আমাজনে আগুন।
আমাদের যুগের ‘পলিটিক্স’ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের খুব উঁচু ধারণা ছিল না। তাঁর মনে হয়েছিল, ‘‘প্রথমে যাহা সানুনয় প্রসাদভিক্ষা ছিল দ্বিতীয় অবস্থাতে তাহার ঝুলি খসে নাই, কিন্তু তাহার বুলি অন্যরকম হইয়া গেছে, ভিক্ষুকতা যতদূর পর্যন্ত উদ্ধত স্পর্ধার আকার ধারণ করিতে পারে তাহা করিয়াছে...” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, প্রায় ১১৫ বছর আগে। সাম্প্রতিক দু’টি ঘটনায় কথাগুলি মনে পড়ে গেল। একটি সুদূর ব্রাজিলে, গত সপ্তাহ তিনেক ধরে সারা পৃথিবীর হেডলাইনে জায়গা পেয়েছে। অন্যটি ঘরের পাশে ডায়মন্ড হারবারের ঘটনা, পৃথিবী দূরস্থান, স্থানীয় মিডিয়াতেও যা বিশেষ জায়গা পায়নি। দুটো ঘটনার পিছনেই কাজ করছে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় রাজনীতির ‘উদ্ধত স্পর্ধা’। বিজ্ঞান ও পরিবেশের সাবধানবাণীকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব না দিয়ে, পৃথিবী ও আগামী প্রজন্মের কথা না ভেবে যা খুশি করার অধিকার সেই রাজনীতি দেখিয়েছে।
ব্রাজিলের অন্তর্গত আমাজন রেনফরেস্ট-এর একটা বড় অংশ অগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে পুড়ছে, বা বলা ভাল, পোড়ানো হচ্ছে। প্রতি মিনিটে প্রায় দেড়খানা ফুটবল মাঠের সমান জঙ্গল পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। এখনও সে আগুন থামেনি। এমন নয় যে অন্য বছর আমাজন অরণ্যে আগুন লাগে না। লাগে, কিন্তু এ বার সেই আগুন লাগার পরিমাণ অন্যান্য বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
সন্দেহ এখানেই! গত জানুয়ারিতে বোলসোনারো ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট হয়েই ঘোষণা করেছিলেন যে, পৃথিবীর বৃহত্তম রেনফরেস্ট কেটে চাষবাসের জমি ও খনি বানিয়ে নতুন ব্রাজিল তৈরি করা হবে। শোনা যায় এ নিয়ে নাকি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সাহেবের সঙ্গে আলোচনাও হয়েছিল। এঁরা দু’জনই প্রবল পরিবেশবিরোধী। মানুষের কারণে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে বলে মনে করেন না। ফলে পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম জঙ্গল নষ্ট হচ্ছে কি না, কয়েক হাজার মাইল দূরের শহর সাও পাওলো কালো ধোঁয়ার আস্তরণে ঢেকে গেলে অক্সিজেনে টান পড়বে কি না, এই উষ্ণায়নের যুগে এমন ঘটনা জলবায়ুর সমস্যা কতটা বাড়াবে; এ সব নিয়ে তাঁদের হেলদোল নেই। বরং ভাবটা— যা করেছি, বেশ করেছি।
এই ঔদ্ধত্যেরই আর এক প্রকাশ ডায়মন্ড হারবারের জাতীয় সড়কের গা-ঘেঁষে নেওয়া তথাকথিত সৌন্দর্যায়নের পরিকল্পনায়, যা করতে গিয়ে ব্রিটিশ আমলের বাঁধের দফারফা করেছেন আধিকারিকরা। ১১৯ নম্বর জাতীয় সড়ক, যা কিনা একই সঙ্গে হুগলি নদীর বাঁধও বটে, তার গায়ে লাগানো বহু পুরনো বোল্ডারগুলি সরিয়ে নদীর মধ্যে প্রায় ১০ মিটার দখল করে কোটি কোটি টাকা খরচ করে পরিকল্পনা হয়েছিল সৌন্দর্যায়নের; যার কেন্দ্রে থাকার কথা ছিল একটি ‘হ্যাঙ্গিং গার্ডেন’। গত ১ অগস্ট ওই হ্যাঙ্গিং গার্ডেন তৈরির সময় জাতীয় সড়কের একাংশ ভেঙে পড়ল, অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ হয়ে গেল কলকাতা থেকে রাজ্যের একেবারে দক্ষিণাংশে যাওয়ার মূল রাস্তা, প্রবল সঙ্কটে পড়লেন হাজার হাজার মানুষ। বিরাট বিপদের ভয় মাথায় নিয়ে রোজ রাতে ঘুমোতে যাচ্ছেন ডায়মন্ড হারবার ও সংলগ্ন অঞ্চলের মানুষ; যদি বাঁধটা পুরো ভেঙে গঙ্গা ভাসিয়ে দেয় গোটা অঞ্চলকে! সরকার গোটা জেলার প্রশাসনকে মান ও জান বাঁচাতে ময়দানে নামিয়ে দিলেও সে সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশেষজ্ঞরা, বরং মনে করিয়ে দিচ্ছেন এই পরিকল্পনার এটাই ভবিতব্য ছিল। প্রথমত, বোল্ডারগুলি খুলে নেওয়ার কারণে প্রতি জোয়ারের সময় নদীর জল বাঁধের তলায় ঢুকছে ও ভাটায় বেরোচ্ছে। তার ফলে গোটা বাঁধ জুড়ে অসাম্য তৈরি হয়েছে ও হচ্ছে। নদী বিশেষজ্ঞদের মতে, জোয়ারের জল তার দক্ষিণ দিকের পাড়ে বেশি বিপদ তৈরি করে, ডায়মন্ড হারবারে নদী একটি বড় বাঁক নেওয়ার ফলে যা তীব্রতর হওয়ার সম্ভাবনা। সবচেয়ে বড় কথা, ২৮ জুন কেন্দ্রীয় সরকার লোকসভায় জানিয়েছে, দেশের মধ্যে ডায়মন্ড হারবারের কাছাকাছিই সমুদ্রের জলস্তর সবচেয়ে বেশি বাড়ছে! প্রস্তাবিত পরিকল্পনাটি একই সঙ্গে পোর্ট ট্রাস্টের আইন, কোস্টাল জ়োন আইন ও পরিবেশ দফতরের আইনও ভেঙেছে।
প্রশ্ন হল, এমন প্রাণঘাতী প্রকল্প কেন নেওয়া হল? উত্তর, স্থানীয় সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকল্পটি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নিজেও জানতে চাননি আর আধিকারিকরা তাঁকে জানিয়ে উঠতে পারেননি যে ওখানে আদৌ ওই ধরনের প্রকল্প করা যায় কি না! কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম অবশ্য সব দেশেই হয়, কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে ভুল কাজ করলে কর্মফলও ভোগ করতে হয়! নয়াচরে প্রস্তাবিত কেমিক্যাল হাব করা যে সম্ভব নয়, সেই আলোচনা বাম সরকারের ঔদ্ধত্যের কাছে মাথা নুইয়ে ছিল; ৩৪ বছরের বাম শাসনের শেষের শুরু হয়েছিল। মোদী সরকারও বার বার পরিবেশকে হেলায় উড়িয়ে উন্নয়নের ধ্বজা ওড়াচ্ছেন; ফল হাতের কাছেই। আজ উত্তরাখণ্ডে বিপর্যয় ঘটছে, কাল কেরলে। পরিবেশ বারে বারে টের পাইয়ে দিচ্ছে যে রাজনৈতিক ঔদ্ধত্যকে তুড়ি মেরে শেষ হাসিটা সে-ই হাসবে। কখনও আগে, কখনও বা পরে।