ছবি: পিটিআই।
চক্রব্যূহে প্রবেশের জন্য ও তাহা হইতে বাহিরে আসিবার জন্য মহাভারতে দুই রকমের কৌশল ছিল। একটি শিখিলে এবং অন্যটি না শিখিলে কী দশা হইবার কথা, মহাকাব্যের পাঠক মাত্রেই জানেন। ভারতবর্ষের লকডাউনের ক্ষেত্রে অবশ্য প্রবেশ-মন্ত্রটিই উত্তম রূপে চর্চিত ও প্রযুক্ত হয় নাই, সুতরাং বাহির হইবার মন্ত্রটি কী হইবে, ভাবিয়া সচেতন নাগরিক বিষম উদ্বিগ্ন হইয়া পড়িলে দোষ দেওয়া যায় না। গত দুই দিনে কেন্দ্র ও রাজ্য দুই স্তরেই লকডাউন পঞ্চম দশার ঘোষণা শোনা গেল। ঘোষণাবলি হইতে স্পষ্ট যে জুন মাসের প্রথম দিবস হইতে এই বার ‘আনলক’ পর্বের সূচনা। এ দিকে, বেণী বাঁধা যেখানে ঠিক পথে হয় নাই, বেণী খুলিতে গেলে জট পড়িবার প্রভূত আশঙ্কা। নয় সপ্তাহব্যাপী লকডাউন ভাঙিবার পথটি তো কেবল ধাপে ধাপে তৈরি করাই জরুরি নহে, কোন পথ কোন ধাপে খোলা উচিত, এবং কোন পথ না খোলা উচিত, এই নির্ধারণও একটি অত্যন্ত জরুরি কাজ। আরও একটি বস্তু জরুরি: কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারের সমন্বয়। বাস্তবিক, লকডাউন তুলিবার পর্যায়ে পরিকল্পনা এবং সমন্বয়ের চরিত্রের উপরই নির্ভর করিবে গত কয়েক মাসের করোনা-সংগ্রামের সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা। সমগ্র দেশ বন্ধ করিয়া, অগণিত মানুষকে অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে ঠেলিয়া দিয়া যে লকডাউন যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হইল, এই পর্যায়ের দক্ষ পরিচালনার অভাবে না তাহার পুরাটাই বানচাল হয়! স্মরণে রাখা ভাল যে ভারতের অপেক্ষা অনেক সুষ্ঠু সরকারি পরিকল্পনা ও অনেক পরিব্যাপ্ত নাগরিক নিয়মানুবর্তিতা সত্ত্বেও ফ্রান্স বা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশে লকডাউন শিথিল করিবার সঙ্গে সঙ্গেই করোনাভাইরাস সংক্রমণ পুনরায় প্রবল পরাক্রমে তাহার দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করিয়াছে। এমতাবস্থায় ভারতের শিথিল, নিয়মভাঙা সমাজ এবং পরিকল্পনারহিত, সমন্বয়বিহীন (কিংবা সমন্বয়বিরোধী) প্রশাসন কী ভাবে অবস্থা সামাল দিবে— দুর্ভাবনার বিষয় বটে।
পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এখনই কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠিতেছে। প্রথমত, কেন হঠাৎ প্রথমেই ধর্মস্থানগুলি খুলিবার দরকার পড়িল? লকডাউনের কারণে বিধ্বস্ত অর্থনীতির ঘায়ে বিপন্ন বিপর্যস্ত মানুষের জীবন ও জীবিকার জন্য কাজের পরিসরটি কিয়ৎ পরিমাণে শৃঙ্খলমুক্ত করিবার কথা প্রথম দিকে। তাহার সহিত মন্দির মসজিদ গির্জার সম্পর্ক কী? ধর্মাচরণ কি আর কিছু দিন স্বগৃহে স্বদায়িত্বে করা যায় না? দ্বিতীয়ত, বাসে সব আসন ভর্তি করিবার অনুমতিই বা কেন? ইহাতে পারস্পরিক স্পর্শসংযোগ কত পরিমাণে বাড়ে, তাহা বোঝা কঠিন নহে। এমনিতেই নিয়ম ভাঙিয়া বাসে ভিড় বাড়াইতে পশ্চিমবঙ্গবাসী পরমাগ্রহী। দরকারে কন্ডাক্টর ও পুলিশের সহিত অন্যায় সমঝোতা/ সংঘর্ষেও পিছপা নহে। তাহার উপর এই সিদ্ধান্ত কি পরিস্থিতি আরওই ঘোরালো করিতেছে না? তৃতীয়ত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিষয়েও অপ্রয়োজনীয় তাড়াহুড়া। অরেঞ্জ আর গ্রিন জ়োনে বিদ্যালয় নিয়মিত ক্লাসের সময়, এবং বিপন্নতর অঞ্চলে কলেজ-বিদ্যালয় শুরু করিবার সময় যেহেতু মিলাইতেই হইবে, এই মুহূর্তে তাহা না ভাবাই সর্বাপেক্ষা যুক্তিসঙ্গত।
এমনিতেই রাজ্যের কিছু অংশে (কনটেনমেন্ট জ়োন) সামগ্রিক লকডাউন, এবং কিছু অংশে প্রায়-স্বাভাবিক জীবনযাপন একটি চূড়ান্ত বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি। উপায়ান্তরবিহীন সেই সিদ্ধান্ত তখনই সফল ভাবে কার্যকর করা সম্ভব, যদি মানুষ অবস্থার গুরুত্ব বূঝিয়া নিষ্ঠার সহিত নির্দেশ পালন করেন। গত দুই মাসের অভিজ্ঞতা বলিতেছে, সেই আশা কম— মরীচিকাসম কম। তাহার উপর যদি সরকারি পরিকল্পনা ও তাহার রূপায়ণে অদক্ষতা, অস্বচ্ছতা ও অপারম্পর্যতা থাকে, তাহা মরীচিকাকে আরও গভীর করিবে। উদ্বেগ আরও বাড়াইবে। সংক্রমণও।