জাগরণ: ১৯৬৮-র স্মরণে ফ্রান্সে প্রতি বছর মে মাস জুড়ে যে উৎসব হয়, অর্ধ শতক পূর্তিতে তার জৌলুস ছিল দ্বিগুণ। প্যারিস, ১ মে। গেটি ইমেজেস
বৃদ্ধ না হলেও, ২০১৮-য় তিনি পঞ্চাশে পা দিলেন। ফ্রান্সের মে ১৯৬৮-র ঐতিহাসিক যুব–বিদ্রোহের কথা বলছি। এ দেশের নকশালবাড়ি আন্দোলনের ফরাসি দোসর। শুধু ভারত বা ফ্রান্স নয়, জাপান থেকে চিন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পশ্চিম ইউরোপ, পৃথিবীর দিকে দিকে বুর্জোয়াতন্ত্রের সমার্থক বরিষ্ঠতন্ত্রের কব্জা থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী তরুণ প্রজন্ম তখন বদ্ধপরিকর। তবে ফ্রান্সের পড়ুয়া মহলে প্রধানত সাড়া ফেলেছিল মার্কিন দেশের বার্কলে খ্যাত ফ্রি স্পিচ আন্দোলনের খবর।
গত শতকের গোটা পঞ্চাশের দশক ও ষাটের গোড়া অবধি ফ্রান্সে এক টালমাটাল সময়। ঘরের ভিতরে বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কা, ধ্বংসপ্রাপ্ত পরিকাঠামো পুনর্নির্মাণের চাপ, বাইরে ইন্দো-চিন আর আলজিরিয়ার যুদ্ধ ও পরিশেষে উপনিবেশের অবসান। ইতিমধ্যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও আধুনিকীকরণের হাত ধরে এল এক প্রাচুর্য ও ভোগোন্মাদনার যুগ, যার চিত্র এঁকেছেন জর্জ পেরেক তাঁর Les Choses (বস্তুপণ্য) উপন্যাসে। ষাটের দশকে সদ্যোজাত পণ্য-সমাজের সামনে দাঁড়িয়ে পণ্য-সম্ভোগ ঘিরে এক তরুণ দম্পতির স্বপ্ন, আশা, আকাঙ্ক্ষা, হতাশার এক সমাজতাত্ত্বিক দলিল। আর সম্ভোগ শুধু বস্তুপণ্যের নয়, বিজ্ঞাপনের চলমান বা নিশ্চল চিত্র-বাহিত দৃশ্যপণ্যেরও, যা জন্ম নিচ্ছে প্রতিনিয়ত। অথচ সমাজ-পারিবারিক সনাতন মূল্যবোধের অচলায়তন অবাধ পণ্য-সম্ভোগের পথে অন্তরায়। অন্য দিকে, চলনে, বলনে পরিধানে পণ্য-সমাজই আবার ধনী-দরিদ্র বিভেদ মুছে তরুণ সমাজকে গেঁথে দিচ্ছে এক সূত্রে। ১৯৬৫ সালে বই-প্রকাশ কালে পেরেককে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনার চরিত্ররা পণ্য-সম্ভোগ ছাড়া আর কী করতে পারত? ভবিষ্যৎদ্রষ্টা পেরেক বলেছিলেন, “ঠিক জানি না। হয়তো বিদ্রোহের ডাক দিতে পারত, ‘সবার জন্য চেস্টারফিল্ড ডিভান’ দাবিতে।’’
এ দিকে বাপ-ঠাকুরদার জীবন চুইয়ে নেমে আসে ১৯৩৬-এর বাম আন্দোলন, নাৎসি-বিরোধী মুক্তিযুদ্ধ। অদূর অতীতের সেই সব বীরগাথা ও যৌথ যাপন মাথার ভেতরে বোনে শ্রেণিহীন সমাজের ইউটোপিয়া। আবার এই বীরগাথার এক প্রতিভূ শার্ল দ্য গল-এর ভাবভঙ্গিতে প্রকাশ পায় পিতৃতন্ত্রের ঔদ্ধত্য। অনেকে বলেন, এক দিকে দ্য গল-এর দোর্দণ্ড প্রতাপ, অন্য দিকে চিত্রতারকা ব্রিজিত বারদো-র যৌন আবেদন— এই দুই খুঁটির মধ্যে টানা দড়িতে ঝুলছিল যেন এই প্রজন্মের ফ্রান্স। তার স্বপ্ন, আকঙ্ক্ষা মূর্ত হয়ে উঠেছে ১৯৬৬-তে গাওয়া ফ্রান্সের প্রথম রক-তারকা জনি হ্যালিডে-র গানে: “বাবার কাছেই তুই মুক্তি ভিক্ষা চাস/ যে বাবা বোঝে না তোকে, বুঝতেও চায় না... চাপা কান্না ফেটে পড়ে/ হতোদ্যম পৃথিবীর মুখে... পৃথিবীর ’পর তোর প্রজন্মের ক্রোধ।”
১৯৬৬-তে প্রথম প্রজন্মের রঙিন টেলিভিশনের দৌলতে সুদূর চিন থেকে এসে পৌঁছয় ‘কমরেড মাও’-এর ইয়াংসির জলে সাঁতারের ছবি। এসে পৌঁছয় ‘সদর দফতরে কামান দাগা’র গল্প। কলেজ-পাড়া ল্যাটিন কোয়ার্টার্স সহসাই যেন লাল হয়ে ওঠে। রেড বুক বিকোতে শুরু করে হাজারে হাজারে। ইতিমধ্যে শুরু হল ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসন। সেই ছবিও মিডিয়া-বাহিত এসে পৌঁছল অবিলম্বে। এসে পৌঁছল চে গেভারার কিংবদন্তি। ডিলানের সঙ্গে ঠোঁট মেলাল পেরেকের উপন্যাসের চরিত্ররা: দ্য টাইমস দে আর আ-চেঞ্জিং। মাও-চে-হোচিমিন-ট্রটস্কি অনুপ্রাণিত এই নবীন ‘অতি-বাম’ প্রজন্মের চোখে সোভিয়েতপন্থী ‘প্রবীণ’ বাম প্রতিষ্ঠানের দালাল। আর নবীনের প্রতি প্রাতিষ্ঠানিক বামের সন্দেহ, বিদ্বেষ ও তাচ্ছিল্য।
যুদ্ধের পর ফ্রান্সে ঘটেছিল এক প্রজনন-বিস্ফোরণ। ষাটের দশকে, প্যারিসের সরবন বিশ্ববিদ্যালয় যুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্মের চাপ আর নিতে পারছিল না। শহরের উপকণ্ঠ, ননতের-এ মার্কিন মডেলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর বানানোর প্রয়োজন হল। চত্বরের অনতিদূরে হতশ্রী অভিবাসী শ্রমিক বস্তি। সমাজবিজ্ঞানের ছাত্রদের বিপ্লবের প্রথম পাঠ। তৃতীয় বিশ্বের দারিদ্র ও শ্রমিক-জীবন দেখার প্রথম সুযোগও। সেখানে আগে থেকেই যেন খানিকটা প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার জমি তৈরি ছিল।
২২ মার্চ ননতেরে মেয়েদের হস্টেলে ছেলেদের অবাধ প্রবেশের দাবিতে দানিয়েল কোন বেনদিতে-র নেতৃত্বে টানা ঘেরাও-বিক্ষোভ শুরু হয়। তার জেরে বিশ্ববিদ্যালয়ে তালা পড়ে। পড়ুয়ারা জমায়েত হন সরবন চত্বরে। ৩ মে মিটিং চলাকালীন সেখানে গ্রেফতার হন ছাত্র-নেতারা। বিক্ষোভকারীরা খেপে গিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েন। তিরিশ হাজার তরুণতরুণী ল্যাটিন কোয়ার্টার্সের দখল নেন, ঘিরে ফেলেন সরবন। রাজপথের পাথর উপড়ে তৈরি হয় ব্যারিকেড। এক সপ্তাহ ধরে দফায় দফায় চলে পুলিশের সঙ্গে জনতার খণ্ডযুদ্ধ। ১০ মে সারা রাত জনতা-পুলিশ সম্মুখসমরে এক হাজার আহত, জনা পঞ্চাশেকের অবস্থা গুরুতর। পাঁচশো ছাত্র গ্রেফতার। আজ থেকে ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আঁচ এসে পড়ে কলকারখানায়। ১৩ মে ঐতিহাসিক মিছিলে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটেন তিন লক্ষ ছাত্র ও শ্রমিক। শুরু হয় আন্দোলনের শ্রমিক অধ্যায়। ১৪ মে নঁত-এর পার্শ্ববর্তী একটি কারখানার দখল নেন শ্রমিকেরা। গোটা ফ্রান্স শ্রমিক ধর্মঘটে স্তব্ধ হয়ে যায়। ফ্রঁসোয়া মিতেরঁ, পিয়ের ম্যাঁদেস ফ্রঁসের মতো নেতারা সরকারের হয়ে মধ্যস্থতায় নামেন। শ্রমিকদের দাবিদাওয়া মেটাতে সরকার, শ্রমিক ইউনিয়ন ও মালিকপক্ষের মধ্যে ২৫-২৬ মে দু’দিন ধরে মিটিং চলে। ৪০ শতাংশ বেতনবৃদ্ধি ও বেশ কিছু সুযোগসুবিধা আদায়ের বিনিময়ে শ্রমিকরা কাজে ফিরতে সম্মত হন।
তখন ফ্রান্সে বেকারত্ব কম, উৎপাদনশীলতা বাড়ছে। তা হলে কেন শ্রমিক অসন্তোষ? শ্রমিকদের মতে, মালিক শ্রমিক মধ্যবিত্ত সকলে উন্নয়নের সমান ভাগীদার নয়। বেকারত্ব কম, কিন্তু বাড়ছে। ১৯৬৮-তে বেকারের সংখ্যা তিন লক্ষে পৌঁছেছে। ১৯৬৪-র তুলনায় চার গুণ। উৎপাদন ব্যয় কমাতে শিল্পসংস্থাগুলি শ্রমিক ছাঁটাইয়ের পথ নিয়েছে।
কিন্তু মুখ্য প্রশ্ন, কোন মুক্তির খোঁজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল গোটা একটা প্রজন্ম? সমষ্টি থেকে ব্যক্তির, পিতৃতন্ত্র থেকে পরিবার ও নারীর, সামাজিক অনুশাসন থেকে সম্ভোগ ও যৌনতার, রাষ্ট্রের মাতব্বরি থেকে নাগরিক সমাজের মুক্তি। এক দিকে রাষ্ট্রপ্রধান দ্য গল অনুপ্রাণিত সমষ্টিমুখী শাসনকাঠামোর খাড়াখাড়ি অবস্থান, অন্য দিকে কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থা, যার পিছন থেকে উঁকি দেয় গুলাগ-মার্কা স্বৈরাচার, এই দুইয়ের মাঝখান দিয়ে যে মুক্তি বানিয়ে নেয় এক আড়াআড়ি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী উদারপন্থী বিকল্প।
মে ১৯৬৮-র পরবর্তী দশকগুলিতে নারীবাদী, পরিবেশবাদী প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান-বিরোধী আন্দোলন ফনফনিয়ে উঠেছিল। পরিবারে, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে অবসান হয়েছিল পিতৃতান্ত্রিক স্বৈরাচারের। ১৯৮১-তে ফ্রান্সে ক্ষমতায় এলেন বামপন্থীরা, কিন্তু তাঁদের হাতেই আবার তৈরি হল মুক্ত বাণিজ্যের প্রাথমিক বুনিয়াদ, অর্থনৈতিক সংস্কার।
“...এ কথা অনস্বীকার্য যে ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে, অর্থাৎ সংস্কার সাধন করতে হবে। কারণ, অনেক বাধা পেরিয়ে দেশ এগোলেও তার অগ্রগতির পথে আরও অনেক বাধা রয়ে গিয়েছে...।” ২৪ মে দ্য গল-এর ভাষণ। প্রতিষ্ঠানের কণ্ঠে যেন প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার সুর। আমরা জানি, বিনির্মাণের দর্শনের জন্ম ও বৃদ্ধিও এই বিদ্রোহের দশকেই। এই উত্তর-আধুনিক তত্ত্বজ্ঞান যেমন পূর্ববর্তী প্রতিষ্ঠিত দার্শনিক প্রস্থানগুলিকে আগাগোড়া বাতিল করেনি, বরং ভিতর থেকে প্রশ্ন করে অন্য তাত্ত্বিক সম্ভাবনার পথ খুলে দিতে চেয়েছে, ফরাসি সমাজে মে ’৬৮-র আন্দোলনও খানিকটা অনু্রূপ ভূমিকা পালন করেছে। সনাতন মূল্যবোধের আগল ভেঙে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে শিখিয়েছে মুক্তির হাওয়ায় অভ্যস্ত হতে। যে হাওয়ায় এক দিন খুলে যাবে পণ্য-সমাজের— আজকের এই বিশ্বায়িত পণ্য-সমাজের সিংহদুয়ার। এ যেন সেই প্রবাদবাক্য: আগের সব কিছু বদলে দাও যাতে সব কিছু ঠিক আগের মতোই থাকে।