ছবি: সংগৃহীত।
নধর রসগোল্লাটির রূপ তো দেখিলেন, মেয়াদ দেখিয়াছেন কি? নূতন খাদ্যবিধি বলিতেছে, কোন মিষ্টান্ন কত ক্ষণ পর্যন্ত খাইবার উপযোগী থাকিবে, তাহা প্রদর্শন করিতে হইবে বিক্রেতাকে। এত দিন ক্রেতা প্রশ্ন করিয়াছেন দোকানিকেই, ‘টাটকা তো?’ দোকানি তাঁহাকে আশ্বস্ত করিয়াছেন, অথবা সুকৌশলে অন্য মিষ্টির দিকে দৃষ্টি ঘুরাইয়া দিয়াছেন। ভারতীয় সমাজের এই মিষ্টান্ন সংস্কৃতি হয়তো শেষ হইবার পথে, কেননা বৃহৎ খাদ্যশিল্পের জন্য প্রযোজ্য বিধিগুলি এই বার মিঠাই প্রস্তুতকারকদের উপরও আরোপ করা হইতেছে। সম্প্রতি দেশের খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ‘ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ডস অথরিটি’ নির্দেশ জারি করিয়াছে যে দেশব্যাপী সকল মিষ্টান্ন বিক্রেতাকে প্রতিটি মিষ্টির মেয়াদ প্রদর্শন করিতে হইবে। নূতন নির্দেশে মাথায় হাত পড়িয়াছে অনেকেরই, এমনকি রাজনীতিরও গন্ধ পাইতেছেন কেহ কেহ।
মিষ্টান্নের মেয়াদের মধ্যেও রাজনীতি? নিন্দকে মনে করাইতেছেন, সারা ভারতের মধ্যে কেবল বাংলার মিষ্টান্নেরই একটি বিশেষ চরিত্র আছে, এবং সেই কারণে বাংলার মিষ্টি শিল্প ও শিল্পীসমাজই ইহাতে ঘোর সঙ্কটে পড়িবে। একে তো বাংলার মিষ্টি মানেই ছানার মিষ্টি, যাহার মেয়াদ ক্ষীরের অপেক্ষা স্পষ্টতই কম। অতি ক্ষীণজীবী ও ক্ষণজীবী বলিয়াই যেন তাহার মাধুর্যের আর সীমা-পরিসীমা নাই। তাহা ব্যতীত, বাংলার মিষ্টি শিল্পের ধরনটিও পৃথক। উৎপাদন-বিপণনের পদ্ধতি ও পরিমাপে তাহাদের অধিকাংশই কার্যত কুটির শিল্পের অন্তর্গত। ছোট মাপের ব্যবসায়ী ছোট মাপের একটি দোকান চালাইয়া চলেন, এমন দৃষ্টান্ত কেবল গ্রামে-মফস্সলে নহে, শহরে নগরেও শতসহস্র। এই নির্দেশিকায় তাঁহাদের অনেকেই ক্ষুব্ধ, অনেকে বিপন্ন। মিষ্টান্ন প্রস্তুতকারকরা ক্রেতাদের বিশ্বাসকেই পুঁজি করিয়া চলেন। তাঁহাদের মতে, নূতন নির্দেশে অকারণ ঝকমারি বাড়িবে, ব্যয় তো বাড়িবেই। তবে কি বাংলা মিষ্টিকে লক্ষ্য করিয়াই নির্দেশিকা আসিল? কানাঘুষা যাহাই হউক, সামান্য আশার আলো মিলিয়াছে আপাতত। রাজ্যের ক্রেতা-সুরক্ষা মন্ত্রী মিষ্টান্ন প্রস্তুতকর্তাদের কিয়দংশে নিশ্চিন্ত করিয়াছেন এই বলিয়া যে প্রতিটি মিষ্টির আধারে পৃথক তারিখ প্রদর্শনের প্রয়োজন নাই। রসের মিষ্টির মেয়াদ এক দিন, সন্দেশ দুই দিন, এই রকম লিখিয়া বোর্ডে টাঙাইলেই হইবে।
বিপত্তারণ নীতিটি শুনিতে সহজ, কাজে ততটা নহে। সমস্যা থাকিয়াই গেল। একটি সমস্যা প্রায়োগিক, একটি নীতিগত। প্রথম সমস্যা মিষ্টির প্রকারভেদ লইয়া। রসের মিষ্টি ও সন্দেশ জাতীয় শুষ্ক মিষ্টি— এই দুইটি প্রধান ভাগ ঠিকই, তবে মাঝামাঝি উদাহরণও স্বাদে-রূপে মন মাতাইয়া বাজারময় ছড়াইয়া থাকে। ভাবিতে গেলে বোঝা যায়, বাংলার মিষ্টি বৈচিত্রে কত সমৃদ্ধ। যে সকল সঙ্কর গোত্রীয় মিষ্টি আসিয়া কুলীন মিষ্টির পাশে অনায়াসে জায়গা করিয়া লইয়াছে, তাহাদের মেয়াদ বুঝিতে গড়পড়তা নির্দেশ কাজে আসিবে না। আর নীতিগত আপত্তি? খাদ্যসুরক্ষার বিধিনিষেধগুলি সামাজিক স্বার্থেই মানিয়া চলিবার কথা, সকল শ্রেণি ও গোত্রের ব্যবসায়ীর জন্যই তাহা প্রযোজ্য। ক্রেতাদের নিরাপদ, স্বাস্থ্যকর খাবার পাইবার অধিকার মানিয়া তথ্য সরবরাহ করিবার দায়ও বিক্রেতারই। বাজারই শেষ পর্যন্ত নীতির পরিবর্তন আনে, অধিকারের বোধ পাল্টাইয়া দেয়। তাহার সহিত তাল মিলাইয়া চলিতে ছোট শিল্পের শ্বাস রোধ হইতে বসে, কিন্তু গত্যন্তর নাই। ছোট জনপদে ক্রেতা-বিক্রেতার আস্থার সম্পর্ক গড়িয়া উঠিতে পারে, সর্বত্র তাহা সম্ভব নহে। তবে, ভাবিয়া দেখা যায়, বৃহৎ উৎপাদকদের জন্য যত বিধি প্রযোজ্য, তাহার সকলই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর উপর আরোপ করিবার দরকার আছে কি না। অর্থাৎ সুরক্ষার নির্দেশগুলিকে ‘শাস্তি’ রূপে না দেখিয়া ‘সহায়িকা’ ভাবিলে হয়তো মধুর সমাপ্তি ঘটিতে পারে এই পর্বের।