পাছে তিনি সরকার থেকে সমর্থন তুলে নেন, সেই আশঙ্কায় বিহারে মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিটি তাঁকেই ছাড়লেন বটে অমিত শাহ, কিন্তু দু’পাশে বসিয়ে দিলেন বিজেপির দুই উপমুখ্যমন্ত্রী। চতুর্থ বার বিধানসভা নির্বাচনে জিতে সপ্তম বার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়া নীতীশ কুমারের ওপর শরিক দলের চাপ ঠিক কতখানি, উপমুখ্যমন্ত্রী পরিবেষ্টিত নীতীশ কুমারের ছবিটা যেন তার প্রতীক।
অথচ, এমন ছিল না আষাঢ়-শেষের বেলা। বিহারের রাজনীতিতে নীতীশ কুমার নিজের ব্র্যান্ড তৈরি করেছিলেন সচেতন ভাবে— এক দিকে লালু প্রসাদের যাদব-আধিপত্য ভেঙে মহাদলিত রাজনীতির সমীকরণ, আর অন্য দিকে সড়ক-সাইকেল-সুশাসনের উন্নয়নমুখী কর্মসূচি, যাতে গ্রামীণ বিহার জুড়তে পারে বাজারের সঙ্গে। ২০১০ সালে নীতীশ যখন দ্বিতীয় বার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন— বিধানসভায় তাঁর দলের আসনসংখ্যা বেড়েছিল ২৭টা— গোটা রাজ্য বিশ্বাস করেছিল, এই লোকটাই পারেন বিহারের গায়ের সঙ্গে লেপ্টে থাকা ‘বিমারু’ বিশেষণটাকে মুছে দিতে। বিহারের রাজনীতিতে নীতীশ কুমার তাঁর নিজস্ব অর্থে অ-দ্বিতীয় হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।
সেই ‘নিজস্ব অর্থ’টা কী? বিহারের রাজনীতিতে তাঁর উত্থান জয়প্রকাশ নারায়ণ-সত্যেন্দ্র নারায়ণ সিংহদের হাত ধরেই। সেই জনতা-উত্তরাধিকার তিনি ছাড়েননি। আবার, আটকে থাকেননি সেই পরিচিতিটুকুতেই। তিনি এনডিএ-র দীর্ঘ দিনের শরিক, কিন্তু বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি থেকে নিজের দূরত্ব জনমানসে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। নরেন্দ্র মোদীকে বিহারে ব্রাত্য রেখেছিলেন— নির্বাচনী প্রচারের মঞ্চে, এমনকি নৈশভোজের আসরেও। নীতীশ নিজে বারংবার বলেছেন যে, বিহারের বাইরে কোনও সর্বভারতীয় উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাঁর নেই, কিন্তু প্রাক্-২০১৪ মোদীর বিকল্প হিসেবে বারে বারেই উঠে আসত তাঁর নাম। অন্য দিকে, তিনি জাতপাতের রাজনীতিতে আছেন— লালু প্রসাদের যাদব-আধিপত্যের বিরুদ্ধে তিনি মহাদলিত রাজনীতি তৈরি করেছিলেন— কিন্তু, নিম্নবর্ণের আত্মপ্রজ্ঞাপনের রাজনীতি, সামাজিক ন্যায়ের রাজনীতি মানেই যে তার সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিরোধ, মানুষের মনে এই প্রতিষ্ঠিত সমীকরণটাকে ভেঙেছিলেন নীতীশ। তাঁর রাজনীতির ব্র্যান্ডকে যদি চিহ্নিত করতে হয়, তবে সেটা এই রকম: তিনি সামাজিক ন্যায়ের রেলগাড়িকে জুড়তে চেয়েছিলেন বাজারের ইঞ্জিনের সঙ্গে।
রাজনীতি হিসেবে সেটা কোন গোত্রের, সেই প্রশ্ন আপাতত থাক। কিন্তু, নিজের সেই রাজনীতিতে নীতীশের ভরসা ছিল বিলক্ষণ। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে দলের ভরাডুবির দায় মাথায় নিয়ে মুখ্যমন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেছিলেন নীতীশ। ফিরে আসবেন, বিশ্বাস ছিল তাঁর। ফিরলেনও ২০১৫ সালে। বিজেপির সঙ্গে নয়, চির-প্রতিদ্বন্দ্বী লালু প্রসাদ যাদবের রাষ্ট্রীয় জনতা দলের সঙ্গে মহাগঠবন্ধন তৈরি করে। ভারতের রাজনীতিতে এক অনতিক্রম্য শৃঙ্গ হয়ে থাকতে পারত এই জয়— এক নৈতিকতার জয়, যেখানে সাম্প্রদায়িক শক্তির থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে চির-প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে ঘর করতেও দ্বিধা করেননি এক নেতা। সেই উচ্চতা থেকে স্বেচ্ছায় স্খলিত হলেন নীতীশ। লালু-তনয় তেজস্বীর সঙ্গে বিবাদে মহাগঠবন্ধন ভেঙে বেরিয়ে এলেন। যে বিজেপি-কে ঠেকাতে তৈরি করেছিলেন এই অসম্ভবের জোট, সেই বিজেপির সমর্থন নিয়েই ফের শপথ নিলেন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে।
তার পর, শুধু পিছলে পড়েছেন নীতীশ। দীর্ঘ পনেরো বছরের সিংহভাগ বিহারের মুখ্যমন্ত্রী থাকার পরও তাঁর নামে কোনও উল্লেখযোগ্য দুর্নীতির অভিযোগ নেই, রাজ্যে মদ নিষিদ্ধ করে মহিলাদের আশীর্বাদধন্য তিনি— তবুও, এই নির্বাচনের প্রচারে তাঁকে বলতে হল, এটাই তাঁর শেষ ভোট-যুদ্ধ। যে নরেন্দ্র মোদীকে ব্রাত্য রেখেছেন সারা জীবন, প্রকাশ্য জনসভায় সেই মোদীর উন্নয়নের মডেলের ভরসাতেই ভোট চাইতে হল। শেষরক্ষা হল না তবুও। বিহারে জেডি(ইউ) এখন এনডিএ-র ছোট শরিক, এই প্রথম বার।
তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্ব এখন বিজেপির মর্জির উপর নির্ভরশীল, এটা তবুও নীতীশের চরম পরাজয় নয়। নিজের উন্নয়ন-কর্মসূচির উপর ভরসা হারিয়েছেন তিনি, এটাও চূড়ান্ত পরাভবের সূচক নয়। এই নির্বাচনে বিহারের মানুষ আসলে জানিয়ে দিল একটা কথা— যে নৈতিকতার জোরে এনডিএ-তে থেকে, বিজেপির শরিক হয়েও নীতীশ পৃথক ছিলেন, সেই জোরটা ভেঙে গিয়েছে তাঁর। বিহার তাঁকে শুধু ক্ষমতালোভী এক প্রৌঢ় রাজনীতিক হিসেবে দেখে ফেলেছে। মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সি ধরে রাখার জন্য কিছুতেই যাঁর আপত্তি নেই।
কুর্সি থাকল তাঁর। নৈতিক জোর নয়।