কয়েক মাস আগে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় নিজের মা-কে হারাই। সে-দিন থেকেই মনের মধ্যে অজস্র জিজ্ঞাসা ঘুরপাক খেয়ে চলেছে। কোনওটার উত্তর আছে, কোনও প্রশ্নের উত্তর সারা জীবনের জন্য অজানাই থেকে গেল। কীভাবে ঘটল, কার অসাবধানতা এর জন্য দায়ী— এ সবের কোনও সদুত্তর নেই, নেই কোনও সান্ত্বনাও। যখনই আমরা কোনও কিছুর উত্তর খুঁজে পেতে অপারগ হই, তখনই আমরা ভাগ্যের দোহাই দিই আর সেখানেই যুক্তি-তর্কের ইতি ঘটে। ওই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আমরা এক বারও ভাবার চেষ্টা করি না, ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কী ব্যবস্থা নেওয়া আবশ্যিক।
প্রতি দিন সারা পৃথিবীতে অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটে, যা অনভিপ্রেত। তবুও তার মধ্যে কিছু শতাংশ অবশ্যই প্রতিরোধযোগ্য। সম্প্রতি কর্মসূত্রে স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা বিষয়ক একটা পাঠ্যক্রমের মধ্য দিয়ে যেতে গিয়ে কিছু বিষয় নতুন করে চিন্তার উদ্রেক ঘটাল। স্বাস্থ্য, সুরক্ষা ও নিরাপত্তা প্রতিটি মানুষের জীবনের এক অতি প্রয়োজনীয় দিক। মৌলিক অধিকারও বটে। আমরা যতখানি আমাদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, তার কিছুমাত্র সচেতনতাও যদি সুরক্ষা বা নিরাপত্তার ক্ষেত্রে থাকত, তা হলে অনেক বিপদ এড়ানো যেত। পরিসংখ্যান বলে মোট দুর্ঘটনার ৮০% ঘটে মানুষের অসাবধানতার কারণে। আর ২০% ঘটে প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার কারণে। কারণ যা-ই হোক, দুর্ঘটনার সময় সামগ্রিক পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। মানুষের এই অসাবধানতার মূলে রয়েছে অজ্ঞতা, উপযুক্ত শিক্ষার অভাব, বিপদের সম্ভবনাকে আঁচ করতে পারার অক্ষমতা আর দুর্ঘটনার ভয়ংকর পরিণতি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানের অভাব।
আমাদের দেশে সুরক্ষা সংক্রান্ত প্রচার শুধুমাত্র পথ নিরাপত্তাতেই সীমাবদ্ধ। সেখানেও গোড়ায় গলদ। যে পদ্ধতিতে আমাদের দেশে গাড়ি চালানোর ছাড়পত্র পাওয়া যায়, পৃথিবীর অন্য কোনও উন্নত দেশে তা অকল্পনীয়। আর তার পরিণতিতে হামেশাই ঘটে দুর্ঘটনা। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, আমাদের দেশে ২০১৬ সালে শুধুমাত্র পথ দুর্ঘটনায় প্রতি ঘণ্টায় ১৭ জনের জীবনহানি হয়েছে, প্রতি দিন গড়ে প্রাণ হারিয়েছেন ৪১০ জন। যানবাহন হোক কিংবা পথচারী, রাস্তার সিগনালকে অমান্য করার প্রবণতা বড়ই প্রবল। পথচারীর দোষে দুর্ঘটনা ঘটলেও গাড়ি চালককেই দোষী প্রতিপন্ন করা হয় আর দুর্ঘটনাগ্রস্ত ব্যক্তিটির আপৎকালীন চিকিৎসার ব্যবস্থা করার বদলে পথের দখল তখন চলে যায় এক দল হামলাবাজ মানুষের হাতে, যা রাজপথকে মুহূর্তের মধ্যে রণক্ষেত্রে পরিণত করে দেয়। আসলে কোন পরিস্থিতিতে কী করা উচিত, তার প্রাথমিক শিক্ষাটাই আমাদের অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। উলটে খারাপ সংস্কৃতিকে আমরা রপ্ত করে ফেলি অতি অনায়াসে, যার পরিণতি হয় ভয়ংকর।
যে-কোনও উন্নত দেশে স্বাস্থ্য, সুরক্ষা ও নিরাপত্তা বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষার অবশ্যপাঠ্য। শুধুমাত্র পুঁথিগত শিক্ষাই নয়, ব্যবহারিক শিক্ষাও দেওয়া হয় এবং প্রাত্যহিক জীবনে সবাই সেটা মেনে চলে। চৌমাথার ক্রসিং-এ লাল সিগনাল থাকলে, তার ত্রিসীমানায় একটি গাড়ি না থাকলেও, সবাই সিগনাল সবুজ হওয়া অবধি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেন।
সমস্যা হচ্ছে, আমরা নিজেদের সব সময় সদাব্যস্ত ভাবতে ও দেখাতে ভালবাসি। তাই ধৈর্য ধরা আমাদের ধাতে পোষায় না। বড় সহজেই অধৈর্য হয়ে পড়ি সময় নষ্টের অজুহাত দেখিয়ে। আর তার থেকেই ভুলের সূত্রপাত। সুরক্ষা ও নিরাপত্তার মূল শর্তই হল সর্বপ্রথম নিজের নিরাপত্তা সুরক্ষিত করা, তার পর অন্যের দিকে সাহায্যের হাত বাড়ানো। আগুপিছু না ভেবে বিপদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ার মধ্যে মহত্ত্ব থাকতে পারে, কিন্তু বাস্তবে তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
একটা দেশের উন্নতি শুধুমাত্র কিছু ঝাঁ-চকচকে মল বা ওভারব্রিজের সংখ্যা দিয়ে নির্ধারিত হয় না, সর্বস্তরের নাগরিক সচেতনতা ও তার ঠিক ব্যবহারিক বহিঃপ্রকাশ সামগ্রিক উন্নয়নের অন্যতম মাপকাঠি। আমাদের সব না পারার বা অক্ষমতার পিছনেই আমরা অজুহাত খুঁজি। কখনও বিপুল জনসংখ্যা, কখনও বা দারিদ্র উঠে আসে কারণস্বরূপ। অথচ এগুলো কোনওটাই কোনও কারণ হতে পারে না। যা দরকার, তা হল গঠনমূলক মানসিকতা। আমাদের নিজেদের সুরক্ষার জন্য বা আমাদের পারিপার্শ্বিককে নিরাপদ রাখার জন্য অর্থের থেকে অনেক বেশি জরুরি আমাদের চাওয়া ও সচেতনতাবোধ। আর প্রয়োজন, এই বোধটা সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেওয়া।
প্রচারের মাধ্যমে মানুষকে কিছুটা হয়তো সচেতন করে তোলা যায় বিক্ষিপ্ত ভাবে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি এবং সার্বিক ফল পেতে হলে একেবারে শিশু বয়স থেকে প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্যক্রমে বাধ্যতামূলক বিষয় হিসাবে এর অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন, দরকারে অন্য বিষয়ের ভার লাঘব করে হলেও। দুর্ঘটনা রোধে কী কী সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন এবং তা সত্ত্বেও যদি দুর্ঘটনা ঘটে, সে ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত— একটা সুরক্ষিত জীবন পাওয়ার জন্য এ শিক্ষার বীজ শিশু বয়সেই মনের গভীরে বপন করে দেওয়া জরুরি। এই শিশুরাই যখন পরিণত হবে, তখন এক সুন্দর, বিপন্মুক্ত সমাজ গড়ে উঠবে। এক প্রজন্ম হয়তো সময় লাগবে, কিন্তু এ পরিবর্তন হবে স্বতঃস্ফূর্ত, জোর করে যে পরিবর্তন আনা অসম্ভব। আশা রাখব, ভবিষ্যতে এমন দিন আসবে, যখন আকস্মিক দুর্ঘটনায় আমাদের অতি প্রিয় জনকে চিরকালের মতো হারাতে হবে না।