দিঘার সমুদ্রে হঠাৎ দেখা দেওয়া ফেনা। নিজস্ব চিত্র
গত জানুয়ারি মাসের ঘটনা। ঘটনাস্থল বেশ কিছুটা দূরে, স্পেনের। বার্সেলোনার কাছে একটা ছোট শহর তোসা দে মার। সেই শহরের রাস্তাঘাট হঠাৎ ভরে গিয়েছিল ফেনায়। সমুদ্রের ফেনায়। রাস্তাঘাট ঢাকা পড়েছিল ডিটারজেন্ট পাউডারের ফেনার মতো সমুদ্রের ফেনায়। একটি ভিডিয়োয় দেখা গিয়েছিল, রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে দু’টো লোক। দূরে একটা দমকলের মতো গাড়ি। সম্ভবত বিপর্যয় মোকাবিলার। সেই গাড়ির দিকে তাকিয়ে ছিলেন লোক দু’টো। আসলে তাঁরা উদ্ধারকারী দলের সদস্য। সেই সময়েই হঠাৎ ফেনা ভেদ করে বেরিয়ে এল একটা গাড়ি। লোক দু’টো বুঝতে পারেননি গাড়ি এগিয়ে আসছে। আর গাড়ি চালকও বুঝতে পারেননি, সামনে দু’জন দাঁড়িয়ে আছেন।
কেন এই ফেনা? তার একটা ব্যাখ্যা খবরগুলোর প্রতিবেদনে ছিল। তবে উল্লেখ ছিল, সম্প্রতি ওই দেশের পূর্ব ভাগে সামুদ্রিক ঝড় গ্লোরিয়া আছড়ে পড়েছিল। সমুদ্রের জলে প্লাবিত হয়েছিল বহু শহরের রাস্তাঘাট। সমুদ্র ছিল বিক্ষুব্ধ। বৃষ্টি, শক্তিশালী ঝড়ো বাতাস আর বিপুল তরঙ্গ মিলে সমুদ্রে প্রচুর ফেনা তৈরি করেছিল। এত ফেনা দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন তোসা দে মার শহরের বাসিন্দারা। সোশ্যাল মিডিয়ায় ফেনার সমুদ্রের ছবি শেয়ার করে তাঁদের অনেকে মন্তব্য করতে শুরু করেন, ‘এসবই জলবায়ু পরিবর্তনের ফল। এবার কিছু করা দরকার’।
দিন পাঁচেক আগের ঘটনা। গত ১৩ মে। এবারের ঘটনা নেদারল্যান্ডসে। শেভেনিয়া উপকূলের ঘটনা। ঘটনাটা দু:খজনক। ওই উপকূলে পাঁচজন সার্ফার সেই সময়ে সার্ফিং করছিলেন। হঠাৎ ধেয়ে আসে বিপুল সমুদ্রের ফেনা। ‘দ্য সান’ ফেনার বর্ণনায় বলেছে, ‘যেন আচমকা তুষার ধস নেমে এল’। সেই তুষারধসের মতো ফেনায় চাপা পড়ে যান পাঁচ সার্ফার। তাঁদের মধ্যে চারজনকে উদ্ধার করা গিয়েছে। একজনের খোঁজ এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত মেলেনি। শেভেনিয়া উপকূলেও প্রবল উত্তরে বাতাস বইছিল। সমুদ্রের স্রোতও ছিল ভয়াবহ।
গত শুক্রবার সন্ধ্যায় দিঘার সমুদ্রেও দেখা গেল একই ছবি। স্পেন আর নেদারল্যান্ডসের মতোই। দিঘার সমুদ্র তীর ভরে গিয়েছিল ফেনায়। পরপর ভেসে আসছিল ফেনা আর ফেনা। মনে হচ্ছিল, মাঝ সমুদ্রে কোনও হিমশৈল গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গিয়েছে। আর সেগুলোই ভেসে আসছে ঢেউয়ের সঙ্গে। মনে হচ্ছিল, সমুদ্রের জলের উপরে তুষারপাত হয়েছে। শুক্রবার সন্ধ্যে থেকে এমন অপরিচিত দৃশ্যের প্রথমবার সাক্ষী থাকল সৈকত শহর দিঘা। করোনাভাইরাসের প্রভাবে এখন সুনসান দিঘার সমুদ্র সৈকত। পর্যটক একেবারেই নেই সেখানে। তবে বিষয়টি দু’একজনের চোখে পড়ে। তাঁদের কথা শুনে কৌতূহলবশত ছুটে আসেন কাছাকাছি এলাকার বাসিন্দারা। অনেকে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। যেমন আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন স্পেনের সেই ছোট্ট শহরের বাসিন্দারা। গত বছরই আচমকা দিঘার সমুদ্রের জলের রং বদলে ঘোলাটে হয়ে গিয়েছিল। তখনও একটা আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল।
মানস জানার বাড়ি পায়া মেদিনীপুর গ্রামে। শুক্রবার সন্ধ্যায় তিনিও সমুদ্রের তীরে হাজির হন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘সমুদ্রের তীর থেকে অনেকটা দূরে জলের ভিতর থেকে ফেনা তৈরি হয়ে উড়ে উড়ে আসছিল। গোল আকৃতির সেই ফেনা দেখে প্রথমে আমরা বরফই ভেবেছিলাম। তার পর দেখি, বাতাসের সঙ্গে মিশে গিয়ে অপরূপ ভাবে চারিদিকে উড়ে যাচ্ছে।’’ মানস অবশ্য আতঙ্কিত হননি। তাঁর দৃশ্যটি ভাল লেগেছে। মানসের কথায়, ‘‘এমন মনোরম দৃশ্য জীবনে প্রথমবার দেখলাম।’’ দিঘার অনেকেই আতঙ্কিত না হলেও সমুদ্রের এই অস্বাভাবিক সফেদ ফেনা দেখে কৌতূহলি হয়ে উঠেছে। আবার আতঙ্কিত অনেকেরই ধারণা, শেষের সেই দিন কি সত্যিই আসতে চলেছে! গোটা সৈকত শহর দিঘা জুড়ে আতঙ্ক আর কৌতূহলের মিশ্র প্রতিক্রিয়া। অনেকেই জানার চেষ্টা করছেন, লকডাউনের সঙ্গে এর কোনও প্রভাব রয়েছে কিনা। আবার এই সময়েই আলিপুর আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাস দিয়েছে, সমুদ্রে শক্তিশালী হচ্ছে ঘূর্ণিঝড় আমপান। ঘন্টায় প্রায় ৯০-১৯০ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে আসছে পশ্চিমবঙ্গের দিকে। লন্ডভন্ড হতে পারে উপকূলীয় এলাকা। আমপান ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে সমুদ্রের সাদা ফেনার কোনও সম্পর্ক রয়েছে কিনা তা নিয়েও তৈরি হয়েছে নানা কৌতূহল।
যদিও স্থানীয়দের আশঙ্কায় একেবারেই গুরুত্ব দিতে রাজি নন সমুদ্র নিয়ে অভিজ্ঞরা। তাঁরা পরিষ্কার জানিয়েছেন, সমুদ্রে ফেনা নিয়ে ভয়ের কিছু নেই।। এ প্রসঙ্গে কথা বলা হয়েছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞানী আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তিনি ফেনার কারণ ব্যাখ্যা করলেন। তাঁর কথায়, “লকডাউনের ফলে সমুদ্র এখন অনেকটা দূষণমুক্ত। আগে দূষণের জন্য সমুদ্রের তলদেশের উপাদানগুলি সমুদ্রের জলের তলার দিকেই থাকত। কিন্তু এখন দূষণ না থাকায় সেই সব উপাদান জলের উপরের স্তরের দিকে চলে আসছে। আর আমপান-এর প্রভাবে সমুদ্রের উপরে বাতাসের গতিবেগ এখন অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। তার ফলে বাতাসের গতিবেগের ধাক্কায় সমুদ্রের জলে উৎপন্ন হচ্ছে ফেনা। যা আছড়ে পড়ছে উপকূলে। এতে ভয় পাওয়া বা আতঙ্কিত হওয়ার কোন কারন নেই।’’ দিঘার সমুদ্রে এই ঘটনা বিরল হলেও তা নিয়ে অযথা আতঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ নেই বলেই মত সমুদ্র বিজ্ঞানীদের। আশ্বস্ত করছেন আর এক সমুদ্র বিজ্ঞানী, দিঘা মেরিন অ্যাকোয়ারিয়ামের শ্রীনিবাসন বালাকৃষ্ণন। তিনি বলেছেন, ‘‘এই সময়ে সমুদ্রের উপরিভাগে বইতে থাকা প্রবল বাতাস এবং সমুদ্রের জল দিয়ে বয়ে আসা বিভিন্ন জীবাণুর বেশি উপস্থিতি এর জন্যে দায়ী।’’ বিজ্ঞানী বালাকৃষ্ণন মনে করছেন, ‘‘সৈকতে থাকা এক প্রকারের ব্যাক্টেরিয়ার কারণেও এমন ফেনা তৈরি হতে পারে। নোনা জলের সঙ্গে মেশার কারণে প্রচুর পরিমাণে ফেনা তৈরি করতে পারে তারা।’’ তাঁর ব্যাখ্যায়, সমুদ্রের জলের সঙ্গে লবণ, প্রোটিন, ফ্যাট মিশে থাকে। অন্য দূষণ সৃষ্টিকারী পদার্থও থাকে। সৈকত শহরে নোংরা আবর্জনার কারণে সমুদ্রের জল ধূসর হয়ে যায়। তবে মৌসুমি বায়ুর আগমনে সমুদ্রে এই ধরনের ঘটনা একেবারে স্বাভাবিক। ফাইটোপ্ল্যাকটনের জন্যও আকস্মিক ভাবে ফেনা হতে পারে। অধিকাংশ সমুদ্রের ফেনা ক্ষতিকারক নয়। তা জলজ পরিবেশের পক্ষে অনুকূল। সম্প্রতি চেন্নাইয়েও এমনটা ঘটেছিল বলে জানান বালাকৃষ্ণন।
দিঘার সমুদ্রে পেঁজা তুলোর মতো সাদা রাশি রাশি ফেনা প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞদের দাবি, এটা সমুদ্রের স্বাভাবিক ছন্দ। এর সঙ্গে প্রকৃতির কোনও ক্ষতি কিংবা পরিবেশের উপর কোনও প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই।
নেদারল্যান্ডসে সার্ফারদের মৃত্যুর ঘটনায় ফেনার কোনও ভূমিকা রয়েছে কিনা তদন্ত করে দেখছেন সমুদ্র বিজ্ঞানীরা। তাঁদের মত, ফেনার ‘পাহাড়ে’ চাপা পড়ে তাঁরা দিক নির্ণয়ে ভুল করে ফেলেছিলেন। আর ফেনা সৃষ্টি নিয়ে নেদারল্যান্ডসের ‘সি রিসার্চ ইনস্টিটিউট’এর বিজ্ঞানীদের বক্তব্য, সমুদ্রের জলে প্রচুর শ্যাওলা মিশে গেলে আর বাতাসের গতিবেগ বেশি থাকলে ফেনা তৈরি হতে পারে। এসবই সমুদ্র-জীবনের স্বাভাবিক ঘটনা। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।