ফাইল চিত্র
পশ্চিমবঙ্গ পাল্টায় নাই। আবার, পাল্টাইয়াছেও বটে। শিক্ষক নিগ্রহের ধারা অব্যাহত। এবং, সেই নিগ্রহের সহিত শাসক দলের সম্পর্কও অপরিবর্তিত। তবে, আরাবুল ইসলাম বা শঙ্কুদেব পণ্ডারা ‘তাজা ছেলে’ বা ‘ছোট ছেলে’ হিসাবে ‘ছোট ভুল’ করিয়াও পার পাইতেন। সন্দীপ পাল বা বিজয় সরকারদের গ্রেফতার হইতে হইয়াছে। শানু মাকালকে ক্ষমা চাহিতে হইয়াছে শিক্ষকদের নিকট। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী ফোন করিয়া কোন্নগরের কলেজ শিক্ষকের নিকট দুঃখপ্রকাশ করিয়াছেন। স্থানীয় বিধায়ক ও দলের জেলা সভাপতি কলেজে গিয়া ক্ষমাপ্রার্থনা করিয়াছেন, দিল্লি হইতে ক্ষমা চাহিয়াছেন স্থানীয় সাংসদ। শিক্ষামন্ত্রী জানাইয়াছেন, অ-ছাত্রসুলভ কোনও আচরণ বরদাস্ত করা হইবে না। শিক্ষক নিগ্রহের সহিত পশ্চিমবঙ্গ যতখানি পরিচিত, সদলবলে ক্ষমাপ্রার্থনার সহিত রাজ্যের ততখানি ‘জান-পহেচান’ নাই। কেহ বলিতেই পারেন, হাওয়া অনুকূল নহে বুঝিয়াই এই ক্ষমাপ্রার্থনা। যত দিন অবধি রাজ্যে রাজনৈতিক আধিপত্য নিশ্চিত ছিল, তত দিন অবধি এই ‘ছোট ভুল’গুলি যে আদৌ ‘ভুল’, শাসকরা ভাবেন নাই। এখন জলে-স্থলে-অন্তরিক্ষে পদ্ম ফুটিতে দেখিয়া তাঁহারা ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ করিতে নামিয়াছেন। কারণ যাহাই হউক না কেন, বহু বিলম্বে হইলেও যে বোধোদয় হইয়াছে, তাহা অস্বীকার করা অন্যায় হইবে। ক্ষমা চাহিবার অর্থ, ভুল স্বীকার করিয়া লওয়া। আশা করা যায়, স্বীকার করিবার পর ভুলটি শোধরাইবার চেষ্টাও হইবে।
বস্তুত, ভুল সংশোধনের সেই চেষ্টাটি না হইলে এই ক্ষমাপ্রার্থনা অর্থহীন। বহু দেরি হইয়া গিয়াছে, রোগটি এখন পশ্চিমবঙ্গের শিরা-উপশিরায় বহিতেছে। ফলে, সংশোধনের চেষ্টাও জোরদার না হইলে উপায় নাই। শিক্ষক নিগ্রহের ঘটনায় কাহারা জড়িত, এ যাবৎ কালের কোনও ঘটনাতেই তাহা অজ্ঞাত ছিল না, বর্তমান ক্ষেত্রেও নাই। তাহারা সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের নিকট ক্ষমা চাহিলেই মিটিয়া যায় না— তাহাদের শাস্তির ব্যবস্থা করা জরুরি। অপরাধের গুরুত্ব অনুসারে শাস্তি হওয়াই বিধেয়। অপরাধীকে দল হইতে বিতাড়ন করিতে হইবে এবং পুলিশকে নিজের কাজ করিতে দিতে হইবে। শিক্ষকের উপর চড়াও হওয়া, তাঁহাকে মারধর করা ফৌজদারি অপরাধ। ভারতীয় দণ্ডবিধিতে তাহার যোগ্য শাস্তির ব্যবস্থা আছে। তাহাদের রাজনৈতিক স্নেহাঞ্চলের আড়ালে না রাখিয়া সেই শাস্তির সম্মুখীন হইতে দেওয়া বিধেয়। তাহাতে একই সঙ্গে দুইটি কাজ হইবে। প্রথমত, এই গোত্রের ‘নেতা’রা নিজেদের সংযত করিবার গুরুত্ব বুঝিবেন। দ্বিতীয়ত, রাজ্যবাসীও ভরসা করিতে পারিবে যে মুখ্যমন্ত্রী বেয়াদবদের ক্ষমা করিবেন না। প্রশাসন হাত গুটাইয়া থাকিবে না। আজিকার পশ্চিমবঙ্গে এই বিশ্বাস ফিরিয়া আসিলে তাহার তাৎপর্য প্রশ্নাতীত।
কথাটি শুধু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দিতেই সীমাবদ্ধ নহে। তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনে একটি বিশ্বাস সমাজের গভীরতম প্রান্তে শিকড় গাড়িয়াছে— শাসক দলের হাত মাথায় থাকিলে যে কোনও অন্যায় করিয়া পার পাওয়া যায়। রাজনীতির সহিত মূল্যবোধের সম্পর্ক বহু পূর্বেই হারাইয়াছে, তাহা এই জমানার কৃতিত্ব নহে। কিন্তু, আইনের শাসনের সম্পূর্ণ বাহিরে চলিয়া যাইবার নিশ্চয়তাটি মূলত এই জমানায় অর্জিত। এই নিশ্চয়তার মূলে আঘাত করিতে হইবে। আগামী দেড় বৎসরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়দের প্রধান চ্যালেঞ্জ ইহাই। প্রথমে ভুল স্বীকার করিয়া তাহার পর পুলিশ-প্রশাসনকে নিজের কাজ করিতে দেওয়া জরুরি। আশা থাকিল, বিলম্বে হইলেও মুখ্যমন্ত্রী কথাটি বুঝিয়াছেন। আশা থাকিল, কলেজে ক্ষমাপ্রার্থনায় সেই সংশোধনপর্বের সূচনা হইবে। অন্যায়কে শাসন করিবার অভ্যাসের অভাবে রাজ্য এখন সঙ্কটবিন্দুতে পৌঁছিয়াছে, তাহাকে ফিরাইয়া আনিতে না পারিলে ইতিহাস বর্তমান শাসকদের ক্ষমা করিবে না।