মাজিগ্রাম। বর্ধমান জেলার একটা অজ পাড়াগাঁ। সেই গ্রামের বাসিন্দা বিনোদবিহারী পাঁজা আর তাঁর স্ত্রী বিশ্বেশ্বরী দেবীকে মনে রাখার মতো কারণ ছিল না। কিন্তু তাঁদের গ্রাম এখনও তাঁদের মনে রেখেছে তাঁদের বড় ছেলের কারণে। বিনোদবিহারীদের দুটি সন্তান। গণপতি আর ধনপতি। গরিব ঘরের ছেলে, অন্নচিন্তা চমৎকারা। তার ওপর গণপতি বছর সাতেক বয়সেই অনাথ হয়েছেন। কে জোগাবে তাঁদের মুখের ভাত?
তবুও ভর্তি হয়েছেন গ্রামের পাশের স্কুলে। গরিব হতে পারেন, কিন্তু মগজটা একেবারে খাসা। মিডল ইংলিশ স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির পরীক্ষা পাশ করে গেলেন প্রথম হয়ে। কিন্তু শহরে থেকে স্কুলে পড়াশুনোর স্বপ্ন দেখা সাজে না। তবু হাজার স্বপ্ন দেখতে দেখতে এক জনকে সঙ্গী করে কলকাতা এলেন ভাগ্যের সন্ধানে। ঘটনাচক্রে একটা বড় বাড়ির হাতায় বসে আছেন— পড়ে গেলেন সেই রাজবাড়ির মালিকের নেকনজরে। তিনিই কাশিমবাজার-রাজ মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী। সব শুনে বললেন, তুমি থেকে যাও আমার কাছে, পড়াশুনোয় এত ভাল, তোমাকে একটা ভাল স্কুলে ভর্তি করে দিচ্ছি, এখানেই খাবে। গণপতি কাঁচুমাচু করে বললেন, বাবু, আমি থাকতে পারি, যদি আমার ছোট ভাইটাকেও আমার কাছে থাকতে দাও। আমাকে যা খেতে দেবে, দুই ভাই মিলে তা-ই ভাগ করে খাব। বাপ-মা মরা ভাই, ওকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না।
মহারাজ রাজি হয়ে গেলেন। ধনপতিকেও নিয়ে এলেন কলকাতায়, ভর্তি হয়ে গেলেন হিন্দু স্কুলে। আর মহারাজের কাজের লোকেরা যেখানে থাকেন, সেখানেই মাথা গোঁজার ঠাঁই হল। এ বার তরতরিয়ে এগিয়ে যাওয়া। হিন্দু স্কুল থেকে প্রেসিডেন্সি— প্রায় সব ক্লাসেই প্রথম। ডাক্তারি পড়ার খুব ইচ্ছে শুনে গণপতিকে মহারাজ ভর্তি করে দিলেন মেডিক্যাল কলেজে। সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে দিল সোনার মেডেল। শুধু মহারাজ নন্দীমশাই নন, রাজাবাজারের সোম পরিবারও দরাজ হাতে গণপতিকে সাহায্য করলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পদক ছাড়াও পেলেন নানা বৃত্তি। ছাত্রাবস্থাতেই চিকিৎসাবিদ্যা বিষয়ে একটা বইও লিখে ফেলেছিলেন, ডাক্তারি পাশ করার আগেই তাঁর বই ডাক্তারি ছাত্রদের হাতে হাতে ঘুরত।
ডাক্তারি পরীক্ষা পাশ করলেন ১৯১৯ সালে। মেডিক্যাল কলেজের বিভিন্ন বিভাগে হাউস স্টাফের কর্তব্য পালন করে তিনি স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিলেন ১৯২১ সালে। সেখানে তখন অধ্যাপনা করছেন বিখ্যাত ত্বকতত্ত্ববিদ লে. কর্নেল এইচ ডব্লিউ অ্যাকটন। তাঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এলেন ডাঃ পাঁজা। চাকরিতে যোগ দিয়েছেন বটে, কিন্তু সেখানে ত্বকবিজ্ঞানের কোনও বিভাগ নেই, ব্যবস্থাও নেই। সাহেব বললেন, তোমার মনের মতো করে তুমি বিভাগ গড়ে নাও। তাতেই এখানে ত্বকবিজ্ঞান বিভাগের উদ্বোধন ঘটল— তিনিই এখন সেই বিভাগের অধ্যাপক। তার পর টানা সাতাশ বছরের গবেষণা এবং সেবা। হলেন প্যাথলজির অধ্যাপকও। দেশবিদেশে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ল। তাঁর কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে গরিমাময় ‘কোটস বৃত্তি’ প্রদান করল ১৯৪১ সালে, তখন তাঁর বয়স ঠিক পঞ্চাশ (জন্ম ১৮৯১)।
তার আগেই বহুপ্রার্থিত আরও একটি বৃত্তি তাঁকে ভূষিত করেছিল। ১৯৩২ সালে আমেরিকা থেকে সরাসরি তাঁকে ‘রকফেলার বৃত্তি’ দেওয়া হয়েছিল, লন্ডনে থেকে জীবাণুবিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণা করার জন্য। বৃত্তি পেয়ে লন্ডনে গিয়ে তিনি গভীর গবেষণান্তে অর্জন করলেন ‘ডি. ব্যাক্ট’ উপাধি। দেশে ফিরে আসার আগেই এডিনবরা রয়্যাল ইনফারমারি-তে কিছু দিন কাজ করেন এবং ইউরোপীয় মহাদেশের বিভিন্ন ত্বকরোগ সংক্রান্ত ক্লিনিকেও গবেষণা করেন।
দেশে ফিরে এসেই তাঁর আপন প্রতিষ্ঠানে তিনি কর্মরত থাকলেন জীবাণুবিজ্ঞান এবং প্যাথলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক হিসেবে। ভারতে এটিই এই বিষয়ের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠান। এর আগে ডারমাটোলজি-তে প্রথম বিভাগটির সূত্রপাত হয়েছিল মুম্বইয়ের স্যর জে জে হসপিটালে। তিনি নিজেকে নিয়োজিত করলেন গবেষণার কাজে। প্রতিনিয়তই ‘পেপার’ তৈরি করছেন পরবর্তী প্রজন্মকে নীরোগ রাখার সাধনায়। তাঁর গবেষণার বিষয় বিচিত্র। খুসকি হয় কেন, আর তার প্রতিকারই বা কী? অথবা নিদানতত্ত্বের সফল ব্যাখ্যা। ছুলি হয় কেন? চামড়ার বর্ণ বদল, তা-ও তিনি বলে দিলেন। তিনিই তখন একমাত্র ভারতীয় ছিলেন, যিনি সফল ভাবে উদরাময় প্রভৃতি আন্ত্রিক রোগ কেন হয়, তা নির্ণয় করেন।
দীর্ঘ প্রযত্নের পর ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ডারমাটোলজি অ্যান্ড ভেনেরোলজি প্রকাশ করলেন প্রধান সম্পাদক হয়ে। সেটা ১৯৫৫ সালের জুন মাস। শুরু হওয়ার মাত্র চার মাসের মধ্যে ডাঃ পাঁজাই প্রধান সম্পাদক হলেন অক্টোবর ১৯৫৫ সালে, তখন পত্রিকার নাম হল ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ডারমাটোলজি। এর চার বছর পরেই তাঁকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হল। কিন্তু, যে অমিত বেগ তিনি সঞ্চার করে গেলেন, তাতে এই উদ্যোগ বহমান থাকল।
বহমান ছিল সম্মান প্রাপ্তির ধারাও। ১৯৪৭ সালে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতি (মেডিক্যাল ও পশুচিকিৎসা বিভাগ) নির্বাচিত হন। স্বাধীনতাপ্রেমে উজ্জীবিত ডাঃ পাঁজা টাই পরা ছেড়ে দিলেন। গ্রামের উন্নতির জন্য তিনি সদা সচেষ্ট। মায়ের নামে স্থাপন করলেন বিশ্বেশ্বরী উচ্চ বিদ্যালয় আর বাবার স্মৃতিতে বিনোদবিহারী পাঁজা নিম্ন বুনিয়াদি বিদ্যালয়। কত গরিব ছেলে যে তাঁর দানে শিক্ষিত হয়ে উঠেছিলেন, তার হিসেব কে দেবে?
ধমনিতে প্রতিবন্ধকতা ঘটায় হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ডাঃ পাঁজা চলে গেলেন ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৫৯। যাওয়ার আগে হাসপাতাল স্থাপনের জন্য জমির ব্যবস্থা করে গিয়েছেন। ডাঃ গণপতি পাঁজার নামে সেখানে একটি হাসপাতাল তৈরির উদ্যোগই সম্ভবত এই ক্ষণজন্মা চিকিৎসকের স্মৃতিকে একটি স্থায়ী সম্মানে ভূষিত করবে।