পাঁচ বছর পেরিয়ে এল কালজানি নদীর তীরের জেলা অালিপুরদুয়ার

অনেক লড়াইয়ের পর পৃথক জেলার পরিচয় পেয়েছিল আলিপুরদুয়ার। তার সুফল মিলেছে বহু ক্ষেত্রেই। তবে এখনও অনেকটা পথ চলা বাকি। লিখছেন অনির্বাণ রায়অনেক লড়াইয়ের পর পৃথক জেলার পরিচয় পেয়েছিল আলিপুরদুয়ার। তার সুফল মিলেছে বহু ক্ষেত্রেই। তবে এখনও অনেকটা পথ চলা বাকি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০১৯ ০২:৪১
Share:

মনুষ্য শিশু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে ক্রমশ সাবলীল হয়ে ওঠে। আলিপুরদুয়ার শহরের উত্তর দিকে প্যারেড গ্রাউন্ডের পাশে সাত তলা উঁচু নীল বাড়িটাকে সেই শিশুর প্রতীকের ভাবা যেতেই পারে। আজ, মঙ্গলবার আলিপুরদুয়ার জেলা পঞ্চম বর্ষে পা দিচ্ছে। সাত তলা বাড়িটার নাম ডুয়ার্স কন্যা। আলিপুদুয়ার পূর্ণাঙ্গ জেলার প্রশাসনিক ভবন। যা কি না আলিপুরদুয়ার জেলার সিগনেচার ছবিও বটে, পেশাদারি জগতের লোকেরা যাকে ব্র্যান্ড ইমেজও বলতে পারেন।

Advertisement

আলিপুরদুয়ার জেলার আবেগের হদিশ পেতে হলে ফেলে আসা পাঁচ বছর পেরিয়ে আরও খানিকটা পিছনে তাকাতে হবে। অবিভক্ত জলপাইগুড়ি জেলা। তারই অংশ আলিপুরদুয়ার। জলপাইগুড়ি শহর অবিভক্ত জেলার সদর। কুমারগ্রামের কোনও বাসিন্দাকে প্রশাসনিক কাজে জেলা সদরে যেতে হলে পাড়ি দিতে হত প্রায় দেড়শো কিলোমিটার পথ। বাস বদলাতে হত কয়েক বার। তখন জলপাইগুড়ি থেকে আলিপুরদুয়ার যাতায়াতের রাস্তাও ছিল ঘুরপথে। জমিজমা হোক বা কয়েক মিনিটের সরকারি কাজে জেলা সদরে আসতে হলে পুরো দিন কাবার হয়ে যেত। কাজে দেরি হলে জেলা সদরেই থেকে যেতে হত। মূলত দূরত্বই একটি নতুন জেলার দাবি জাগিয়ে তুলেছিল আলিপুরদুয়ারে। প্রথম অবস্থায় তা ছিল যতটা না নিজস্ব পরিচিতির, তার চেয়েও বেশি ছিল দূরত্ব দুর্ভোগ থেকে মুক্তির দাবি।

সেই দাবিপূরণ নিয়ে বিস্তর রাজনৈতিক টানাপড়েন ছিল। বাংলার লাল-যুগে অবিভক্ত জেলা বামফ্রন্টের ছোট শরিক আরএসপি বরাবরই জেলার দাবিকে সমর্থন করে গিয়েছিল। কিন্তু বড় শরিক সিপিএমের জেলা কমিটির তা নিয়ে যথেষ্ট আপত্তি ছিল। ২০১১ সালে বঙ্গে পরিবর্তন আসে। ফের আলিপুরদুয়ারে জেলার দাবি জোরাল হয়। পরিবর্তনের পরে প্রথম লোকসভা ভোটে আলিপুরদুয়ার লোকসভায় প্রথম বার ঘাসফুল ফোটে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা দাবি করেন, সে বার লোকসভা ভোটে রাজ্যের শাসকদলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির প্রথমটাই ছিল আলিপুরদুয়ারকে স্বতন্ত্র জেলা ঘোষণা। লোকসভা ভোটের পরে সে ঘোষণা করতে দেরি করেনি রাজ্যের শাসকদল। লোকসভা ভোটের মাসখানেকের মধ্যে ২৫ জুন আলিপুরদুয়ারকে নতুন জেলা ঘোষণা করা হয়। জেলা সদরের অনুষ্ঠানে এসেছিলেন রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

Advertisement

কালজানি নদীর পাড়ে তারপর অসংখ্যবার সূর্য উঠেছে, জলদাপাড়া অভয়ারণ্যে অগুন্তি সন্ধে নেমেছে। পাঁচ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। মাথায় জাতীয় পতাকা উড়িয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সাততলা ডুয়ার্স-কন্যা, যার শরীরে দীর্ঘ দিনের বহু আন্দোলনের ইতিহাস গাঁথা রয়েছে। আলিপুরদুয়ার মহকুমা হাসপাতাল জেলা হাসপাতালে উন্নীত হয়েছে। ফালাকাটায় সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল হয়েছে। একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদিত হয়েছে নতুন জেলার জন্য। সব সরকারি দফতরের জেলা সদর অফিস হওয়া যেমন প্রশাসনিক পরিকাঠামোর একটি বড় দিক, তেমনই হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয় নতুন জেলার স্বাস্থ্য-শিক্ষার শিকড়কে যে আরও গভীরে নিয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। পুরনো জেলা ভাঙার আগে মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকে আলিপুরদুয়ারের প্রত্যন্ত গ্রাম বা জনপদগুলির ফলাফল যা হত, এখন নিসন্দেহে তার চেয়ে অনেক বেশি ভাল হয়। এ বছরই মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিকে আলিপুরদুয়ারের ছেলেমেয়েরা রাজ্যের মেধা তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন। শিক্ষাবিদেরা মনে করছেন, জেলা হওয়ার ফলে শিক্ষার মানে সুসংহত ভাবে নজর দেওয়া গিয়েছে এবং তাতেই এই সাফল্য।

শিক্ষার মানবৃদ্ধি কোনও এলাকার সামাজিক মূল্যবোধ, অবস্থানকে যেমন সিঁড়ি ভেঙে ক্রমশ উপরের দিকে নিয়ে যায়, তেমনই তার অর্থনীতিকেও মজবুত করে। চা-বাগান প্রধান আলিপুরদুয়ারে প্রতিটি বাগানে প্রশাসনিক নজরদারিও এই ক’বছরে যে বেড়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এবং অবশ্যই তা স্বতন্ত্র জেলা হওয়ার সুবাদেই।

তবে পথ চলার এখনও অনেকটাই বাকিও রয়েছে। আলাদা জেলা হলেও এখনও এখানে বিচার বিভাগের পরিকাঠামো গড়ে ওঠেনি। এখনও বিচার পেতে কয়েকশো কিলোমিটার পেরিয়ে জলপাইগুড়ি জেলা আদালতেই যেতে হয় বাসিন্দাদের। জেলা হওয়ার পরে একটি স্টেডিয়ামের দাবিও তুলেছিলেন বাসিন্দারা। তা এখনও অধরা। স্টেডিয়াম না থাকলে জেলার খেলাধূলার সামগ্রিক মানোন্নয়ন সম্ভব নয় বলেই ক্রীড়াবিদেরা মনে করেন। নতুন জেলা গঠিত হলেও মহকুমার বিন্যাস এখনও করা হয়নি। সেটা হয়ে গেলে প্রশাসনিক কাজকর্মে যে সুফল মেলার আশা ছিল, তা এখনও মেলেনি।

তবে পাহাড়-জঙ্গল-বাগান প্রধান এই জেলার বয়স সবেমাত্র পাঁচ। বিজ্ঞানের এবং জগৎসংসারের নিয়ম মানলে বলা যেতে পারে, বেড়ে ওঠার, বিকশিত হয়ে ওঠার এবং আত্মনির্ভরতা তৈরি করার এটাই তো বয়স!

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement