এত দিনে স্পষ্ট, লকডাউনের ঘোষণা যতই জরুরি হোক, তার পরিকল্পনার দুর্বলতাগুলো কত ভয়ানক। বিশ্বের বহু দেশ এখন কমবেশি লকডাউনের শিকার, কিন্তু ১৩৮ কোটির মানুষের যে দেশে ৫০% ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক, ৯৩% শিল্প অসংগঠিত এবং তার ৮৫% ঠিকাশ্রমিক, সেখানে সঙ্কটের ব্যাপ্তি আর তা থেকে বেরোবার পথ, দুটোই আলাদা, স্বাভাবিক।
আপাতত সরকারের ভাবনার চলন স্বল্পমেয়াদি। রেশন বা ত্রাণশিবির, তিন মাসের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড দেওয়া বা ইএমআই মুলতুবি রাখা, উজালা পরিবারে বিনামূল্যে তিন মাস গ্যাস, জন ধন প্রকল্পে তিন মাস ৫০০ টাকার কিস্তি। এই টুকরো টুকরো ছবি থেকে ভাবা যেতে পারে, তিন মাস পরে সব কিছু স্বাভাবিক হবে। কিন্তু বাস্তব হল, একটা আপাত-স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারা অন্তত ১৮ থেকে ২৪ মাসের এক যন্ত্রণাদীর্ণ পথ। যত দিন না ওষুধ বা প্রতিষেধক সুলভে বাজারে আসছে, মানুষ অনিশ্চয়তার চোটে প্রয়োজনের বাইরে খরচ করবেন না। ভ্রমণ, বিমানযাত্রা, হোটেল, রেস্তোঁরা, সিনেমা, খেলাধুলো, ফ্যাশন, দামি আসবাব, পোশাক, গয়নাশিল্প, চর্মদ্রব্য, দামি ইলেকট্রনিক সামগ্রী, গাড়ি, আবাসন, হস্তশিল্প– সঙ্কটের তালিকা দীর্ঘ। এর মধ্যে কিছু শিল্প রফতানিনির্ভর, সেখানেও মহামন্দার ফলে চাহিদা কমবেই। আর আছে তার সমস্ত অনুসারী শিল্প, এবং অসংখ্য শ্রমিক। সিএমআইই-র হিসেব, লকডাউনের প্রথম মাসে প্রায় ১৪ কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছেন, পরিবার মিলিয়ে প্রায় ৫০ কোটি মানুষ সঙ্কটে। এ ছাড়া কৃষিজীবী মানুষ, পরিবারসহ, আরও ৫০ কোটি। যারা কাজ হারাল, তাদের অধিকাংশের কাজ ফিরে পাওয়া লকডাউন ওঠার ওপর নির্ভর করছে না, নির্ভর করছে বাজারের চাহিদার ওপর, যেখানে মন্দার কালো ছায়া।
অনেক অর্থনীতিবিদ বলেছেন, যে ভাবে হোক গরিব মানুষের হাতে কিছু টাকা পৌঁছে দিতেই হবে। খুব সত্যি কথা, কিন্তু বাস্তব বলছে, দেশের অসংগঠিত ক্ষেত্রে মানুষের হাতে টাকা পৌঁছে দেওয়ার নির্ভরযোগ্য কাঠামো এখনও নেই। আর হাতে টাকা গেলেও তার ঠিক ব্যবহার হবে কি না, সে প্রশ্নও আছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে সহায়তার কথা শোনা যাচ্ছে, কিন্তু সেখানেও সমস্যা অনেক। সেই টাকা শ্রমিকের কাছে পৌঁছবে কি? তাছাড়া যে শিল্প ঘুরে দাঁড়াতে ১৮ মাস লাগবে তাকে ছয় মাস আর্থিক সাহায্য দিয়ে লাভ কতটাই বা। ঋণ দিয়ে অনুৎপাদিত সম্পদ হয়ে পড়ার দায় যে ভাবে ব্যাঙ্ক অফিসারের ঘাড়ে এসে পড়ছে আজকাল, এই সঙ্কটে ঋণ দেবার কতটা আগ্রহ ব্যাঙ্ক দেখাবে, সন্দেহ আছে।
বাকি থাকছে রেশনব্যবস্থা। আপৎকালীন সময়ে রেশনের ওপর নির্ভর করতেই হবে। কিন্তু নির্ভরতা যত বাড়বে, দুর্নীতিও বাড়বে। শুধু চাল বা গম দিয়ে এত লম্বা পথ চলা যাবে না, এই লড়াই দু মাসের নয়, অন্তত দু’বছরের। তাই কোনও বিকল্প পথ ভাবতে হবে, এই যুদ্ধ জিততে হলে গরিব, প্রান্তিক ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষকে অন্তত দু’বছর পরিবার নিয়ে জীবন নির্বাহ করার একটা কাঠামো দরকার হবে।
সরকারি বণ্টনব্যবস্থার জটিলতা ও সীমাবদ্ধতা কোনও নতুন কথা নয়। অমর্ত্য সেন তো বলেছেন যে খাদ্যের অভাবে দুর্ভিক্ষ হয় না, তা হয় বণ্টনের সমস্যায়। অন্য দিকে ভারতের মতো জটিল পরিস্থিতির দেশে বেসরকারি সংস্থার বণ্টনব্যবস্থা কিন্তু দক্ষ। দেশের প্রত্যন্ত গ্রামে, অরণ্যে, পাহাড়েও সে নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তু পৌঁছে দিতে পারে। তাই, এই অভূতপূর্ব সঙ্কটে যৌথ উদ্যোগের এক নতুন মডেল তৈরি হতেই পারে, যাতে সরকারের আর্থিক সাহায্য আর বেসরকারি বণ্টনদক্ষতা এক সঙ্গে কাজ করবে। একটা দুই বছরের সময়সীমা ভাবলে, ন্যূনতম মানের জীবন বাঁচতে রেশনে চাল-ডাল-গম ছাড়াও লাগবে নুন, চিনি, দুধ, তেল, বিস্কুট, মশলা, চা, সাবান, মাজন, খাতা, পেন, পেন্সিল, ব্যাটারি: অনেক কিছু। দেখা দরকার কাদের এই সামগ্রী একদম প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছনোর পরিকাঠামো আছে। সেই সংস্থাগুলির সঙ্গে তাল মিলিয়ে উদ্যোগ নিয়ে একটা আলাদা নামে এই সামগ্রীগুলি বাজারে আসতে পারে। তাদের অন্যান্য ব্র্যান্ড নিজের মতো চলুক, কিন্তু এই সামগ্রীগুলি দুই বছরের বিশেষ প্রকল্প হিসেবে চলতে পারে। এগুলোতে ভর্তুকি চাই, যাতে বাজারদরের থেকে কম দামে মানুষ পায়, কিন্তু বিনা পয়সায় নয়। প্রয়োজনীয়তার তীব্রতা অনুযায়ী ভর্তুকির হার কয়েকটি স্তরে ভাগ করা সম্ভব। ২৪ মাসের মধ্যে ধাপে ধাপে ভর্তুকি কমানোও সম্ভব।
এতে সুবিধা হল, নামমাত্র মুনাফা হলেও বহুজাতিক সংস্থাগুলো এতে আগ্রহী হতে পারে, ব্যবসার চাকা গড়াবে, বণ্টনব্যবস্থার বিভিন্ন স্তরে যুক্ত লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকা চলবে। মানুষের উপার্জন কমলেও একটা ন্যূনতম জীবনযাত্রা বজায় রাখার রসদ পাবে। সরকারকে হয়তো নোট ছাপাতেই হবে, কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু জিনিসের দামে নিয়স্ত্রণ থাকলে মূল্যস্ফীতির চাপ কমবে। হিসেব বলছে, আজ দেশের যা জিডিপি, আগামী দু’বছর ধরে তার চার শতাংশ ভর্তুকি দিতে পারলে এই প্রকল্পটির বাস্তবায়ন সম্ভব। অন্যান্য ভর্তুকিতে টাকা বাজারে ফিরে আসার নিশ্চয়তা থাকে না, এক্ষেত্রে ভর্তুকি কিন্তু সরাসরি বাজার সচল থাকার অনুঘটক হবে।
কিছু প্রশ্ন তবুও থাকে। সরকার ভর্তুকির হিসেব রাখবে কী করে, আর সবার তো ভর্তুকি দরকার নেই। এখন যেহেতু একেবারে মুদির দোকান বাদ দিলে পুরো বণ্টনশৃঙ্খলটি মোটামুটি জিএসটি-র আওতায়, একটি আলাদা নামে জিনিসগুলি চললে বিক্রির হিসেবে গরমিলের সম্ভাবনা কম। আর রইল দেশের ১০-১৫ শতাংশ পরিবার, যাদের ভর্তুকি না পেলেও চলত। তারা মূলত করদাতা, তাই ভর্তুকির হারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে করের ওপর করোনা সারচার্জ চাপানো যেতে পারে।
মূল কথা— শিল্পক্ষেত্রে সরকারি অনুদান বাড়িয়ে সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনা কম। ব্যবসা তার নিজের গতিতে চলবে, মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও চাহিদার পরিবর্তনের ফলে এক বিপুল অংশ ঝাঁপ বন্ধ করবে, আবার নতুন ধরনের চাহিদা অন্য শিল্পের সৃষ্টি করবে। তাই হয়তো মানুষের ওপর সরকারি সহায়তার ছাতাটা দরকার অনেক বেশি, মানুষ যাতে অন্য জীবিকা খুঁজে নেওয়ার সময়টা পায়।