ফাইল চিত্র
আমি আদর করিয়া চড়াইপাখি পুষিয়াছিলাম, কিন্তু তাহা উড়িয়া গেল। কাঠবিড়ালী পুষিলাম, তাহাও পলাইয়া গেল। একটি গাছ লাগাইলাম, এক দিন চড়াইপাখি ও কাঠবিড়ালী দুই-ই ফিরিয়া আসিল।— উদ্ধৃতি হিসাবে শুনিতে ভাল, পরিবেশ দিবসে কাজেও লাগিতে পারে। হাজার হউক ইহার অন্তর্গত বার্তাটি সত্য। কিন্তু সরকারি সম্মতিক্রমে সারা দেশে বৃক্ষনিধনের আবহে ইহাই এখন করুণরস উদ্রেক করিতেছে, বলিলে ভুল হইবে না। দিনকতক পূর্বে কংগ্রেস বিজেপির বিরুদ্ধে অভিযোগ শানাইয়াছে, কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন সরকার ২০১৪ সাল হইতে এক কোটিরও বেশি বৃক্ষনিধনের অনুমতি দিয়াছে। কংগ্রেস মুখপাত্রের টুইট— মোদী সরকার বিগত পাঁচ বৎসরে ১,০৯,৭৫,৮৪৪টি বৃক্ষনিধনের জন্য দায়ী। লোকসভায় এক প্রশ্নের উত্তরে পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়ই এই তথ্য দিয়া বলিয়াছিলেন, গাছ কাটা হইয়াছে একাধিক উন্নয়নমূলক প্রকল্পের জন্য, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমতি লইয়াই। কেন্দ্রীয় পরিবেশমন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর অবশ্য বরাভয় দিয়াছেন, একটি গাছ কাটা হইলে পরিবর্তে লাগানো হইতেছে ৫-১০টি গাছ। উন্নয়ন হেতু বৃক্ষনিধন যেমন সত্য, তেমনই দুই বৎসরে ৮০০০ বর্গকিলোমিটার অরণ্যায়নও সত্য, স্যাটেলাইটে তাহা দেখাও যাইতেছে। সবার উপরে স্যাটেলাইট সত্য।
কেন্দ্রই হউক কি রাজ্যের— শিল্প, পরিকাঠামো নির্মাণ বা নগরায়নের উদ্দেশ্যে গৃহীত সরকারি প্রকল্প চালাইতে গাছ কাটিবার কোনও বার্ষিক ঊর্ধ্বসীমা আছে কি না তাহা জানা নাই। তাই পাঁচ বৎসরব্যাপী বিবিধ উন্নয়ন প্রকল্পে এক কোটি বৃক্ষনিধন নিতান্ত বাহুল্য না সত্যই প্রয়োজন, তাহা তর্কযোগ্য। জাতীয় প্ল্যানিং কমিশনের নথিতে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে গাছ কাটা সংক্রান্ত নীতি মিলিবে, তাহাতে বিবিধ নির্দেশিকা থাকিলেও কোন পরিস্থিতিতে কত গাছ কাটা যাইতে পারে সেই সংখ্যার উল্লেখ নাই। গত বৎসর দিল্লি হাইকোর্টের এক প্রশ্নের উত্তরে দিল্লি সরকার জানাইয়াছিল, ক্রমবর্ধমান জনবসতির প্রয়োজনে ২০০৫-২০১৮ এই তেরো বৎসরে ১,১২,১৬৯টি বৃক্ষ কাটা পড়িয়াছে, অর্থাৎ দিনপ্রতি ২৪টি, প্রতি ঘণ্টায় একটি করিয়া! কথা উঠিয়াছে, ‘দিল্লি প্রিজ়ার্ভেশন অব ট্রি অ্যাক্ট’কে বাছিয়া বাছিয়া সুবিধামাফিক প্রয়োগ করা হইতেছে। গাছেদের খবর লইতে ‘দিল্লি ট্রি অথরিটি’ নামক সংস্থা গড়া হইয়াছিল, তাহার সদস্যেরা তিন বৎসরে সভা করিয়াছেন মাত্র একটি!
আসল কথা হইল, গাছ বাঁচাইতে সরকারের সুস্পষ্ট নীতি নাই। থাকিলেও তাহা বাস্তবায়নের সদিচ্ছা বা উদ্যোগ নাই। তাহার ভূমিকা কেবল নাগরিকদের গাছ লাগাইবার অনুরোধেই সীমাবদ্ধ। সাম্প্রতিক কালের জলসঙ্কটে যেমন দেখা যাইল গৃহে গৃহে জল অপচয় রোধের আহ্বান। যেন প্রতিটি ঘরে জল অপচয় কমিলেই ভারতের জলভাণ্ডার পুনঃ পূর্ণ হইবে, আর কিছুর দরকার নাই। নাগরিকদের বৃক্ষরোপণ করিতে উৎসাহিত করা, পাশাপাশি উন্নয়নের দোহাই দিয়া এক কোটি গাছ কাটিয়া ফেলাও তেমনই দ্বিচারিতা। নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি নিশ্চয়ই প্রয়োজন, কিন্তু তাহারও সমান বা অধিক প্রয়োজন, গাছ লাগাইবার এবং কাটিবার সুস্পষ্ট সরকারি নীতির উপস্থিতি। তাহা না হইলে বৃক্ষরোপণ উৎসবের পশ্চাতেই বৃক্ষনিধনের ছায়াটি ধাওয়া করিবে।