আপনার অভিমত

মুখ খুললেই ‘দেশদ্রোহী’! শুভবুদ্ধি কি অস্তাচলে?

তিনি নাসিরুদ্দিন শাহই হোন বা নদিয়ার কোনও স্কুলের প্রধান শিক্ষক, মানুষের জন্য উদ্বিগ্ন হওয়ার অধিকার সকলের সমান। লিখছেন স্মরণজিৎ চক্রবর্তী তিনি নাসিরুদ্দিন শাহই হোন বা নদিয়ার কোনও স্কুলের প্রধান শিক্ষক, মানুষের জন্য উদ্বিগ্ন হওয়ার অধিকার সকলের সমান। লিখছেন স্মরণজিৎ চক্রবর্তী

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮ ০১:৪২
Share:

নাসিরুদ্দিন শাহ

রাজস্থানের অজমেঢ়ে যে লিটারারি মিট অনুষ্ঠিত হয় সেখানে বর্ষীয়ান অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল সেই অনুষ্ঠানের পঞ্চম বর্ষের উদ্বোধন করার জন্য! কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর শ্রীশাহ যেতে পারেননি, কারণ তাঁর কাছে অনুষ্ঠান কর্তৃপক্ষের থেকে অনুরোধ আসে যে, তিনি যেন ওখানে না আসেন!

Advertisement

এর কারণ হল শ্রীশাহ তাঁর এক দিন আগে একটা অনুষ্ঠানে বলেছিলেন যে, এখন এক জন পুলিশ অফিসারের মৃত্যুর চেয়ে একটি গোরুর মৃত্যু বেশি গুরুত্বপূর্ণ! এর পরে এ-ও বলেছিলেন যে, তিনি নিজের সন্তানদের জন্যও ভীত। কারণ যদি ‘মব’ তাদের ঘিরে ধরে জিজ্ঞেস করে যে, তারা হিন্দু না মুসলমান তারা উত্তর দিতে পারবে না!

এই কথার পরেই কিছু দক্ষিণপন্থী সংগঠন, যার মধ্যে বিজেপি’র ‘ভারতীয় জনতা যুব মোর্চা’ও রয়েছে, প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠেন এবং শ্রীশাহকে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে বলে দাবি করেন। এমন কী খবরে জানা গিয়েছে যে, ফেস্টিভ্যালে শ্রীশাহের পোস্টারও পোড়ানো হয়।

Advertisement

এর সঙ্গে সঙ্গে আরও নানা রকমের প্রতিক্রিয়া দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসতে শুরু করে। শিবসেনার শ্রীমতি মনিষা কায়ান্দে বলেন যে, অভিনেতা যদি এই দেশে সুরক্ষিত মনে না করেন উনি তা হলে পাকিস্তানে চলে যেতে পারেন!

উত্তরপ্রদেশের বিজেপি নেতা এ-ও বলেন যে শ্রীশাহ একটি ছায়াছবিতে পাকিস্তানের এজেন্ট-এর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন এবং এখন তিনি সেই চরিত্রটির মতোই হয়ে উঠেছেন!

শ্রীশাহ বলেছেন— তিনি ভারতীয় হিসেবে চিন্তিত, তাই এমন বলেছেন।

হ্যাঁ, শুধু শ্রীশাহই নন, আমরাও সবাই ভারতীয় হিসেবে চিন্তিত! কোথায় যাচ্ছি আমরা! কোথায় যাচ্ছে দেশ? কেন কিছু রাজনৈতিক দল অন্য গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা বাদ দিয়ে এই সব নিয়ে এত মাতামাতি করা হচ্ছে! ধর্মীয় মেরুকরণ করে বিভেদ সৃষ্টি করলে আখেরে লাভ হতে পারে— এই ধারণা থেকেই কি এ সব করা!

কেউ বলেছেন যে শ্রীশাহের এমন মন্তব্যে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে! কিন্তু তাঁরা কি ভুলে গিয়েছেন যে, একের পর এক ‘মব লিঞ্চিং’এর মতো ঘটনা যখন ঘটতেই থাকে, আর সারা পৃথিবী যখন সেটা জানতে পারে তখন কি আমাদের দেশের এমনিতেই আর খুব উজ্জ্বল থাকে না! গোরক্ষার নামে মানুষ মারার মধ্যে যে এক ধরনের ‘ল-লেসনেস’ আছে সেটা কি বুঝতে খুব অসুবিধে হয়! কিন্তু যারা এমনটা করছে, তাদের বিরুদ্ধে কি দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে যাতে এমন কাণ্ড ঘটানোর আগে বাকিরাও ভাবে!

কেন বার বার এমন কোনও বিখ্যাত ব্যক্তির বক্তব্য নিয়ে তোলপাড় হয়? সেটা কি আসলে মূল ঘটনাকে চাপা দেওয়ার এক রকমের চেষ্টা! নানান বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করে কি মানুষের মন ঘুরিয়ে দেবার চেষ্টা! দেশের কীসে ভাল, সেটা কি কেবল এক শ্রেণির লোকই বোঝে? তাদের মত অনুযায়ী চললেই কি বাকিদের ‘দেশপ্রেমী’ বলা হবে! আর না চললেই বলা হবে ‘দেশদ্রোহী’? বলা হবে অন্য দেশে গিয়ে থাকতে?

এই সব রাজনৈতিক দল ও তাদের লোকজন কেন এমন একটা ভয় আর উৎকণ্ঠার পরিবেশ তৈরি করতে চান? এইটাই কি বোঝাতে চান যে, তাঁদের সঙ্গে থাকলেই জনগণ সুরক্ষিত?

প্রশ্ন হল, জোর করে মনের দখল নিয়ে নিজের ক্ষমতা কায়েম করতে চাওয়া কি কাম্য? না কি সমাজকে শিক্ষিত ও উন্নত করে মানুষকে স্বাধীন মতামত নেওয়ার মতো যোগ্য করে তুলে, তাঁদের উপরে আস্থা রাখাটাই দেশের জন্য সুসংবাদ!

কোন দিকে এগোবে দেশ? ক্ষমতা ধরে রাখতে কতটা স্বার্থপর হবে রাজনৈতিক দলগুলো? ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য আজকে যা করা হচ্ছে সেটার ফল সমগ্র দেশের উপর কুড়ি বছর পরে কী প্রভাব ফেলবে?

আমাদের দেশ যাঁরা চালান, চালাবেন— তাঁদের থেকে আমরা দূরদৃষ্টি আর ‘কন্সট্রাকটিভ ভিশন’ আশা করি। কারণ, আজকের সঙ্গে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করে রাখা দরকার। আজকের ভিত মজবুত না হলে কালকের দেশ শক্তিশালী ও স্বনির্ভর হবে না। দেশের মধ্যে যদি দুর্বলতা থেকে যায়, তা হলে যেমন বিচ্ছিন্নতাবাদীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে, তেমনই তাদের দমন করার অজুহাতে নানা শক্তি নিজেদের লাঠির জোর দেখাতে শুরু করবে!

তাই দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল সেই হবে যে, আজকে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরার ক্ষুদ্র স্বার্থের চেয়ে দেশের সুদূরপ্রসারী ভালটিই আগে চাইবে। গাছ যদি না বাঁচে, তবে ভবিষ্যতে সেই গাছের থেকে ফুল-ফল-ছায়া কিছুই আমরা পাব না!

ভয়ের জায়গাটা এখানেই যে, এ সব কেউ ভাবছে না। বরং, ধর্মকে সামনে রেখে ক্ষমতাদখলের যে সুপ্রাচীন রাজনীতি আমরা ইতিহাসে পড়ে এসেছি, তা নতুন ভাবে আবার আমাদের দেশে পুনরাবৃত্তি হচ্ছে!

কৃষকদের দুরবস্থা, তাঁদের ফসলের ঠিক দাম না পাওয়া, ফড়েদের দৌরাত্ম্য আর এর ফলশ্রুতিতে কৃষক তথা কৃষিক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিকদের আত্মহত্যা, দেশের তীব্র বেকার সমস্যা, অশিক্ষার হার, চূড়ান্ত দুর্নীতি, জনবিস্ফোরণ ইত্যাদির মতো ভয়াভয় সব সমস্যায় আমাদের দেশ, রাজ্য, জেলাগুলি জর্জরিত! এ ছাড়া আমাদের প্রতিবেশী সব দেশও যে খুব বন্ধুভাবাপন্ন, এমনও নয়। ফলে, প্রতিরক্ষা খাতে বিপুল ব্যয়ভার! সব মিলিয়ে স্বাধীনতার একাত্তর বছর পরে আমাদের দেশ খুব একটা স্বস্তিদায়ক জায়গায় নেই।

দেশ সার্বিক একটি ভাবনা। জেলা, ব্লক, মহকুমা স্তরের ছোট ছোট প্রকোষ্ঠে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে হাজারো সমস্যা। মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক সে সব সমস্যার সমাধান না খুঁজে আমরা অকারণ, অর্থহীন কিছু বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে লড়াই করে চলেছি, মানুষে মানুষে সম্প্রীতি নষ্ট করছি! আসল সমস্যার চোখে চোখ রেখে তা মোকাবিলা করার কথা ভাবা তো দূরস্থান, বরং আমরা দেখছি ধর্মের জিগির তুলে চারিদিকে কেমন একটা উত্তেজনা ছড়ানোর চেষ্টা চলছে! মানুষের মেরুকরণ করে সেখান থেকে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা চলছে! কখনও মন্দিরের নামে, কখনও গোমাতা রক্ষার নামে অশান্তি তৈরি করা হচ্ছে। এক ধরনের ভিজিলান্টি গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে, যারা গোরক্ষার নামে ‘লিঞ্চিং’এ প্রবৃত্ত হয়েছে! দেশের সংবিধান যেখানে সবাইকে সমান অধিকার দিয়েছে, সেখানে এ সবকে প্রশ্রয় দেব কেন?

এর ঊর্ধ্বে ওঠার সময় এসে গিয়েছে। শুভবুদ্ধিকে অস্ত যেতে দেওয়া যাবে না। আর এর জন্য জনগণকেই সচেতন হতে হবে। ক্ষমতা দখলের যে নানান ফন্দি-ফিকির চলছে, তার থেকে সাবধান হতে হবে। ধর্ম কখনই হিংসার কথা বলে না। আর আমার দেশের ব্যাপারে, দেশের মানুষের ব্যাপারে, যে কোনও রাজ্যের যে কোনও প্রান্তিক সহনাগরিকটির ব্যাপারে আমারও চিন্তিত হওয়ার অধিকার আছে! আশঙ্কা জানানোর অধিকার আছে! আর যাঁর হাতে প্রশাসনের শাসনভার, তাঁর দায়িত্ব হল সেই আশঙ্কা দূর করা। কারণ ক্ষমতাসীনের দায়িত্ব অনেক বেশি।

তিনি নাসিরুদ্দিন শাহই হোন বা নদিয়ার কোনও স্কুলের প্রধান শিক্ষক— অন্যায়ের বিরুদ্ধে কণ্ঠ তোলায়, জাতিধর্ম-নির্বিশেষে মানুষের জন্য উদ্বিগ্ন হওয়ায় সকলের সমান অধিকার। আর ‘অন্যের কিছু শুনব না’ বা ‘বোঝার চেষ্টা করব না’ মনোভাব কোনও মানুষ বা দলের পক্ষে ভাল বিজ্ঞাপন নয়। কারণ, অসহিষ্ণু শাসক দেশের পক্ষে বিপজ্জনক। বিপজ্জনক সমাজের অগ্রগতির পক্ষেও।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement