গোবর, গোমূত্র খুবই ‘উপকারী’। না, স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী কি না, তা এখনও জানি না, যদিও মূত্রে প্রোটিন নিয়ে প্রায় পনেরো বছর গবেষণা করছি। তবে বিজ্ঞানীর ট্যাঁকের জন্য উপকারী। ও থেকে ওষুধ বানাতে চাইলে ষাট শতাংশ টাকা দেবে কেন্দ্রীয় সরকার। এমন ‘অফার’ ছাগল নাদি, মানুষের ইয়েটিয়ে, কিছুতে নেই। অতএব চাই গবেষণা প্রস্তাব: কী বার করা যায় গোমূত্র থেকে?
মূত্রের সঙ্গে বিজ্ঞানের সম্পর্কটা রোগ নির্ণয়ের। সুস্থ প্রাণীদেহ সাধারণত দরকারি এবং উপকারী জৈব বা অজৈব উপাদান দেহের বাইরে ফেলে দেয় না। মূত্রে থাকে বর্জ্য পদার্থ। তবে অসুস্থ প্রাণীর ক্ষেত্রে জৈব অণু, নানা ধরনের নুন, প্রোটিন, বিভিন্ন ধরনের জৈব জ্বালানি, শর্করা, অ্যামিনো অ্যাসিড, ডিএনএ বা আরএনএ-র টুকরো, বা ভিটামিনের মতো দরকারি অণুও মূত্রের সঙ্গে বেরিয়ে আসে। ভুল করে বেরোয় বলেই ওই অবস্থাকে আমরা অসুখ বলি। মূত্র-সহ দেহজ নানা তরল চিকিৎসা শাস্ত্রে রোগ নির্ণয়ে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা নিয়েছে।
গত দুই দশকে ছোট, বড় ও খুব বড়, বিভিন্ন রকমের জৈব অণুর ভর নির্ণয় করার প্রযুক্তি এতই উন্নত হয়েছে, যে ভারতের বিভিন্ন শহরের কমপক্ষে পঞ্চাশটি ল্যাবরেটরিতে এখন মূত্রের নমুনা পরীক্ষা করে নিশ্চিত ভাবে বলা সম্ভব, তার মধ্যে কী কী উপাদান রয়েছে। সুস্থ ও নীরোগ মানুষের মূত্রে রয়েছে কমবেশি ছ’হাজার প্রোটিন আর তিন হাজার অন্যান্য ছোট ছোট অণু! আজ গোপালের জেঠিমাও কোলেস্টেরলের সঙ্গে পাঁঠার মাংস আর গ্লাইকেটেড হিমোগ্লোবিনের সঙ্গে ডায়াবিটিসের সম্পর্ক জেনে গিয়েছেন। মূত্রের নমুনায় এমন সূচকের খোঁজ করে বিজ্ঞানীরা প্রায় তিরিশটি পরিচিত, সাধারণ রোগের এবং প্রায় পাঁচশোটি কম জানা, অচেনা অসুখের বায়োমার্কার খুঁজে পেয়েছেন। অতএব গরুর মূত্র থেকে গরুর রোগের সূক্ষ্ম বিচার সম্ভব।
কিন্তু সরকার কি গোমাতার উত্তম চিকিৎসা চায়? তা হলে তো ল্যাঠা চুকে যেত। সরকার চায়, গোমূত্র থেকে মানুষের ওষুধ। সরকার-ঘনিষ্ঠ লোকেরা বলছেন, তাতে নাকি ক্যান্সারও সারে। মুশকিল হল, বিজ্ঞানের শর্তগুলো একটু বিটকেল। যা খেয়ে রোগ সেরেছে, তাকেও ‘ওষুধ’ বলে দাবি করার আগে বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয় বিজ্ঞানীকে। ডায়াবিটিসের রোগীরা নিয়মিত করলার রস খান। তাতে নাকি রক্তে চিনি কমে। তা হলে করলা কি মধুমেহর ওষুধ? বিজ্ঞানের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সহজ প্রোটোকল এই রকম দাঁড়াবে: অন্তত একশো জন (পঞ্চাশ জন পুরুষ, পঞ্চাশ জন মহিলা হলে ভাল) একই রকম দেহের ওজন, একই খাদ্যাভ্যাস, ধূমপায়ী ও মদ্যপায়ী নন, এমন স্বেচ্ছাসেবীকে নির্দিষ্ট পরিমাণের অন্তত দুটি মাপে, অর্থাৎ ধরা যাক দুই মিলিলিটার ও পাঁচ মিলিলিটার করলার রস দশ দিন খাওয়াতে হবে। করলার রস মানে, একটি নির্দিষ্ট ওজনের করলায় নির্দিষ্ট আয়তনের জল মেশাতে হবে এবং তাকে সদ্য বানিয়ে নিতে হবে। গবেষক প্রত্যেকের রক্তে শর্করার পরিমাণ মেপে চলবেন।
করলার রস খেলে যদি রক্তের শর্করা কমে অন্তত নব্বই জনের, তবেই করলার রসের জিত। বিজ্ঞানী অবশ্য এখানেই থামবেন না। তিনি চেষ্টা করবেন করলার মধ্যে সেই বিশেষ উপাদানটি খুঁজে বার করতে, যা রক্তে চিনি কমায়। অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা, পাশফেলের মধ্যে দিয়ে গেলে উপাদানটি হয়তো কোনও দিন ওষুধের দোকানে জায়গা পেতে পারে। আয়ুর্বেদ বা লোক-প্রচলিত চিকিৎসার বহু উপকরণ এ ভাবে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার কষ্টিপাথরে উত্তীর্ণ হয়ে আধুনিক চিকিৎসায় যুক্ত হয়েছে। গোমূত্রকেও এ ভাবে পরীক্ষা করতে হবে। এবং তা রোগ নিরাময়ে কতটা কার্যকর, তা বুঝতে তার তুলনা করা হবে কার সঙ্গে? জল কিংবা চিনির জলের সঙ্গে নয়, অন্য প্রাণীর মূত্রের সঙ্গে।
বিজ্ঞানী বেচারির এমনই ট্রেনিং, যে সে ফস্ করে বলে বসবে, কিন্তু স্যর, সে কাজটা করবই বা কেন? ঘোড়া বা মোষের সঙ্গে বা মার্জারের মূত্রের সঙ্গে গোমূত্রের জৈব-অজৈব উপকরণে তফাত হওয়ার কারণ কী? যদি বা হয়ও, ছ’হাজার প্রোটিন আর তিন হাজার মেটাবোলাইটের কতগুলিই বা আলাদা হবে? গরুর ল্যাজের পিছনেই কেন লাইন দিতে হবে বিজ্ঞানীদের? আগের গবেষণায় কোনও বস্তুর ওষধিগুণের ইঙ্গিত মিলে থাকলেই বিজ্ঞানীরা তাকে আরও গভীর ভাবে পরীক্ষা করার কথা ভাবেন। মুশকিল হল, নিজের মূত্র বা গোমূত্র দিয়ে রোগ নিরাময়ের ধারণা প্রাচীন কাল থেকে থাকলেও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় কিন্তু তার রোগ সারানোর ক্ষমতার ইঙ্গিত মেলেনি। বরং দেশ-বিদেশের গবেষকরা হাতে-কলমে পরীক্ষা করে চিকিৎসায় মূত্রের ব্যবহার নিষেধ করছেন, কারণ চিকিৎসাবিদ্যার প্রথম বিধি হল, ‘ক্ষতি কোরো না।’ যেখানে ভাল জল পাওয়া অসম্ভব (মাঝসমুদ্রে নৌকাডুবি হলে, বা যুদ্ধক্ষেত্রে), সেখানে প্রাণ বাঁচাতে পান করতে বা ক্ষতস্থান পরিষ্কার করতে মূত্রের ব্যবহার চলতে পারে। কিন্তু পরিষ্কার জল পাওয়া গেলে সেটাই অনেক ভাল বিকল্প। গোমূত্র নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা কেউ চাইলে করতে পারেন। কিন্তু অতীতের গবেষণায় গোমূত্র-চিকিৎসার কুফল ধরা পড়েছে।
কেন গরু? কেন গোমূত্র? বিজ্ঞান গবেষণার বিষয়বস্তুর চয়নও বিজ্ঞানসম্মত হতে হবে। জ্যোতিঃ-পদার্থবিজ্ঞানের পাঠক্রম ঠিক করবেন সোমক রায়চৌধুরি, স্টেম সেলের পাঠক্রম ঠিক করবেন সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। কী নিয়ে পড়াশোনা, গবেষণা হবে, বিজ্ঞানে তার নির্দিষ্ট গতিপথ আছে। রাজনীতি দিয়ে বিজ্ঞানে গরু পাচার কি ভাল কাজ?
সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স