হন্যমান

ধর্মঘট আদৌ রাজনীতির অস্ত্র হইতে পারে কি না, সেই প্রশ্নটি বহুবিতর্কিত। যদি ধরিয়াও লওয়া যায়, শেষ অস্ত্র হিসাবে ধর্মঘটের ব্যবহার সঙ্গত, তবু কি তাহা গণতান্ত্রিক রাজনীতির নিয়মগুলিকে অস্বীকার করিতে পারে? না। গণতন্ত্রের পরিসরে প্রতিবাদ করিবার, এবং তাহার বিরুদ্ধতার অধিকার স্বীকৃত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share:

মা শাবানার কোলে স্বস্তিতে মহম্মদ হাসান আলি।—ফাইল চিত্র।

চার বৎসরের মহম্মদ হাসান আলির সহিত রাজনীতির পরিচয় হইল। ‘রাজনীতি’ শব্দটি তাহার কানে গেল কি না, তাহা গৌণ প্রশ্ন। সে জানিল, বড় বড় লাঠি হাতে বড়রা রাস্তায় নামেন, গাড়ির কাচ ভাঙিয়া দেন। সে জানিল, বাড়ি হইতে স্কুলে যাওয়ার পথটুকুও তাহার জন্য নিরাপদ নহে, কারণ সেই পথে বড়রা আছেন। সেই বড়রা ধর্মঘটী বামপন্থী, না কি ধর্মঘটবিরোধী তৃণমূল কংগ্রেস— হাসান আলির নিকট তাহা অবান্তর। সমাজের পক্ষেও কি একই রকম অবান্তর নহে? দুই দলের তর্জা চলিবে, পুলিশের বয়ান বদলাইবে অথবা বিরাজ করিবে নিটোল নৈঃশব্দ্য। হন্যমান পশ্চিমবঙ্গ শুধু জানিবে, রাজনীতি আজ এই অতলে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, যেখানে চার বৎসরের শিশুরও রেহাই নাই। অবশ্য, ইহাকে কোন যুক্তিতে রাজনীতি বলা যায়, সেই প্রশ্নটি এখনও উত্তরের অপেক্ষায়। অন্ধকার এই রাজ্য কম দেখে নাই। প্রকাশ্য রাজপথে ট্রাম পোড়ানো হইতে একের পর এক বন্ধ কারখানার গেটে রাজনৈতিক শবসাধনা, পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাস সব ক্ষতই বহন করিতেছে। আবার, বিরুদ্ধ স্বরকে দমন করিতে সরকারি বজ্রমুষ্টিও দেখিয়াছে বিলক্ষণ। বাম আমল হউক বা বর্তমান শাসনকাল, বিরোধীদের বহুবিধ দুর্ভোগ পোহাইতে হইয়াছে। রাজনীতির সহিত প্রত্যক্ষ যোগ নাই, এমন মানুষও রেহাই পান নাই। ৯ জানুয়ারি জানাইয়া দিল, শিশুরাও আর নিরাপদ নহে। রাজনীতির আগুন তাহাদেরও রেয়াত করিবে না। কোন দলের পতাকা, কোন দলের লাঠি আর কোন দলের পুলিশ, সব প্রশ্নই অবান্তর— বুধবারের রাজাবাজার জানিল, স্কুলের পোশাক পরা শিশুকেও রাজনীতির স্বরূপ বুঝিতেই হইবে।

Advertisement

ধর্মঘট আদৌ রাজনীতির অস্ত্র হইতে পারে কি না, সেই প্রশ্নটি বহুবিতর্কিত। যদি ধরিয়াও লওয়া যায়, শেষ অস্ত্র হিসাবে ধর্মঘটের ব্যবহার সঙ্গত, তবু কি তাহা গণতান্ত্রিক রাজনীতির নিয়মগুলিকে অস্বীকার করিতে পারে? না। গণতন্ত্রের পরিসরে প্রতিবাদ করিবার, এবং তাহার বিরুদ্ধতার অধিকার স্বীকৃত। কিন্তু, তাহা সভ্যতার রীতিকে উল্লঙ্ঘন করিতে পারে না। হিংস্রতা রাজনীতির ভাষা হইতে পারে না। এবং, সেই হিংস্রতা কোনও অবস্থাতেই সাধারণ মানুষকে বিপন্ন করিতে পারে না। সরকার যদি সম্পূর্ণ অন্যায় ভাবে, গায়ের জোরে বন্‌ধ বানচাল করিয়া দিতে চায়, তবুও তাহার প্রতিবাদে সাধারণ নাগরিকের উপর হিংস্র হইয়া উঠিবার অধিকার বিরোধী পক্ষের নাই। বামপন্থীরা আপত্তি করিয়া বলিবেন, স্কুলগাড়ির উপর আক্রমণ তাঁহারা করেন নাই। কিন্তু, দুই দিনব্যাপী ধর্মঘটে অন্যান্য হিংস্রতার দায় তো তাঁহাদের লইতেই হইবে। শত প্ররোচনাতেও দলীয় কর্মীরা যাহাতে হিংস্র না হইয়া উঠেন, তাহা নিশ্চিত করিবার দায় নেতৃত্বের। অন্য কোনও পক্ষ আসিয়া যাহাতে গোলমাল না বাঁধাইতে পারে, তাহাও নেতৃত্বকেই নিশ্চিত করিতে হইবে। যদি না পারেন, তবে গণপরিসরে কর্মসূচি গ্রহণের অধিকারও তাঁহাদের থাকে না। দায়িত্ব প্রশাসনেরও। ধর্মঘটের ডাক অগ্রাহ্য করিয়া মানুষকে পথে নামিতে বলিলে তাঁহাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তাও দিতে হয়। নচেৎ, শুধু রাজনীতি পড়িয়া থাকে। অথবা, চার বৎসরের মহম্মদ হাসান আলি যাহাকে রাজনীতি বলিয়া চিনিল, পড়িয়া থাকে সেই ভয়াবহ কঙ্কালটি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement