বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজ। নিজস্ব চিত্র
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমাদের দেশে সরকার বাহাদুর সমাজের কেহই নন, সরকার সমাজের বাহিরে। অতএব যে-কোনো বিষয় তাঁহার কাছ হইতে প্রত্যাশা করিব, তাহা স্বাধীনতার মূল্য দিয়া লাভ করিতে হইবে। যে-কর্ম সমাজ সরকারের দ্বারা করাইয়া লইবে, সেই কর্মসম্বন্ধে সমাজ নিজেকে অকর্মণ্য করিয়া তুলিবে। অথচ এই অকর্মণ্যতা আমাদের দেশের স্বভাবসিদ্ধ ছিল না। আমরা নানা জাতির, নানা রাজার অধীনতাপাশ গ্রহণ করিয়া আসিয়াছি, কিন্তু সমাজ চিরদিন আপনার সমস্ত কাজ আপনি নির্বাহ করিয়া আসিয়াছে, ক্ষুদ্র-বৃহৎ কোনো বিষয়েই বাহিরের অন্য কাহাকেও হস্তক্ষেপ করিতে দেয় নাই। সেই জন্য রাজশ্রী যখন দেশ হইতে নির্বাসিত, সমাজলক্ষ্মী তখনো বিদায় গ্রহণ করেন নাই’ ‘স্বদেশী সমাজ’)।
সমাজ, দেশ সম্পর্কে অন্য রকম বোধের প্রকাশ ছিল যে প্রবন্ধে, তা লেখার প্রাথমিক তাগিদটা ছিল বাংলাদেশের জলকষ্ট দূর করায় সে কালের ইংরেজ সরকারের মন্তব্য। ১৯০৪-এ মিনার্ভায় চৈতন্য লাইব্রেরির বিশেষ অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ প্রথম পড়েছিলেন প্রবন্ধটি।
বাংলাদেশের সেই সময়ের জলকষ্টের সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ ছিল বাঁকুড়া-পুরুলিয়ায়। ১৮৬৬ থেকে ১৯১৬, এই পঞ্চাশ বছরে অন্তত চার বার দুর্ভিক্ষ হয়েছে বাঁকুড়ায়। এমনিতেই অল্পবৃষ্টির রাঢ়বঙ্গে তখন খাবার আর জলের অভাব নিত্যসঙ্গী। কিন্তু দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জন্য ইংরেজ সরকার কিছুই করেনি। তার উপরে ১৯১৪-তে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় জেলার অবস্থা হয় শোচনীয়। এই পরিস্থিতিতে সরকারের প্রত্যাশায় না থেকে বাঁকুড়ার মানুষের উন্নতির জন্য প্রধানত রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের উদ্যোগে শুরু হল ‘বাঁকুড়া সম্মিলনী’। প্রথম সভাপতি ছিলেন বিচারপতি দিগম্বর চট্টোপাধ্যায়। সম্পাদক ঋষীন্দ্রনাথ সরকার।
সম্মিলনীর দফতর ঋষীন্দ্রনাথের বাড়িতে হলেও সব কাজ চলত ‘প্রবাসী’ ও ‘মডার্ন রিভিউ’-এর সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের দফতরেই। তিনিই ছিলেন প্রতিষ্ঠানের প্রথম সহ-সভাপতি ও কোষাধ্যক্ষ। এঁরা সবাই বাঁকুড়ার মানুষ, কেউ কেউ কর্মসূত্রে কলকাতায় থাকতেন। সম্মিলনীর সব খবর প্রকাশিত হত ‘প্রবাসী’তে। ১৯১১ সালে সংস্থার কাজকর্ম শুরু হয়। আর আনুষ্ঠানিক ভাবে সংস্থাটির নিবন্ধীকরণ হয় ঠিক শতবর্ষ আগে, ১৯১৯-এ।
এই প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল, বাঁকুড়ায় শিক্ষার প্রসার, স্বাস্থ্যের উন্নতি, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগে ত্রাণ সংগ্রহ। আর সেই উদ্দেশ্যগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল স্বাস্থ্য আর খাদ্যের অভাব। তারই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ফসল বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল। বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজ কলকাতার বাইরে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মেডিক্যাল কলেজ। শুরুটা অবশ্য হয়েছিল স্কুল থেকে। মাত্র ৫০ জন ছাত্র নিয়ে ১৯২২-এ শুরু হয় ‘বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক্যাল স্কুল’। ক্লাস হত ভাড়াবাড়িতে। রসায়ন আর পদার্থবিদ্যা পড়ানো হত বাঁকুড়া
খ্রিস্টান কলেজে।
বাঁকুড়া সম্মিলনীর প্রতিষ্ঠার বছরগুলিতে বাঁকুড়ায় ভয়ানক সমস্যা ছিল অনাবৃষ্টির। ১৯১৩-১৪ থেকে তা চলে ১৯১৯-২০ সাল পর্যন্ত। সে সময়ে দুর্ভিক্ষের নানা খবর ও অর্থ-সাহায্যের আবেদন বাঁকুড়া সম্মিলনী তুলে ধরে ‘প্রবাসী’ পত্রিকার মাধ্যমে। ইঁদপুর থানার একটি ছবি তুলে ধরেছিলেন ‘প্রবাসী’র সংবাদদাতা প্রাণকৃষ্ণ আচার্য—‘গত ১৪ই সেপ্টেম্বর রাত্রিতে গো-শকটে বাঁকুড়ার দক্ষিণে ইঁদপুর থানার দিকে যাত্রা করি। রাস্তার উভয় পার্শ্বস্থ যত জমি আছে অধিকাংশ পতিত। কোথাও কোথাও নিম্নভূমিতে ধান আছে কিন্তু একটি গাছেও ধানের শীষ নাই এবং আর হইবারও সম্ভাবনা নাই’।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সেই সময়ে ‘বাঁকুড়া সম্মিলনী’ ৫৪ হাজার ৬২৩ জনকে সাহায্য করে। মোট খরচ হয় ১৮ হাজার ৫৭৯ টাকা। নিজের ছোট ছেলের মৃত্যুর শোক ভুলে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ত্রাণ সংগ্রহে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁর অন্যতম প্রিয়পাত্র ও সুহৃদ রবীন্দ্রনাথও এগিয়ে আসেন দুর্ভিক্ষ পীড়িতদের সাহায্যে। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে টিকিট বিক্রি করে ‘ফাল্গুনী’-র অভিনয় হয়। তা থেকে সংগৃহীত মোট ৮,১৭১ টাকা বাঁকুড়ায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রবাসী পত্রিকার ফাল্গুন, ১৩২২ সংখ্যায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ‘টিকিট বিক্রয়ের টাকা হইতে কিছু তাঁহারা স্পর্শ করেন নাই। দুই দিন অভিনয় করিয়া যাহা উঠিয়াছিল, সবই নিরন্নের সাহায্যেই দান করা হইয়াছিল’।
দুর্ভিক্ষের গ্রাসে বাঁকুড়ার তাঁতশিল্পও ধ্বংস হতে বসেছিল। তখন ‘বাঁকুড়া সম্মিলনী’ তৈরি করে ‘তাঁতি রিলিফ কমিটি’। এই কমিটি দরিদ্র তাঁতিদের সুতো দিয়ে কাপড় বোনাত। তার পরে তা ন্যায্য মূল্যে কিনে নিত। রিলিফ কমিটির অফিস তৈরি হয়েছিল মাচানতলা বাজারে। শুধু তাঁতশিল্প নয়, ১৯১৫-১৬ সালে বাঁকুড়ার অন্য শিল্প বাঁচাতেও উদ্যোগী হয় ‘সম্মিলনী’। ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় তখন লেখা হয়েছিল, ‘যাহারা অল্প মূলধন পাইলে কোন না কোন প্রকার শিল্পকার্য্য বা অন্য প্রকার শ্রমের কার্য্য করিয়া জীবিকা অর্জ্জন করিতে পারে তাহাদিগকে মূলধন দেওয়া হইয়াছে। তাহার বিনিময়ে সম্মিলনী শিল্পজাত দ্রব্য লইবেন’।
সমাজের জন্য, সমাজের মধ্যে থেকে ‘বাঁকুড়া সম্মিলনী’র নানা কর্মকাণ্ড আজও ইতিহাস হয়ে রয়েছে। কিন্তু সে ইতিহাস এই আনুষ্ঠানিক শতবর্ষেও ছড়িয়ে আছে ক্রমশ হারিয়ে যেতে বসা নানা নথি আর দুষ্প্রাপ্য পুরনো পত্র-পত্রিকায়। তারই মধ্যে কেউ কেউ বাঁকুড়ার আনাচে-কানাচে ঘুরে আজও চেষ্টা করে চলেছেন আঞ্চলিক ইতিহাসের এই লুপ্তপ্রায় অংশগুলি পুনর্গঠনের।
ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধিকে লেখা রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের একটি অপ্রকাশিত চিঠিতে রয়েছে, ‘কাল বাঁকুড়া সম্মিলনীর কার্যনির্বাহক সমিতিতে স্থির হইয়াছে যে, বাঁকুড়া প্রত্নভবনের জন্য অর্থ সংগ্রহার্থে প্রার্থনা পত্রে সম্মিলনীর নাম থাকিবে এবং প্রত্নভবন সম্মিলনীর অন্যতম প্রতিষ্ঠান হইবে।’
শেষ পর্যন্ত পুরাকীর্তি ভবন অবশ্য হয়নি। বাঁকুড়া সম্মিলনী-ও আজ আর খাতায়-কলমে জীবিত নেই। তবু স্বদেশী সমাজের অন্য রকম আলোয় শতবর্ষ পেরিয়েও উজ্জ্বল তার ইতিহাস।
লেখক উপ-পরিচালক, গ্রন্থনবিভাগ, বিশ্বভারতী