্কট তৈরি হইয়াছে, তাহার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়িয়াছে নির্মাণ ক্ষেত্রে। গ্রস ফিক্সড ক্যাপিটাল ফর্মেশন বা স্থায়ী মূলধন সৃষ্টির হার বিনিয়োগের একটি স্বীকৃত সূচক। গত তিনটি ত্রৈমাসিকে এই মূলধন সৃষ্টির পরিমাণ সমানেই কমিয়াছে। এই পরিস্থিতিটির দায় বিশ্ব অর্থনীতির ঘাড়েও চাপানো মুশকিল, কারণ গত অর্থবর্ষে চিনের আর্থিক বৃদ্ধির হার ৬.১ শতাংশ— ভারতের তুলনায় দুই শতাংশ-বিন্দু বেশি। সহজ কথায়, ভারতে যে বিপত্তি ঘটিয়াছে, তাহা ভারতের কারণে— শাসকদের ভ্রান্ত আর্থিক পরিচালনার ফল। তাহার আর একটি প্রমাণ রাজকোষ ঘাটতির হার। ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে সেই ঘাটতির পরিমাণ জিডিপি-র ৪.২ শতাংশে দাঁড়াইয়াছে। সাধারণ মানুষকে অর্থসাহায্য করিতে গিয়া ঘাটতি বেলাগাম হয় নাই, হইয়াছে মূলত দুইটি কারণে— এক, রাজস্ব আদায়ে শ্লথতা; এবং দুই, অর্থব্যবস্থার গতিভঙ্গ। আর্থিক প্যাকেজের নামে পাঁচ দিন ধরিয়া কেন ধোঁকার টাটি সাজাইতে হয়, তাহা ক্রমে স্পষ্টতর। অর্থনীতির যে হাল তাঁহারা করিয়াছেন, তাহাতে সরকারের হাত-পা বাঁধা। মনিটারি স্টিমুলাসের গল্প ভিন্ন তাঁহাদের ঝুলিতে বিশেষ কিছু থাকিতে পারে না— সেই অবকাশ তাঁহারা রাখেন নাই। এবং, এই দায়টি নেহরুর নহে, পাকিস্তানের নহে, কোভিডেরও নহে— একান্ত ভাবেই নরেন্দ্র মোদীদের। তাঁহারা অবশ্য দায় ভুলিয়া ভরসাফূর্তি উৎসবে ব্যস্ত। শয্যাশায়ী অর্থনীতির শিয়রে বসিয়া উড়ানের নূতন খোয়াব বেচিতেছেন।