অপচয় যথেচ্ছ হইলে কুবেরের ভাণ্ডারও নিঃশেষ হয়। কলিকাতার জলসঞ্চয়ের অবস্থাও অনুরূপ। গত কয়েক দিনের সংবাদে প্রকাশ, কলিকাতার ভূগর্ভস্থ জলস্তর উদ্বেগজনক হারে নামিতেছে, এবং প্রস্থে কমিতেছে গঙ্গা। অর্থাৎ, তলে তলে শুকাইতেছে শহর। তীব্র জলসঙ্কট শুধুমাত্র এখন সময়ের অপেক্ষা। অথচ এতগুলি প্রমাণ হাতে লইয়াও না-বুঝিবার ভান করিতেছে রাজ্য সরকার। গত বৎসরই সারা ভারত দেখিয়াছিল, প্রাক্-বর্ষার শুকনো মরসুমে চেন্নাইবাসী বালতি-কলসি লইয়া জলের লাইনে দাঁড়াইয়া আছে। সেই সময়ই বিশেষজ্ঞেরা পুনরায় সতর্ক করিয়াছিলেন, অদূর-ভবিষ্যতে তীব্র জলসঙ্কট অপেক্ষা করিতেছে কলিকাতার জন্যও। কিন্তু সঙ্কটমোচনে যে যুদ্ধকালীন তৎপরতার প্রয়োজন ছিল, তাহার দেখা মিলে নাই। কেন মিলে নাই, তাহার প্রত্যক্ষ কারণটি অবশ্যই রাজনৈতিক। জলের অপচয় রোধ এবং যথাযথ সংরক্ষণ করিতে হইলে টান পড়িবে জনমোহিনী নীতিতে এবং শেষপর্যন্ত ভোটবাক্সে। নির্বাচনী হিসাবনিকাশে ব্যস্ত রাজনীতিবিদেরা তাই জলসংক্রান্ত বিধিনিষেধ জলেই পাঠাইয়াছেন। এত দিনেও জলকর বসাইবার প্রস্তাবটি কার্যকর না হইবার কারণ ইহাই। নিয়ম হইয়াছে, ‘রেনওয়াটার হারভেস্টিং’-এর ব্যবস্থা না করিলে বহুতলের নকশা অনুমোদন পাইবে না। কয়টি বহুতল নিয়ম মানিয়া বৃষ্টির জল সংরক্ষণের ব্যবস্থা করিয়াছে? হিসাব নাই। জলের সরবরাহ ও খরচের হিসাব পাওয়ার জন্য মিটার বসাইবার হারও ০.৫ শতাংশের উপরে উঠে নাই।
বস্তুত, জলসঙ্কটের মোকাবিলায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার এখনও প্রস্তাব, পরিকল্পনা, আবেদনের স্তরটি ছাড়াইয়া খুব বেশি অগ্রসর হয় নাই, হইতে চাহেও নাই। শহরে পুরসভা-কর্তৃক পরিস্রুত জলের বণ্টন এখনও অসম। বেআইনি গভীর নলকূপের ব্যবহার এখনও চলিতেছে। সিজিডব্লিউবি-র তথ্য বলিতেছে, প্রতি বৎসর ষোলোটি বরোয় গড়ে ১১-১৬ সেন্টিমিটার করিয়া জলস্তর নামিতেছে। এই বিপুল পরিমাণ ক্ষতি পূরণ বা ‘রিচার্জ’ করিবার জন্য কোনও সুনির্দিষ্ট নীতি এখনও কার্যকর হয় নাই। অধিকাংশই পরিকল্পনার স্তরে পড়িয়া আছে। ‘রিচার্জ’ করিবার জন্য পর্যাপ্ত পুকুর খননের প্রয়োজন ছিল। অথচ পুরসভার নথি অনুযায়ী, ২০১০ সাল হইতে পরবর্তী পাঁচ বৎসরে কলিকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সাতশত-রও অধিক পুকুর বেআইনি ভাবে ভরাট করা হইয়াছে। অবশিষ্ট যে তিন সহস্রাধিক পুকুর আছে, তাহাদের রক্ষণাবেক্ষণ হইলেও ক্ষতি অনেকটাই পূরণ হয়। অনস্বীকার্য যে, সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটির খরচ বিপুল এবং কলিকাতা পুরসভার পক্ষে সেই ব্যয় বহন করা অ-সম্ভব। কিন্তু বিষয় যেখানে জল, সেখানে অর্থ সংগ্রহের বিকল্প পথগুলি লইয়া উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজন ছিল ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলনের সীমা নির্দিষ্টকরণ, কঠোর নজরদারি এবং নিয়মভঙ্গে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা। দুর্ভাগ্য, সবেতেই বিরাট ফাঁক থাকিয়া গিয়াছে। ফলাও করিয়া বৃষ্টির জল সংরক্ষণের কথা বলা হইলেও শহরাঞ্চলে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় সেই প্রক্রিয়া কী ভাবে সম্ভব হইবে, তাহাও স্পষ্ট করা হয় নাই। কলিকাতার শিয়রে এখন শমন। শুধুমাত্র পরামর্শে এই মহাবিপদ কাটিবে না। প্রয়োজন, কার্যকর পদক্ষেপের। তাহা যত ধীরগতি হইবে, শহরের নির্জলা হইবার সম্ভাবনা তত প্রকট হইবে।