বন্যা আসিলে এক আশ্চর্য দৃশ্য দেখা যায়। নেতা-মন্ত্রীরা হেলিকপ্টারে চড়িয়া, ট্র্যাক্টরে চাপিয়া প্লাবিত এলাকা দেখিতে যান। অথচ বন্যা প্রতিরোধের কাজে সম্বৎসর তাঁহাদের কোনও ব্যস্ততা নাই। পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল তিন দশকের সরকারি নিষ্ক্রিয়তার সাক্ষী। ১৯৮২ সালে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের শিলান্যাস হইয়াছিল। অতঃপর আর কিছুই হয় নাই। তৃণমূল সাংসদ দীপক অধিকারী ওরফে দেব সম্প্রতি জলমগ্ন এলাকায় দাঁড়াইয়া আশ্বাস দিয়াছেন, তিনি সংসদে বিষয়টি লইয়া প্রশ্ন তুলিবেন। এলাকার লোকে অবশ্য প্রশ্ন করিতে পারিতেন, গত বৎসরই কি তিনি প্রশ্নটি লোকসভায় তোলেন নাই? তাহার পর এক বৎসরেও যদি কাজ না হইয়া থাকে, আগামী বৎসরেও কি হইবে? রাজ্যে সরকার বদলাইয়াছে, ঘাটালের ভাগ্য বদল হয় নাই। বিস্তীর্ণ এলাকা বন্যার কবলে, শহরে ও গ্রামে মানুষের দুর্দশার অন্ত নাই। জলবন্দি মানুষকে আকাশপথে উদ্ধার করিতে হইতেছে। এ বৎসর কংসাবতীর বাঁধ ভাঙিয়াছে বলিয়া সংকট আরও ভয়াবহ, কিন্তু বর্ষা আসিলেই ডুবিয়া যায় ঘাটাল মহকুমা। ঘাটাল পুরসভার সতেরোটি ওয়ার্ডের মধ্যে বারোটি যায় জলের তলায়। শহরের রাস্তায় নৌকা চলে।
দীর্ঘসূত্রতা সরকারের স্বভাব, কিন্তু ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান লইয়া সরকারি নিষ্ক্রিয়তা যেন মাত্রা ছাড়াইয়াছে। একাধিক বার পরিকল্পনা সংশোধনের পর ২০১৫ সালের মে মাসে কেন্দ্রীয় সরকার ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানকে সবুজ সংকেত দিয়াছিল। তাহার পরও কাজ শুরু নাই। তাহার কারণ রাজ্য ও কেন্দ্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব। রাজ্যের দাবি, পরিকল্পনার খরচের তিন-চতুর্থাংশ বহন করিতে হইবে কেন্দ্রকে। এমনই পূর্বশর্ত ছিল। কেন্দ্র কেবল অর্ধেক বহন করিতে চায়। এই টানাপড়েনে সতেরো হাজার কোটি টাকার পরিকল্পনা ফাইলবন্দি। অথচ ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়িত হইলে এক বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ বন্যার প্রকোপ হইতে রক্ষা পাইতেন, এলাকার কৃষিরও উন্নতি হইত। কংসাবতী ও শিলাবতী নদীর অংশবিশেষ সংস্কার, তৎসংলগ্ন খালগুলি সংস্কার, তাহাতে স্লুইস গেট নির্মাণ, বাঁধ নির্মাণ, পাম্প হাউস নির্মাণ, পরিকল্পনা অনুসারে কার্যে পরিণত হইলে বন্যা নিবারণ ছাড়াও এলাকার উন্নয়নে গতি আসিত।
সুপ্রিম কোর্ট বলিয়াছে, জীবনের অধিকারের অর্থ মর্যাদার সহিত বাঁচিবার অধিকার। বিদ্যুৎ-বিচ্ছিন্ন, পানীয় জলহীন, নৌকামাত্র সম্বল করিয়া বাঁচিয়া থাকা যেমন বিপজ্জনক, তেমনই অসম্মানজনক। অথচ প্রতি বছর সেই পরিস্থিতির দিকেই সরকার ঠেলিতেছে ঘাটালের মানুষকে। বহু দিনে, বহু অর্থ ব্যয়ে দুর্যোগ প্রতিরোধের পরিকল্পনা প্রস্তুত করিয়া তাহা হাতে লইয়া বসিয়া আছে কেন্দ্র ও রাজ্য। তাহার অর্থ, সরকার নাগরিকের সুরক্ষা ও মর্যাদাকে লঘু করিয়া দেখিতেছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করিয়াছেন, কেন্দ্রের অসহযোগিতায় প্রকল্প এগোয় নাই। তাঁহার অভিযোগ সম্ভবত সম্পূর্ণ অসত্য নহে। বারবার পরিকল্পনার ত্রুটি ধরিয়া তাহাকে বাতিল করিয়াছে কেন্দ্র। অর্থ বরাদ্দ পিছাইয়াছে এবং প্রকল্পের ব্যয়ে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ কমাইয়াছে। ইহা ঘাটালবাসীর প্রতি কেন্দ্রের সহানুভূতির লক্ষণ নহে। কিন্তু দলীয় দ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে উঠিয়া উন্নয়নের কাজ করিবার কৌশল রাজনীতির একটি প্রধান শর্ত। সেই বিচারে ব্যর্থ তৃণমূল সরকার।