পৃথিবীর বুকে টলমল করছে আমাদের অস্তিত্ব

বিশ্ব উষ্ণায়ন বেড়েই চলেছে। সঙ্কটে জনস্বাস্থ্য, খাদ্য সুরক্ষা, অর্থনৈতিক অগ্রগতি। বাড়ছে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়ার মতো রোগ। কমছে চাষযোগ্য জমি এবং ফসলের ফলন। লিখছেন কাবেরী বিশ্বাসকমবেশি সকলেই জানেন  যে, ২০১৫ সালে ডিসেম্বরে প্যারিসে  সংযুক্ত রাষ্ট্রপুঞ্জের উদ্যোগে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানো নিয়ে ১৯০টি দেশ একটি সমঝোতা পত্রে স্বাক্ষর করে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০১৯ ০২:৫৮
Share:

বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব।

সাঙ্ঘাতিক সব বিপদ আস্তে আস্তে চারপাশ থেকে আমাদের ঘিরে ধরছে। প্রতি মুহূর্তেই পৃথিবীর বুকে টলমল করছে আমাদের অস্তিত্ব। বিজ্ঞানীরা একের পর এক সতর্কবার্তা দিয়ে চলেছেন। কিন্তু আমরা উদাসীন। সেপ্টেম্বরে আমাদের ছেলেমেয়েরা ‘ব্যবস্থাকে বদলাও, জলবায়ুকে নয়’ দাবিতে ধর্মঘট করল। গ্রেটা থুনবার্গ বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধানদের বলল জলবায়ু পরিবর্তন রুখতে। বিজ্ঞানীদের কথা শুনতে। আমাদের মধ্যে অনেক মানুষ এখনও বিপদের ভয়াবহতা বুঝতে চাইছেন না। তাঁদের উদাসীনতার কঠিন দেওয়ালে আঘাত হানতে বিজ্ঞান ভিত্তিক কিছু তথ্য পরিবেশন করছি।

Advertisement

কমবেশি সকলেই জানেন যে, ২০১৫ সালে ডিসেম্বরে প্যারিসে সংযুক্ত রাষ্ট্রপুঞ্জের উদ্যোগে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানো নিয়ে ১৯০টি দেশ একটি সমঝোতা পত্রে স্বাক্ষর করে। এটাই বিখ্যাত প্যারিস চুক্তি। এই চুক্তিতে ঠিক হয়েছিল, পৃথিবীর গড় উষ্ণতার বৃদ্ধি প্রাকশিল্পায়ন যুগের তুলনায় ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে রাখতে হবে, কিন্তু চেষ্টা করতে হবে যেন এই বৃদ্ধিকে ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে রাখা যায়।

কিন্তু সম্মিলিত রাষ্ট্রপুঞ্জের ইন্টারগভর্মেন্টাল প্যানেল ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) অক্টোবর ২০১৮ সালে বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ে একটি বিশেষ রিপোর্ট প্রকাশ করে। এই রিপোর্ট তৈরি করেছেন চল্লিশটি দেশের একানব্বই জন বিজ্ঞানী, ব্যবহৃত হয়েছে ছয় হাজার বৈজ্ঞানিক তথ্য। এটি বিভিন্ন রাষ্ট্রের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন আটকাতে একটি গাইড লাইন। এই রিপোর্টে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, প্যারিস চুক্তিতে ঠিক হওয়া ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে পৃথিবীর বিপর্যয় তাঁদের আগের হিসাব থেকে অনেক বেশি হবে বলে তাঁরা মনে করছেন। তাই তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড রাখার চেষ্টা না করলে প্রলয় অনিবার্য।

Advertisement

আইপিসিসি-র রিপোর্টে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত যে সব বিপদের কথা বলা হয়েছে, তার আরও সাম্প্রতিক তথ্য আমরা দেখতে পেলাম ডব্লিউএমও (WMO) এর সেপ্টেম্বর ২০১৯ সালে প্রকাশিত রিপোর্টে, ‘ বিশ্ব জলবায়ু (২০১৫-২০১৯): জলবায়ু পরিবর্তন ত্বরান্বিত’। এই রিপোর্ট থেকে নেওয়া কয়েকটি তথ্য—

গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি: গ্রিন হাউস গ্যাসগুলিই বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য দায়ী। কার্বন ডাইঅক্সাইড-সহ অন্য গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ ২০১৫-২০১৯-এর সময়কালে ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। কার্বন ডাইঅক্সাইড বৃদ্ধির হার পূর্ববর্তী পাঁচ বছরের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ। এই গ্যাস শত শত বছর ধরে বায়ুমণ্ডলেই থেকে যায়। সমুদ্রে থেকে যায় আরও অনেক বেশি দিন।

বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি: এই রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে যে, বিশ্বের গড় তাপমাত্রা প্রাক শিল্পায়ন যুগের বেসলাইন থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ১.১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বেড়েছে। ২০১১-১৫ এই সময়ে বেড়েছে ০.২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। তাপমাত্রার বৃদ্ধিই জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণ।

সমুদ্র জলতল বৃদ্ধি: গ্রিনল্যান্ড ও আন্টার্কটিকায় বরফ কমতে থাকায় সমুদ্রের জলতল বৃদ্ধিও বেশি হচ্ছে। ২০০৭-২০১৬ — দশ বছরে বেড়েছিল ৪ মিলিমিটার আর ২০১৪-২০১৯— পাঁচ বছরে বেড়েছে ৫ মিলিমিটার। ফলে আমাদের সুন্দরবন-সহ অন্য দ্বীপভূমিগুলিও ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে।

সঙ্কুচিত বরফ ভাণ্ডার: আন্টার্কটিকার বরফ স্তর কমে যাওয়ার হার বেড়েছে ছয় গুণ, ১৯৭৯-১৯৯০ সালে কমেছিল বছরে ৪০ গিগা টন আর ২০০৯—২০১৭ এই সময়ে কমছে বছরে ২৫২ গিগা টন করে।

সমুদ্রের উষ্ণতা ও অম্লত্ব বৃদ্ধি: জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উৎপন্ন বাড়তি তাপের ৯০ শতাংশ জমা হয় সমুদ্রে। মনুষ্যসৃষ্ট বাৎসরিক কার্বন ডাইঅক্সাইডের ৩০ শতাংশ সমুদ্র শুষে নেয়। কার্বন ডাইঅক্সাইড জলের সঙ্গে বিক্রিয়ায় তৈরি করে অ্যাসিড। বাড়ায় অ্যাসিডিটি, প্রাকশিল্পায়ন যুগের তুলনায় যা বেড়ে গিয়েছে প্রায় ২৬ শতাংশ। সঙ্কটে পড়েছে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র ।

তাপপ্রবাহ: ২০১৫-২০১৯, এই সময়ে মারাত্মক তাপপ্রবাহের কবলে পড়েছে সমস্ত মহাদেশ। ফ্রান্সে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আবার সাঙ্ঘাতিক শীতল আবহাওয়ার কবলে পড়েও প্রাণ গিয়েছে বহু জনের। ২০১৯ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে দুর্বল পোলার ভর্টেক্সের জেরে তৈরি হওয়া শৈত্যপ্রবাহে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় ২২ জন মারা গিয়েছেন। সাঙ্ঘাতিক তুষারঝড়ের পরে এই শৈত্যপ্রবাহ তৈরি হয়। ২০ বছরে এমন ঝঞ্ঝা ও তুষারপাত দেখা যায়নি। কোনও কোনও জায়গায় ১৩ ইঞ্চি বরফ পড়েছিল। তাপপ্রবাহ ও শৈত্যপ্রবাহের প্রতিটি ঘটনায় বিজ্ঞানীরা জলবায়ু পরিবর্তনের ছাপ দেখতে পেয়েছেন।

সাইক্লোন: সমুদ্রের জলতল ও উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে বিধ্বংসী ঝড়ের সংখ্যা ও তাতে ক্ষতির পরিমাণ অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। একটি উদাহরণেই সেটা বোঝা যায়। মাত্র ছয় সপ্তাহের ব্যবধানে আছড়ে পড়া ঝড় ইদাই ও কেনেথ মোজাম্বিককে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে।

দাবানল: দাবানলের সংখ্যাও গত চার বছরে বেড়ে গিয়েছে। ২০১৯ সালে সুমেরু বৃত্তে সবচেয়ে উত্তপ্ত জুন মাস নথিবদ্ধ হয়েছে। এই উত্তাপ শুধু জুনেই গ্রিনল্যান্ড, সাইবেরিয়া ও আলাস্কায় সৃষ্টি করেছে একশোটিরও বেশি দাবানল। এদের কয়েকটি প্রায় ১ লক্ষ হেক্টর বন জুড়ে জ্বলেছে। সুমেরু দাবানল শুধু জুনে যে পরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ করেছে সেটা এর আগের দশ বছরে নির্গত কার্বন ডাইঅক্সাইডের মোট পরিমাণের থেকেও বেশি। এ ছাড়া সাম্প্রতিক আমাজনের দাবানলের ভয়াবহতা আমাদের প্রায় শ্বাসরুদ্ধ করে দিয়েছে।

পারমাফ্রস্টের গলে যাওয়া: সুমেরু বৃত্তের দাবানলে উত্তাপ বৃদ্ধি সুমেরু অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ চিরবরফ গলিয়ে দিলে উন্মুক্ত হয়ে পড়বে বহু যুগের হিমায়িত মৃত উদ্ভিদ ও প্রাণিকুল। ব্যাকটেরিয়ার পচনে তৈরি হবে গ্রিন হাউস গ্যাস মিথেন।

অর্থাৎ বিশ্ব উষ্ণায়ন কমার কোনও লক্ষণ তো নেই-ই, বরং তা আরও বাড়ছে। সঙ্কটে জনস্বাস্থ্য, খাদ্য সুরক্ষা, অর্থনৈতিক অগ্রগতি। বাড়ছে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়ার মতো রোগ। কমছে চাষযোগ্য জমি, ফসলের ফলন। মাত্র ১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপবৃদ্ধিতে গমের ফলন কমবে ৬.৪ শতাংশ। আমাদের হাতে একটুও সময় নেই। যা করার এখনই করতে হবে।

আইপিসিসি-র রিপোর্টে বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে সীমিত রাখতে হলে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমাতে হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে ২০১০ সালের তুলনায় ৪৫ শতাংশ এবং ২০৫০ সালের মধ্যে শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই লক্ষ্যে পৌঁছনো সম্ভব। তার জন্য দ্রুত ও অভূতপূর্ব পরিবর্তন আনতে হবে শক্তি উৎপাদন, পরিবহণ ব্যবস্থা ও জীবনযাত্রায়। অর্থাৎ সমাজজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই। তার মানে শুধু রাষ্ট্র নয়, সক্রিয় হতে হবে প্রত্যেককেই।

প্রধান শিক্ষিকা, বহরমপুর লিপিকা মেমোরিয়াল গার্লস হাই স্কুল

তথ্যসূত্র—১) IPCC, Special Report on Global Warming of 1.5°c ২) WMO Report on Global Climate in 2015—2019, Climate Change Accelerates

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement