“রহিমন দেখি বড়েনকো লঘু ন দিজিয়ে ডারি।/ জহাঁ কাম আবৈ সুই, কহা করৈ তরবারি।।” অর্থাৎ— বৃহৎকে দেখে কোরো না রহিম ক্ষুদ্রকে অবহেলা।/তরবারি সেথা কোন কাজে লাগে যেখানে সূচের খেলা— লিখেছিলেন এক কবি। সম্প্রতি স্যোশাল মিডিয়ায় একটি ভিডিয়ো ভাইরাল হতে দেখে ফের লাইনগুলো মনে পড়ে গেল। দেখলাম, ল্যাম্পপোস্টে বাঁধা এক যুবককে কয়েক জন গালিগালাজ ও শারীরিক নির্যাতন করে বাধ্য করছে ‘জয় শ্রীরাম’, ‘জয় হনুমান’ বলতে। আর যুবকটিও অসহায় যন্ত্রণা নিয়ে তা বলছেন। এক টানা ১৮ ঘণ্টা ধরে এই অত্যাচারের পর যুবকটি এখন আর বেঁচে নেই।
নিহত ব্যক্তির নাম তবরেজ আনসারি। ঘটনাস্থল বিজেপি শাসিত রাজ্য ঝাড়খণ্ড। সরাইকেলা খরসোঁয়া জেলার ধক্তিদি গ্রাম।
পরিসংখ্যান বলে, ২০১৬ সালের পর এই নিয়ে মোট ১৩ জনকে পিটিয়ে মারা হল ঝাড়খণ্ডে। শুধু ঝাড়খণ্ডই বা কেন, বিগত কয়েক বছর ধরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এই ধরনের অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে চলেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই অসহিষ্ণুতার শিকার মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। অভিযোগের আঙুল হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর দিকে। গোরক্ষার নামে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের জীবন ও জীবিকার উপর আঘাত হানা, এমনকি পিটিয়ে মারা পর্যন্ত হচ্ছে। ‘লাভ জিহাদ’-এর মতো হাস্যকর এবং বিদ্বেষপূর্ণ অজুহাতে সুখী দাম্পত্যকে তছনছ করে দেওয়া হচ্ছে। ইদের বাজার করে ফেরা মুসলিম কিশোরকে বন্ধুদের সামনেই ছুরি মেরে ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়ার মতো মর্মান্তিক ঘটনাও আমাদের স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি।
আর এই ঘটনার বাইরেও আরও অনেক ঘটনা নিশ্চয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে চলেছে, যা হয়তো আমাদের কানে এসে পৌঁছয় না। বলা যায়, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ প্রাত্যহিক জীবনে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তাদের কাছে ‘এ বড় সুখের সময় নয়’। ঔপনিবেশিক শাসনের থেকে মুক্তি পাওয়ার ৭০ বছর পরে আজও ধর্মকে কেন্দ্র করে এই বর্বর ঘটনার সাক্ষী থাকতে হচ্ছে আমাদের। যা সত্যিই ভারতবাসী হিসাবে আমাদের সকলের লজ্জা।
মানুষের সঙ্গে মানুষের এই ঘৃণার পরিবেশ একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল তাদের নিজেদের স্বার্থে সৃষ্টি করছে, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সঙ্ঘ মডেলের ভারতচেতনা এর জন্য দায়ী। “বাইরের শত্রু হল পশ্চিম দুনিয়া, আর অন্দরের শত্রু হল ভারতীয় মুসলিম, খ্রিস্টান এবং কমিউনিস্টরা।”— আরএসএস-এর চিন্তানায়ক সদাশিব ‘গুরুজি’ গোলওয়ালকার তাঁর ‘বাঞ্চ অব থটস’-এ এই ভাবনা জানিয়েছেন। এই ভাবনাকে মেনে নিলে ভারতে ইসলামের শাসনের অবদানকেই অস্বীকার করতে হয়। মুসলিম শাসক মানেই যেন হিন্দুদের উপর অত্যাচারী! এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে মুসলিমদের শত্রু হিসাবে ভাবতে শেখায় ও প্রতিশোধ নিতে শেখায়। হচ্ছেও তাই। ঐতিহাসিক স্থানের নাম বদলে যাচ্ছে। কোথাও মাথায় টুপি পরতে মানা করা হচ্ছে। ভারতমাতার জয়গান না করলেই শোনানো হচ্ছে পাকিস্তানে চলে যাওয়ার কথা। এক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ভোটের লড়াইকে বর্ণনা করেছেন ‘আলি এবং বজরংবলী’ লড়াইয়ের শব্দবন্ধে। দেশের উত্তর-পূর্বে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাজ্যে নাগরিকপঞ্জির নামে মুসলিম সম্প্রদায়কে বিতারণের জিগির তুলে দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করা হচ্ছে। পাবলিক স্ফিয়ার বা জনমানস সেই প্রভাবে প্রভাবিত হওয়ায় সামাজিক সম্পর্ককে ব্যাহত করছে। এর বিষ কতটা মারাত্মক হতে পারে, একটি ছোট্ট ঘটনার উল্লেখ করলে বোঝা যাবে।
লোকসভা ভোটের ফলাফল বেরনোর দু’দিন পরের ঘটনা। ক্লাস সিক্সের একটি ছাত্র আর স্কুলে যেতে চাইছে না। দু’তিন দিন কেটে গেলে ছাত্রটির মায়ের সন্দেহ হয়। ছেলেকে জিজ্ঞাসা করায় যে উত্তর পায়, তা খুব ভয়ঙ্কর। ছেলেটির পাশে নাকি তার সহপাঠীরা বসতে চায় না। একটি ছেলের জলের বোতল থেকে জল খেতে গেলে সে কেড়ে নেয়। “আম্মা, আমার বন্ধুরা বলেছে আমাদের না কি বাংলাদেশে তাড়িয়ে দেওয়া হবে? সত্যিই আমরা বাংলাদেশে চলে যাব?”— ঘটনাস্থল আমাদের পশ্চিমবঙ্গ।
ভারত বলতে তো আমরা বহুকাল ধরে বুঝে এসেছি বহুত্ব, বৈচিত্র্য এবং সমন্বয়ের যোগ। এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। গল্পটি আছে সঈদ নাকভির ‘বিয়িং দি আদার’ গ্রন্থে।
সঈদ তাঁর বাল্যকালের স্মৃতিচারণা প্রসঙ্গে জানাচ্ছেন লোকগান সোহরের কথা। সন্তানের মঙ্গলকামনার লোকগান এই সোহর। তাঁর আম্মার প্রিয় একটি সোহরের মূল আখর— ‘আল্লা মিয়াঁ হামরে ভাইয়াকো দিয়ো নন্দলাল’। অর্থাৎ, মুসলিম হয়েও কৃষ্ণকে সন্তান হিসাবে পেতে তাঁরা অভিলাষী। এই উদার ভারতের ধারণাই আজ বিপর্যয়ের মুখে। ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে ৫৪৩টি লোকসভা আসনের মধ্যে এমন ২৯টি আসন রয়েছে, যেখানে মুসলিম জনসংখ্যা ৪০ শতাংশের চেয়ে বেশি। সংখ্যালঘু মানুষের জীবন-জীবিকা, সংস্কৃতির উপরে এই ধরনের আঘাত যে বিদ্বেষের বাতাবরণ তৈরি করে— সেই আঘাত উল্টো দিক থেকে এলে তখন কী হবে? ভাবলেই ভয় হয়!
দেশের শাসক যদি ‘বিকাশ’কেই পাখির চোখ করে, তবে সেই পথ হবে ভারতের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনজনিত চরিত্রের সঙ্গে সঙ্গতিসাধন।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে সম্রাট বাবরের পুত্র হুমায়ুনকে উদ্দেশ করে লেখা চিঠির কথা— “এটা সম্পূর্ণ সত্যি যে তুমি সমস্ত ধর্মান্ধতামুক্ত হৃদয় নিয়ে সমস্ত সম্প্রদায়ের রীতি অনুসারে ন্যায়প্রদান করবে। এবং বিশেষ করে গরুর বলিদান থেকে বিরত থাকবে, কারণ এই পথেই হিন্দুস্তানের জনগণের হৃদয় জিতে নেবে; এবং রাষ্ট্রের জনগণ রাজানুগত্যের মধ্যে দিয়ে তোমার প্রতি নিয়োজিত থাকবে। এবং কোনও মন্দির ও অন্য ধর্মীয় ক্ষেত্রগুলিকে তুমি ধ্বংস করবে না। এমন ভাবে ন্যায় প্রদান করো যাতে এই রাষ্ট্র তার সমস্ত প্রজাদের নিয়ে সুখী হয় এবং একই ভাবে সমস্ত প্রজারা খুশি হয় তাদের রাষ্ট্রকে নিয়ে। ইসলামের প্রগতি দয়ার তলোয়ারের দ্বারা হয়, অত্যাচারের তলায়ারের দ্বারা নয়।”
‘সবকা বিশ্বাস’ অর্জনের জন্য এটাই উপযুক্ত পথ। সে কথা যত দ্রুত শাসক বুঝবে, এই দেশের নাগরিকের জন্য মঙ্গল।
(সঙ্গের ছবি: ভিডিয়ো থেকে নেওয়া, নিগৃহীত তবরেজ আনসারি)
চাপড়া গভর্নমেন্ট কলেজের শিক্ষক