হেডমাস্টার এবং লেখক রামশম্ভু

শিবচন্দ্র বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রামশম্ভু গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে অবধূতের সাহচর্য ছিল হাতের কাছে স্বর্গ পাওয়ার মতো। স্কুল থেকে হেঁটে মুণ্ডমালিনীতলা, অবধূতকে সঙ্গে নিয়ে শেষ বিকেলে কীর্ণাহার ফিরে আসা। দু’জনের আলোচনায় উঠে আসে বেদ-বেদান্ত, উপনিষদের নানা প্রসঙ্গ। রামশম্ভুবাবুর বাড়িতে আড্ডা চলত কখনও রাত্রি দশটা পর্যন্তও। লিখছেন নাসিম-এ-আলম।অবধূত চিঠি লিখতেন অকাতরে, ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে ঘুরেছেন কিন্তু ভোলেননি তাঁর শ্রদ্ধেয় মাস্টারমশাইকে— তার প্রমাণ রয়েছে অবধূতের চিঠিপত্রে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০১৯ ০২:৪২
Share:

স্মৃতি: রামশম্ভু গঙ্গোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র

শ্মশানে দ্বিতীয় স্ত্রীর মুখাগ্নি করতে গিয়ে দুলালচন্দ্র মুখোপাধ্যায় উপলব্ধি করলেন সংসার ধূধূ শূন্যতায় ভরা এক মরুভূমি। এক টুকরো আগুন চিরতরে সংসারের আপাত বাঁধন ছিন্ন করে দিল। সুখময়ীর শেষকৃত্য সম্পন্ন করার পর তিনি বেরিয়ে পড়লেন বাইরের পৃথিবীর পথে, ঢাকা, বর্মা হলুদ, কাশী হয়ে উদ্ধারণপুর। পরবর্তী সময়ে এই উদ্ধারণপুরকে উপজীব্য করে রচিত হল জনপ্রিয় উপন্যাস উদ্ধারণপুরের ঘাট। উজ্জয়িনীতে সন্ন্যাস নেওয়ার পরে সেই দুলালচন্দ্রই হয়ে উঠলেন কালিকানন্দ অবধূত। উদ্ধারণপুর থেকে ব্রহ্মদেশ, সেখান থেকে বড়িশাল, প্রথম স্ত্রী সরোজিনীর কাছে। আবার সংসারের বাঁধন। ওখান থেকে সরোজিনীকে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন স্থান ঘুরে বীরভূমের লাভপুর, সতীপীঠের অন্যতম তীর্থ ফুল্লরাতলায়। ফুল্লরাতলা থেকে মাঝে মধ্যে চলে আসেন কীর্ণাহার লাগোয়া মুণ্ডুমালিনীতলা আশ্রমে।

Advertisement

এমনই এক সময়ে অবধূতের আলাপ হল কীর্ণাহার শিবচন্দ্র বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক রামশম্ভু গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে। রামশম্ভু (১৯০২-১৯৮৩) তখন ইংরেজি সাহিত্যের কৃতী ছাত্র। শিক্ষকতার কাছাকাছি পাশাপাশি চলছে সাহিত্য রচনা। চণ্ডীদাসের পদাবলি নিয়ে দু-একটি প্রবন্ধ লিখেছেন আঞ্চলিক লিটল ম্যাগাজিনে। চণ্ডীদাস নানুর কীর্ণাহার থেকে মাত্র আট কিলোমিটার দূরে। ক্ষেত্র সমীক্ষা করা সহজ হয়ে উঠল রামশম্ভুবাবুর কাছে। পড়াশোনার ভিতর দিয়ে ভারতীয় দর্শন, ধর্মীয় সহিষ্ণুতার প্রতি আগ্রহ অনুভব করলেন ক্রমেই। অবধূতের সাহচর্য অতএব তাঁর কাছে ছিল হাতের কাছে স্বর্গ পাওয়ার মতো। স্কুল থেকে হেঁটে মুণ্ডমালিনীতলা, অবধূতকে সঙ্গে নিয়ে শেষ বিকেলে কীর্ণাহার ফিরে আসা। পথের দু’পাশে কৃষিজমি, বর্ষা-শরতে সবুজ আর শীতের ধূসর। দু’জনের আলোচনায় উঠে আসে বেদ-বেদান্ত, উপনিষদের নানা প্রসঙ্গ। রামশম্ভুবাবুর বাড়িতে আড্ডা চলত কখনও রাত্রি দশটা পর্যন্তও।

সে সব দিনের কথা দিব্যি স্মরণ করতে পারেন রামশম্ভুবাবুর পুত্র রামপ্রসন্ন গঙ্গোপাধ্যায়। অবধূত চিঠি লিখতেন অকাতরে, ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে ঘুরেছেন কিন্তু ভোলেননি তাঁর শ্রদ্ধেয় মাস্টারমশাইকে— তার প্রমাণ রয়েছে অবধূতের চিঠিপত্রে। এখনও রামপ্রসন্নবাবুর সংগ্রহে রয়েছে রামশম্ভুবাবুকে লেখা অবধূতের চল্লিশটির মতো চিঠি। শুধু অবধূত নন, চিঠি লিখতেন অবধূতের ভৈরবী তথা প্রথম স্ত্রী সরোজিনী। যাঁকে সঙ্গে নিয়ে মরুতীর্থ হিংলাজ গিয়েছিলেন লেখক। পরে রচনা করেন অবিস্মরণীয় উপন্যাস মরুতীর্থ হিংলাজ।

Advertisement

ক্রমে কীর্ণাহার অবধূতের প্রিয় জায়গা হয়ে উঠল। রামশম্ভুবাবু যখন প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নিলেন (১৯২৮), তখন শিবচন্দ্র স্কুলের কোনও পাকা ভবন ছিল না। রামশম্ভুবাবুর মনের ইচ্ছা ছিল, স্কুলের পাকা ভবন হবে। অবধূত পরামার্শ দিলেন মাঠে মাঠে ধান সংগ্রহের জন্য। তবে শুধু পরামর্শ নয়, রামশম্ভুবাবু-সহ কয়েক জন শিক্ষককে নিয়ে শীতের মাঠে মাঠে ঘুরলেন। চাষিরা মাস্টার মশাই ও সাধুবাবার আদলে অবধূতকে দেখে অকাতরে ধান দিলেন। ১৯৪২-এ এলাকার মানুষের সাহায্যে ভিত্তি স্থাপিত হল স্কুলের। পরবর্তী কালে বিভিন্ন সাহিত্যসভায় এ তথ্য জানিয়েছিলেন স্বয়ং রামশম্ভুবাবু। কিছুদিন যোগাযোগ না থাকলে অবধূত নিজে থেকে চিঠি লিখতেন।

অবধূতের ঘনিষ্ঠতা রামশম্ভু বাবুর অন্তরে সাহিত্য সাধনার ভাবনাকে সুদৃঢ় করল। ততদিনে চণ্ডীদাসের পদাবলি সংগ্রহ করে প্রকাশ করেছেন নীলরতন মুখোপাধ্যায়। তিনি এই এলাকার ভূমিপুত্র, চণ্ডীদাসের বাড়ি বাঁকুড়ার ছাতিনা না বীরভূমের নানুর, নাকি দু’জন চণ্ডীদাসের অস্তিত্ব ছিল, সে সময়ে সেই বিতর্ক নিরসনে আগ্রহী হলেন। চণ্ডীদাসের সঙ্গিনী রামীর আসল পরিচয় জানতে নানুর-কীর্ণাহারের পাশের গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরলেন। দীনেশচন্দ্র সেনের ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’, ‘বঙ্গসাহিত্য পরিচয়’ এবং বৈষ্ণব মহাজন পদাবলি ঘিরে অনুশীলন চলল। ততদিনে রামশম্ভুবাবু অবসর নিয়েছেন স্কুল থেকে। উপন্যাস রচনায় হাত দিলেন। আর চণ্ডীদাস নিয়ে বিভিন্ন সাহিত্য সভায় সংগৃহীত তথ্য নিয়ে বক্তৃতা দিয়ে পাঠক সমাজকে অবহিত করতে শুরু করলেন। এই ভ্রমণের ফসল গবেষণা গ্রন্থ ‘চণ্ডীদাস প্রসঙ্গে’ প্রথম প্রকাশ ৩০ জুন ১৯৭৭। তাঁর লেখনীর প্রশংসা করলেন সাহিত্যরত্ন হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, শনিবারের চিঠির সম্পাদক সজনীকান্ত দাস, কথা সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।

প্রবন্ধের পাশাপাশি মৌলিক রচনায় হাত দিয়েছিলেন। লিখলেন একটির পর একটি উপন্যাস। রূপান্তর, আশ্রমিকা, পলাতক, অনামিকা প্রভৃতি। বীরভূম-সহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার লিটল ম্যাগাজিনে তাঁর রচনা তখন প্রকাশিত হচ্ছে। আবার কখনও সারা বৈশাখ মাস হরিনাম দলে মূল গায়েন হিসাবে গ্রাম পরিক্রমা করেছেন। নিজেকে কখনও প্রচারের আলোয় আনতে চাননি। তাঁর বিশ্বাস ছিল প্রকৃত গবেষণায়, কাজে। পাঠক সমাজ তাঁর দেওয়া তথ্য থেকে নতুন করে জানতে পারলেন চণ্ডীদাস ও রামীর ঠিকানা, বংশ পরিচয়। যে গবেষণা একদম মাটির গভীর থেকে তুলে আনা। এ কাজে সাহায্য নিয়েছিলেন নির্ভরযোগ্য গ্রন্থের। রামশম্ভুর বর্ননায়, “কবির পিতার নাম ভবানীচরণ ও মাতার নাম ভৈরবসুন্দরী। তাহাদের উপাধি ছিল রায়(দেবল ব্রাহ্মণ অথবা রাঢী ক্ষত্রিয়)। চণ্ডীদাসের পিতা বাশুলী দেবীর পূজক ছিলেন। নানুরের তিন ক্রোশ পূর্বে তেহাই গ্রামের সনাতন ও লক্ষ্মী নামক রজক দম্পতির কন্যা রজকিনী রামমণি বা রামী চণ্ডীদাসের ভজনের সঙ্গিনী ছিলেন।’’ এ তথ্যের সমর্থনে প্রাক্তন এই প্রধান শিক্ষক উল্লেখ করেছেন বৈষ্ণব দিগদর্শনী গ্রন্থের। গ্রন্থের সাত পাতায় এই তথ্যের উল্লেখ রয়েছে।

১৯২৮ থেকে ১৯৬৫— দীর্ঘ ৩৭ বছর প্রধান শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব সামলেছেন রামশম্ভু গঙ্গোপাধ্যায়। ছাত্রদের মনের গভীরে বুনে দিতেন নানা বিষয়ের খুঁটিনাটি। বিতর্ক, প্রতিযোগিতা, আবৃতি, গান, খেলাধূলা সব বিষয়ে উৎসাহ দিতেন। তাঁর ছাত্র, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতি চারণায় এ সব তথ্যের প্রমাণ মেলে। কীর্ণাহার শিবচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় শতবার্ষিকী স্মরণিকায় (প্রকাশ: ১৯৯৫) প্রণববাবু লিখেছেন, ‘বিশেষ করে আজ মনে পড়েছে হেডমাস্টারমশাই রামশম্ভু গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা। আমার মেজদা পীযূষ কুমার মুখোপাধ্যায় তিনি খুব ভাল বিতার্কিক ছিলেন, আর আমি ছিলাম মুখচোরা, লাজুক স্বভাবের। হেডমাস্টার মশাই প্রায়ই দুঃখ করতেন, তোর বাবা এতবড় রাজনীতিবিদ, তোর দাদা এমন ভাল বক্তৃতা করে আর তুই বলতে পারিস না, এ হয় নাকি? এই ভাবে আমাকে অনুপ্রাণিত করতেন। তিনি প্রায় হাত ধরে আমাকে বিতর্ক শিখিয়েছিলেন।... আজ সংসদের বিতর্কে অথবা দেশ-বিদেশের আলোচনা সভায় কিংবা রাষ্ট্রসংঘে দেশের বক্তব্য তুলে ধরবার ক্ষেত্রে যদি কোন সাফল্য অর্জন করতে পেরে থাকি তার বুনিয়াদ কিন্তু তৈরি হয়েছে এই বিদ্যালয়ের মাটিতেই। তাঁদের স্বযত্ন প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিলাম, যাঁদের অন্যতম ছিলেন আমার শ্রদ্ধেয় হেডমাস্টার মশাই রামশম্ভু গঙ্গোপাধ্যায়।’

চণ্ডীদাসের নানুরে ধূলোমাখা ধূসর স্মৃতির ভিতরে আজও রামশম্ভু গঙ্গোপাধ্যায় রয়েছেন। তাঁর চিঠিপত্র, মানপত্র, পত্রপত্রিকা বুকে করে আগলে আছেন পুত্র, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক রামপ্রসন্ন। চোখে স্বপ্ন নিয়ে— বাবার অপ্রকাশিত রচনা আর বাবাকে লেখা অবধূতের চিঠিগুলি যদি প্রকাশ করা যায়, তা হলে অন্তত লেখক রামশম্ভু গঙ্গোপাধ্যায়কে বাঁচিয়ে রাখা যাবে।

লেখক সাহিত্যকর্মী, সেচ দফতরের (ময়ূরাক্ষী ডিভিশন) কর্মী (মতামত ব্যক্তিগত)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement