ছবি: সংগৃহীত
জানুয়ারির প্রথমে যখন পঞ্চম শ্রেণির নুতন ছাত্রীরা এল, তাদের দেখে শিক্ষিকারা আলোচনা করছিলেন যে এ ব্যাচের মেয়েরা খুব ছোট। আমি বললাম, বয়সে ছোট নয় এরা, কারন ভর্তির বয়স এক বছর বেড়ে গেছে। এরা মাথায় খাটো। গত বছর অক্টোবরে প্রকাশিত গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স রিপোর্ট বলছে, ভারতীয় শিশুদের মধ্যে বয়সের অনুপাতে বৃদ্ধি কম দেখা যাচ্ছে ৩৭% শিশুর মধ্যে। ১৭--২০% শিশুর উচ্চতা অনুযায়ী ওজন কম দেখা যাচ্ছ। এই দু’টি সমস্যা বিশ্বের মধ্যে ভারতে সবচেয়ে বেশী। ভারতীয় মেয়েদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে রিপোর্টে বলা হচ্ছে প্রতি দু’জন মেয়ের মধ্যে এক জন অ্যানিমিক। অ্যানিমিক মা কম ওজনের শিশুর জন্ম দেয়,যার বৃদ্ধিও হয় কম।
শিশুদের কম বৃদ্ধির কারণ খু্জতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, গত কয়েক দশকে মাথা পিছু আয় বাড়ায় খেতে পেলেও যে খাবার শিশু কিশোরেরা গ্রহণ করছে তা সুষম খাদ্য নয়। এতে প্রোটিন ও ভিটামন, খনিজ পদার্থের ঘাটতি আছে। ইউনিসেফ বলছে খাদ্যের গুনমান সঠিক না হওয়ার কারণে প্রতি তিন জন শিশুর এক জন দেহ পরিপোষক পদার্থের ঘাটতিতে ভোগে। পাঁচ জনে এক জন ভোগে ভিটামিন-এ ঘাটতিতে । তিনজনে একজন ভোগে ভিটামিন-বি ঘাটতিতে।
ছোটখাটো, রোগা-পাতলা ছাত্রীদের দেখে মনে হল আমাদের ছাত্রীদের প্রতি দিনের ডায়েট সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া উচিৎ। খোঁজ নেওয়ার পর দেখলাম দু’ধরনের ছাত্রী আছে। একদল বেশ গরীব, তাদের মায়েরা সকালে কাজে বেরিয়ে যান, রান্না করার সময় পান না। দুপুরে ফিরে রান্না করেন। মেয়ে সকালে চা বিস্কুট খেয়ে টিউশন যায়, তারপর স্কুলে আসে, দেড়টায় মিড-ডে-মিল খায়। সকাল থেকে খালি পেটে থেকে অম্বল হয়। মিডডে মিল খেতে তাদের ইচ্ছে করে না। সামান্য খেয়ে সেটাও ফেলে দেয়। আর অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়েদের খাবারে অনীহা। নানা অজুহাতে মিডডে মিল খায় না, নানা রকম চিপস দিয়েই টিফিন সারে। উঁচু ক্লাসের মেয়েরা মিডডে মিলের আওতার বাইরে। আর তারা গরীব বা বড়লোক যাই হোক না কেন, তাদের সবার খাদ্যাভাস প্রায় এক। ঘুম থেকে উঠে তারা দু’টো বিস্কুট খেয়ে পড়তে চলে যায়। সেখান থেকে ফিরে স্কুল আসার জন্য অত্যন্ত তাড়া। এক গ্রাস ভাত খেয়ে উঠে পরে। টিফিনে খিদে পায় খুব। সে খিদে মেটাতে পুষ্টিকর, পেট ভরানোর মত কোন খাবার খায় না। খায় জাঙ্ক ফুড। বাড়ি ফিরে আবার সেই জাঙ্ক ফুড। পেট ভরানোর মত ডাল ভাত, সবজি, মরসুমি ফল কিছুই তারা পাতে নেয় না। গরীব মায়েরা মনে করে পুষ্টিকর খাবার কেনার ক্ষমতা তাদের নেই। কিন্তু সস্তায় তারা কিছু পুষ্টিকর খাবার ছেলে মেয়ের পাতে দিতে পারতেন, অথচ বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পরে তা না দিয়ে তারাও সন্তানকে ওই অপুষ্টিকর খাবারেই অভ্যস্ত করান। ফল ম্যালনিট্রিশান এবং ভারতীয়রা ক্রমশ, কায়িক ও বৌদ্ধিক ক্ষমতায় পিছিয়ে পড়ছে। অথচ আমাদের দেশের চিরাচরিত অনেক খাবার আছে যা সস্তা অথচ পুস্টি গুনে ভরা। যে সব খাবার ছোট বেলায় আমি আপনি খেয়েছি তা আমাদের ছেলেমেয়েরা কেন খাবে না? আমাদের দেশীয় খাবার আমাদের পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য পূর্ণ। তাই সেগুলো সহজে হজমও হয়, শরীরও ঠিক রাখে।আমি এখানে খুব সাধারণ কিছু খাবারের পুস্টিগুন আপনাদের সামনে তুলে আনবো। পুষ্টিগুন ও সহজলভ্যতার নিরিখে এরা সেরা, যতই নাম দেখে আপনার মনে তাচ্ছিল্য জাগুক। আজ আলোচনা পান্তা ভাত নিয়ে।
১) পান্তা ভা সারা বিশ্ব জুড়ে পুষ্টিবিদদের মতে দক্ষিণ-এশিয়ার মানুষ সকাল বেলায় খাবারটিতে বহুকাল ধরে অভ্যস্ত সেই আগের দিনের জলে ভেজানো ভাত, বা পান্তা ব্রেকফাস্ট হিসাবে সেরা। আমার বাড়ি বাড়ির কাজের মায়েদের জন্য আদর্শ খাবার। রাতে রান্না করে জল ঢেলে ঢেকে রেখে সকালে কাঁচা লঙ্কা, কাঁচা পেঁয়াজ বা অন্য পছন্দসই জিনিস দিয়ে খেয়ে নেওয়া খুব সহজ। আসাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রিকালচার অ্যান্ড বায়ো টেকনোলজি বিভাগের গবেষণায় জানা গেছে পান্তা ভাতের রয়েছে অসাধারণ পুষ্টি গুন। মধুমিতা বড়ুয়া ও গুনজিৎ গোস্বামী জানিয়েছেন ১০০ গ্রাম গরম ভাতে থাকে৩. ৪ মি.গ্রা. আয়রন, অথচ ওই একই পরিমাণ পান্তা ভাতে (রান্নার পর ভাত ১২ ঘন্টা জলে থাকার পর) আয়রন থাকে ৭৩.৯মি.গ্রাম। একই ভাবে পান্তা ভাতে পটাসিয়াম বেড়ে হয় ৮৩৯ মিলি গ্রাম ক্যালসিয়াম ২১ থেকে বেড়ে হয় ৮৫০ মিলি গ্রাম। ভাত আমাদের প্রধান শক্তির উৎস কিন্তু খনিজ পদার্থের উৎস হিসাবে আদর্শ নয়। কারন ফাইটিক অ্যাসিডের মতো অ্যান্টি নিউট্রশনাল ফ্যাকটর ভাতে থাকার ফলে আয়রন, ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, জিংক ইত্যাদি খনিজ গুলি ভাতে থাকলেও সহজে শরীরে গ্রহণযোগ্য হয়না। চালে থাকে অলিগো স্যাকারাইড বা জটিল শর্করা যা সহজে হজম হয় না।
জল দেওয়া ভাতে ব্যাকটিরিয়ার সন্ধান ক্রিয়ায় জটিল শর্করা ভেঙে সরল শর্করা হওয়ায় সহজে হজম হয় এবং ফাইটিক অ্যাসিড ১২ ঘন্টা জলে ভেজানো ভাতে ১.২৫ মিলিগ্রাম থেকে কমে দাঁড়ায় ০.৩৫ মিলিগ্রাম। তাই খনিজ পদার্থগুলো পরিমানে বাড়ে ও সহজে শোষন উপযোগী হয়। আবার সোডিয়ামের পরিমাণ কমে যায়। ফলে পান্তা রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখে। এতে পাওয়া যায় বি ৬ ও বি ১২ ভিটামিন যা অন্য খাদ্যে এমন সহজে পাওয়া যায় না। পান্তা ভাতে থাকে সন্ধানকারী ব্যাক্টেরিয়া। যা সন্ধান বা ফারমেন্টেশন ঘটিয়ে তৈরি করে ল্যাকটিক বা অন্য অ্যাসিড, ফলে পান্তা ভাত আম্লিক হওয়ায় ক্ষতিকর ব্যাক্টেরিয়া জন্মাতে পারে না।
পান্তা ভাতে তৈরি হয় কয়েক কোটি উপকারী ব্যাক্টেরিয়া যা হজমে সহায়তা করে ও শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে। পান্তা খেলে অন্ত্রের উপকারী ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বৃদ্ধিপায়। ফলে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সুস্থ ও কর্মক্ষম থাকে।
লেখক স্কুলশিক্ষক, মতামত নিজস্ব