১২ মে, রাত আটটা। টেলিভিশনের পর্দায় প্রধানমন্ত্রী গোটা দেশকে জানালেন, ২০ লক্ষ কোটি টাকার বিপুল আর্থিক প্যাকেজের ব্যবস্থা করেছেন তাঁরা, দেশকে আত্মনির্ভর করে তুলতে। জিডিপি-র দশ শতাংশ। সেই প্যাকেজে কী কী থাকছে, প্রধানমন্ত্রী জানালেন, সেটা অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ঘোষণা করবেন। তার পর টানা পাঁচ দিন অর্থমন্ত্রী সাংবাদিক বৈঠক করে জানালেন, তাঁদের ত্রাণ প্যাকেজে কী কী থাকছে। দেশের জিডিপি-র দশ শতাংশ যদি এই সঙ্কটের সময়ে বাজারের চাহিদা বৃদ্ধিতে খরচ করা হয়, সেটা নিশ্চিত ভাবেই মস্ত পদক্ষেপ। এবং, সেই খরচ দেশকে এই সঙ্কটের কৃষ্ণগহ্বর থেকে টেনে তুলতে পারে। মুশকিল হল, অর্থমন্ত্রীর প্যাকেজটিকে খুলে দেখলে সেই আশাকে বাঁচিয়ে রাখা অসম্ভব।
স্টিমুলাস বা প্রণোদনা দেওয়ার আর্থিক প্যাকেজের কাজটা ঠিক কী? দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিমাণ বাড়ানো এবং তার টানে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি। ‘গ্রোস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট’ বা জিডিপি হল দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন— অর্থাৎ, মানুষ ভোগ বাবদ মোট যা ব্যয় করছেন, ব্যবসায়ীরা মোট যত টাকা লগ্নি করছেন, সরকার মোট যা খরচ করছে, এবং আমদানি বাবদ খরচের চেয়ে রফতানি থেকে পাওয়া টাকার মোট পরিমাণ যতখানি বেশি, তার যোগফল। কোনও আর্থিক প্যাকেজ যত ক্ষণ না এই বিষয়গুলোর অন্তত একটার ওপর প্রভাব ফেলতে পারছে, তত ক্ষণ অবধি তাকে প্রণোদনা বলার কোনও কারণ নেই। অর্থমন্ত্রী যে প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন, তাতে এই অর্থে স্টিমুলাস বলতে বরাদ্দ হয়েছে মাত্র ২.১ লক্ষ কোটি টাকা— অর্থাৎ, ঘোষিত প্যাকেজের দশ ভাগের এক ভাগ। আরও গোলমাল, টাকার অঙ্ক বাড়িয়ে দেখানোর চক্করে সরকার ফিসক্যাল, অর্থাৎ রাজস্ব ব্যবস্থা, আর মনিটারি, অর্থাৎ আর্থিক ব্যবস্থাকে জুড়ে ফেলেছে। এটা করা যায় না— অর্থশাস্ত্রের নিয়মে এটা নিতান্ত ভুল।
রাজস্ব নীতি আর আর্থিক নীতিতে ফারাক কোথায়, একটু ভেঙে বলা যাক। ধরুন, সরকার ঠিক করল, এই দু’পথেই একশো টাকা করে খরচ করা হবে। সত্যিই তা করা হলে দেখা যাবে, এই দুই গোত্রের নীতি সম্পূর্ণ আলাদা পথে কাজ করে, এবং দুটোকে গুলিয়ে ফেলা অনেকটা আম আর আমড়াকে এক করে ফেলার মতো।
রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অনেকগুলো আর্থিক ব্যবস্থা করেছে— ঋণের ওপর সুদের হার কমিয়েছে, ঋণ দেওয়ার নিয়ম শিথিল করে বাজারে নগদের জোগান বাড়িয়েছে, বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলোর হাতে টাকার জোগান দিয়েছে। খেয়াল করে দেখুন, এই নীতিগুলো কাজ করতে পারে দু’ভাবে— এক, আমাদের ভোগব্যয়ের পরিমাণ বাড়াতে অপ্রত্যক্ষ ভাবে সাহায্য করতে পারে (সুদ কম বলে আমরা ঋণ নিয়ে গাড়ি-বাড়ি বা টিভি-ওয়াশিং মেশিন কিনব); অথবা, ব্যবসায়ীরা ঋণ নিয়ে নতুন লগ্নি করতে পারেন। অর্থাৎ, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের হার কমালে সেটা ক্রেতা বা লগ্নিকারীকে ধার করার দিকে ঠেলতে পারে, কিন্তু বাধ্য করতে পারে না।
কাজেই, আর্থিক নীতির মাধ্যমে ১০০ টাকার প্রণোদনা দিলেও সেই টাকা ব্যাঙ্কের কোষাগারেই থেকে যেতে পারে, প্রকৃত উৎপাদনে তার কোনও প্রভাব না-ই পড়তে পারে। যত ক্ষণ না কেউ ধার করে হয় নিজের ভোগব্যয় বা নিজের বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়াচ্ছেন, তত ক্ষণ অবধি এই প্রণোদনার প্যাকেজে অর্থনীতির চাকা ঘুরবে না— প্যাকেজ ঘোষণার আগে জিডিপি বা কর্মসংস্থান যেখানে ছিল, ঘোষণার পরও সেখানেই থাকবে। আজ বাদে কাল চাকরি থাকবে কি না, সেটা সিংহভাগ ক্রেতার কাছেই অনিশ্চিত। আবার, বাজারে চাহিদা আদৌ তৈরি হবে কি না, লগ্নিকারীরা জানেন না। ফলে, সরকার নগদের জোগান বাড়ালেও কেউ ধার করে নিজের ভোগ বা বিনিয়োগ বাড়াবেন, সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। ঘটনা হল, চাকরি বা বাজার সম্বন্ধে এই অনিশ্চয়তা মানুষকে উল্টো পথে ঠেলবে— ক্রেতারা ভোগব্যয় কমিয়ে দুর্দিনের জন্য হাতে টাকা রাখার চেষ্টা করবেন, লগ্নিকারীরা বিনিয়োগের পরিমাণ কমিয়ে লোকসান ঠেকানোর চেষ্টা করবেন।
ফিসকাল বা রাজস্ব প্যাকেজ কাজ করবে সরাসরি। ধরুন, সরকার এই একশো টাকাই খরচ করল পিএম কিসান প্রকল্পে। কৃষকদের হাতে বাড়তি আয় পৌঁছল— এমন টাকা, যেটা তাঁরা অন্য কোনও জায়গা থেকে আগে পাচ্ছিলেন না। তাঁরা সেই আয়ের একটা অংশ, ধরুন পঞ্চাশ টাকা, ভোগব্যয় বাবদ খরচ করলেন। সেই টাকায় আবার সে সব পণ্যের উৎপাদকদের আয় বাড়ল, তাঁরাও সেই বাড়তি আয়ের একাংশ খরচ করলেন ভোগব্যয়ে। এ ভাবে চলতে থাকে— অর্থশাস্ত্রীরা একেই বলেন ‘মাল্টিপ্লায়ার’— অর্থাৎ, প্রাথমিক ভাবে যে একশো টাকা খরচ করা হয়েছিল, মোট অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ে তার চেয়ে ঢের বেশি।
কিন্তু, এই ঘটনাটা ঘটবে তখনই, যখন সরকার এই ১০০ টাকাটা বাড়তি খরচ করবে। যে টাকা আগেই বাজেটে বরাদ্দ ছিল, সেটাই ইধার কা মাল উধার করে দিলে চলবে না। ধরুন, এই একশো টাকাটা বরাদ্দ ছিল একশো দিনের কাজ প্রকল্পে। সেখান থেকে টাকাটা সরিয়ে পিএম কিসানের মাধ্যমে দিলে অর্থনীতির কর্মকাণ্ডে কোনও ফারাক হবে না। কাজেই, কেন্দ্রীয় সরকারের প্যাকেজে এমন রিপ্যাকেজিং ঘটেছে কি না, খোঁজ নিতে হবে সেটাও।
এ বার অর্থমন্ত্রীর ঘোষিত ২০.৯৪ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজটাকে ভেঙে দেখা যাক। এর মধ্যে তিন লক্ষ কোটি টাকা ফিসক্যাল স্টিমুলাস, বাকি ১৭.৯৪ লক্ষ কোটি টাকা মনিটারি স্টিমুলাস। তিন লক্ষ টাকার রাজস্ব প্রণোদনার মধ্যেও খানিকটা বাজেটেই বলা ছিল, কাজেই সেটাকে নতুন খরচ বলার কারণ নেই। নতুন রাজস্ব ব্যয় হল ২.১ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থাৎ, জিডিপির দশ শতাংশ নয়, মেরেকেটে এক শতাংশ। এইটুকু বাড়তি খরচে জিডিপিকে ২০১৯-২০ সালের স্তরেই ধরে রাখা অসম্ভব, বাড়ানোর কথা না তোলাই ভাল। প্রশ্ন উঠবে, সরকার তো নতুন করে ৪.২ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ করার কথা বলেছে। সেটা ঠিকই, কিন্তু গতিক দেখে মনে হচ্ছে, সেই ঋণের অর্ধেকটাই যাবে লকডাউনের ফলে, এবং লকডাউনের আগেই, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতি হারানোর ফলে রাজস্ব খাতে যে ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণ করতে।
কোভিড-১৯’এর ফলে দেশের বিপুল সংখ্যক গরিব মানুষ যে অন্তহীন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন, সেই ব্যাপারে এই সরকার কতখানি অসংবেদনশীল, একটা উদাহরণ থেকেই সেটা বোঝা সম্ভব। লকডাউনের ফলে তাঁদের যে আয়ের ক্ষতি হল, সেটা পুষিয়ে দেওয়ার বদলে কেন্দ্রীয় সরকার তাঁদের জন্য ব্যাঙ্ক ঋণের ব্যবস্থা করল। ভাবতে পারছেন, রাস্তার ধারে ঠেলাগাড়ি লাগিয়ে বাদাম বেচেন যিনি, তিনি ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিতে যাচ্ছেন? বিশেষত সেই সময়, যখন অদূর ভবিষ্যতে তাঁদের আয় সম্পূর্ণ অনিশ্চিত? এমনকি, বেশির ভাগ এমএসএমই-র মালিকও এই অবস্থায় ঋণ নেওয়ার সাহস করবেন না। আর, ব্যাঙ্কগুলোও যে তাঁদের ঋণ দেবে, সেই ভরসা কোথায়? ব্যাঙ্কের চোখে তাঁদের অধিকাংশই ঋণ পাওয়ার অযোগ্য— এমনকি, সরকার সেই ঋণের গ্যারান্টি দিলেও।
আরও একটা কথা এই প্রসঙ্গেই উল্লেখ করা প্রয়োজন— অতিমারির আড়ালে সরকার যে নব্য-উদার সংস্কারগুলোকে দেশের ওপর চাপিয়ে দিল, সেগুলো চরিত্রে গরিব-বিরোধী। কোনওটা শ্রম আইনের পরিপন্থী, কোনওটা কৃষি বাজারকে নিয়ন্ত্রণমুক্ত করছে। এই সংস্কারগুলি আর্থিক সঙ্কটকে আরও বাড়িয়ে তুলবে, গরিবকে আরও বিপন্ন করবে।
কেন্দ্রীয় সরকার আর্থিক সঙ্কটের মোকাবিলায় রাজস্ব নীতির বদলে আর্থিক নীতি ব্যবহার করে বুঝিয়ে দিল, তাদের কাছে দেশের গরিব, খেটে খাওয়া মানুষের চেয়ে আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থার গুরুত্ব অনেক বেশি। রেটিং সংস্থাগুলি বেশি রাজকোষ ঘাটতি পছন্দ করে না মোটেই। দেশের অর্থমন্ত্রী অর্থশাস্ত্রের ছাত্রী ছিলেন— কোনটা ফিসক্যাল পলিসি, আর কোনটা মনিটারি, সেটা তাঁর জানা স্বাভাবিক। কিন্তু তিনিও পর পর পাঁচ দিন টেলিভিশনের ক্যামেরার সামনে মুখের রেখাটি না কাঁপিয়ে এই ভ্রান্ত নীতির কথাই ঘোষণা করে গেলেন।
এই প্যাকেজে কাজ হবে না, সেটা নিশ্চিত। অতএব, ভরসা থাকুক প্রধানমন্ত্রীর থালা বাজানোয় আর অকাল দীপাবলিতে!
অর্থনীতি বিভাগ, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়