পূর্ব ও পশ্চিমকে মেলানোর প্রয়াস ছিল উনিশ শতকের নারীবাদে
Feminism in Bengal

দেশজ নারীবাদের আখ্যান

বাংলায় নারীমুক্তির সেই সূচনা। তবে নারী স্বাধীনতা বলতে এঁরা ঠিক কী বুঝতেন, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এটা বলা যায় যে, তাঁদের এই চেতনা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিশীলিত হয়েছিল।

Advertisement

সায়ন্তন দাস

শেষ আপডেট: ১৬ অগস্ট ২০১৯ ০০:০৫
Share:

ত্রয়ী: রাসসুন্দরী দেবী, জ্ঞানদানন্দিনী দেবী ও রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন

ঊনবিংশ শতকের ভারত। ক্রমশ শক্তপোক্ত হচ্ছে ইউনিয়ন জ্যাক, ভারতের বুকে মাথা তুলছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। অন্য দিকে, কলকাতার নগরায়নের পথ চলা শুরু। ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে রাস্তাঘাট, বসছে গ্যাসের আলো। কিন্তু বাংলা তথা ভারতের রাজনৈতিক পরাধীনতার সঙ্গে বিরাজ করছে সামাজিক অচলাবস্থা, ধর্ম আর লোকাচারের নামে মানবতার নির্বিচার হত্যা। তারই মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা চুঁইয়ে চুঁইয়ে এসে পড়ছে গুটিকতক ব্যতিক্রমী মানুষের কাছে। বদলাচ্ছে তাঁদের চিন্তা-চেতনা-মনন। কিন্তু এ সব কিছুই হচ্ছে পুরুষদের আবর্তে। সমাজের বাকি অর্ধেক আকাশ তখনও রাত্রির মতো নিকষ অন্ধকার। এই আঁধারে প্রথম আলো ফুটিয়েছিলেন বাংলার কিছু সাধারণ নারী। এঁদের মধ্যে কেউ ছিলেন একান্তই গ্রামীণ বধূ, কেউ বা শহরের বৌ, কেউ গোঁড়া মুসলিম পরিবারের মেয়ে। শেষ পর্যন্ত এঁরাই হয়ে উঠেছিলেন অসামান্যা। শুরু হয়েছিল খাঁচা খোলার প্রয়াস।

Advertisement


বাংলায় নারীমুক্তির সেই সূচনা। তবে নারী স্বাধীনতা বলতে এঁরা ঠিক কী বুঝতেন, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এটা বলা যায় যে, তাঁদের এই চেতনা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিশীলিত হয়েছিল। আর এতে কোনও সন্দেহ নেই যে, এটা পাশ্চাত্যের চাপিয়ে দেওয়া ‘ফেমিনিজ়ম’ ছিল না, না ছিল অন্ধ অনুকরণের মাধ্যমে নিজেদের ঐতিহ্যের অকারণ অপমান। বরং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সম্মিলনের এক প্রয়াস ছিল। এই নারীবাদ পাশ্চাত্য শিক্ষা থেকে প্রেরণা পেলেও তার মূল ছিল দেশের মাটির সংস্কৃতির অনেক গভীরে প্রোথিত একান্তই আমাদের দেশজ এক নারীবাদ।


১৮১০ সালে পাবনার এক অজ পাড়াগাঁ পোতাজিয়া-র দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন রাসসুন্দরী দেবী। মাত্র চার বছরে পিতা পদ্মলোচনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে দারিদ্র আরও বাড়ে। কিন্তু লেখাপড়া শিখতে চায় সেই মেয়ে। সে পথে দারিদ্রের চেয়েও বড় বাধা সে কালের লোকাচার। নারী যদি শিক্ষিত হয়, তবে বৈধব্য নিশ্চিত ভবিতব্য— এমনটাই ছিল সামাজিক বিশ্বাস। একরত্তি মেয়ে এ সবের কিছুই বোঝে না। সে খালি দেখে তারই বাড়িতে বসেছে পাঠশালা, আর সেখানে পড়ছে শুধুই ছেলেরা। অগত্যা দূর থেকে শুনে শুনে আর দেখে সে শিখে ফেলে পড়তে। কেউ অবশ্য সে খোঁজ রাখেনি। দশ বছরেই বিয়ে হয় তার। এর পর এক দিন ঘটনাচক্রে হঠাৎই সে হাতে পায় চৈতন্য ভাগবত-এর পুঁথি। শুরু হয় সবার অলক্ষ্যে রান্নাঘরে ঘোমটার তলায় লুকিয়ে তার এক-একটি পাতা পড়ার চেষ্টা। তখন বয়স ২৬।

Advertisement


কিন্তু সব অক্ষর সেই তরুণী চিনতে পারেন না। বড় ছেলের লেখার খাতার সঙ্গে মিলিয়ে শুরু হয় পাঠ। অনেক যত্নে, শ্রমব্যয়ে তিনি সফল হন। পরে ছেলে কিশোরী লালের জেদে শিখে যান লিখতে। আর লেখেন প্রথম বাংলা ভাষার আত্মজীবনী। তাঁর ‘আমার জীবন’ হয়ে ওঠে ঊনবিংশ শতকে প্রথম দিককার মেয়েদের জীবন ছবির এক বিশ্বস্ত দলিল। এই করুণ ছবিতে কোনও তিক্ততা নেই। নেই কোনও সমাজ সংস্কারের চেষ্টাও। তবে সেই চেষ্টা পাওয়া যায় কৈলাসবাসিনী দেবীর কাছে।


১২ বছর বয়সে সম্পূর্ণ নিরক্ষর অবস্থায় বিয়ে হয়েছিল কৈলাসবাসিনীর ১৮৪৯ সালে। তখনও স্ত্রীশিক্ষার বাধা ভিতর ও বাহিরে। এমনকি তিনি নিজেও স্ত্রীশিক্ষাকে প্রথম দিকে অত্যন্ত ঘৃণা করতেন। সৌভাগ্যক্রমে তিনি স্বামী হিসেবে পান হিন্দু কলেজে পড়া ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত দুর্গাচরণ গুপ্তকে। যাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হত নানান অভিধান, গুপ্ত পঞ্জিকা। তাঁর উৎসাহেই বাংলা শেখেন কৈলাসবাসিনী দেবী। তিনি লিখে ফেলেন প্রথম মহিলা হিসেবে প্রবন্ধের সঙ্কলন, ‘হিন্দু মহিলাগণের হীন অবস্থা’। সেই প্রথম এক মহিলা হিন্দু সমাজের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লিখিত ভাবে প্রতিবাদ করলেন। ব্রাহ্মণ এবং কায়স্থদের কৌলীন্য প্রথা, বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ, বিধবাদের সমস্যা, স্ত্রীশিক্ষা ও স্বাধীনতার অভাব নিয়ে আলাদা আলাদা ভাবে আলোচনা করলেন। নারী লেখনী অতিক্রম করল পারিবারিক গণ্ডি। প্রবল হল সমাজ সংস্কারের বাসনা। একে একে লিখলেন, ‘হিন্দু অবলা কুলের বিদ্যাভাস’, ‘বিশ্ব শোভা’, ‘শেষ প্রবন্ধ সভ্যতা’ এবং ‘সমাজ সংস্কার’। কৈলাসবাসিনী শিক্ষা অবরোধের বিরুদ্ধে কঠোরতর পদক্ষেপ এবং বিবাহপরবর্তী জীবন প্রসঙ্গে সংস্কার দাবি করলেও জীবনের পরিপূর্ণতার ক্ষেত্রে যে মেয়েদের সামাজিক অর্থনৈতিক ভূমিকা পালনের দরকার, তা ভাবেননি, যা ভাবলেন জ্ঞানদানন্দিনী দেবী।
জ্ঞানদানন্দিনীর অন্তঃপুরের বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান প্রেরণা এসেছিল স্বামী সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে, যাঁকে নিঃসন্দেহে বাংলার স্ত্রী-স্বাধীনতার অন্যতম পথিকৃৎ বলা যায়। ঠাকুরবাড়িতে ছেলেদের বিয়ের পরে একটা নিজস্ব ঘর হত, রাতে স্ত্রীর সঙ্গে সেই ঘরে থাকার নিয়ম। অন্য পুরুষের বাড়ির ভেতর সেই ঘরে প্রবেশ নিষিদ্ধ। নাছোড় সত্যেন্দ্রনাথ বন্ধু মনমোহনকে রাতে সবার অলক্ষ্যে নিয়ে এলেন শোয়ার ঘরে। স্ত্রীর মুখের সামনে তুলে ধরলেন দীপের আলো। বাংলার গৃহবধূর মুখে সেই প্রথম আলো। সে দিন তিনি বাহিরকে এনেছিলেন অন্দরমহলে। এর পর শুরু হল অন্দরকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার লড়াই। ১৮৬৪-তে জ্ঞানদানন্দিনী পাড়ি দিলেন বোম্বে, বিলেতফেরত আইএস স্বামীর কর্মস্থলে থাকতে। তার পর সেখান থেকে বিলেতযাত্রা। তার আগে তিনি প্রথম বাঙালি মহিলা হিসেবে নিমন্ত্রিত হয়ে স্বামীর সঙ্গে গেলেন গভর্নর জেনারেল-এর বাড়ির মজলিশে। তিনি তখন আধুনিক নারীর দৃষ্টান্ত। বাঙালি মহিলাদের শেখালেন পেটিকোট, ব্লাউজ-সহ শাড়ি পরার নতুন রীতি, যা হয়ে উঠল প্রামাণ্য পোশাক নারীদের অবরোধ উন্মোচন।


কৃষ্ণভাবিনীও স্বামীর তত্ত্বাবধানে ইংরেজি ও বাংলা শিখে গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডে। স্বামীর সঙ্গে কাটান প্রায় এক দশক। তাঁর লেখা ‘ইংল্যান্ডে বঙ্গমহিলা’ প্রথম বাংলা ভাষায় লেখা কোনও নারীর ভ্রমণবৃত্তান্ত। এতে সমাজ-সচেতনতার পরিচয় পাওয়া যায়। নারী-সমাজের পর্যবেক্ষণ যে ভাবে এতে আছে তা-ও অবাক করার মতো। এক দিকে আছে বিলিতি সমাজের সমালোচনা, অন্য দিকে আছে সেখানকার ভাল উপাদানগুলিকে এ দেশে প্রচলিত করে সমাজ সংস্কারের ইচ্ছা।


স্ত্রীশিক্ষা প্রসার এবং বিধবাদের দুর্দশা মেটাতে হাতেকলমে কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। যখন তাঁর এই গ্রন্থ প্রকাশিত হয়, তখন তাঁর বয়স পঁচিশ বছরেরও কম। তার চেয়েও বড় কথা, স্বদেশে তিনি লেখাপড়া তেমন শেখেননি। তবুও ইংল্যান্ডের এবং দেশের সমাজ সম্পর্কে তাঁর পর্যবেক্ষণ, মন্তব্য ছিল আশ্চর্য ভাবে পরিণত। তিনি ইংল্যান্ডের এবং আমেরিকার নারী মুক্তি আন্দোলনের কথা বলে বলেন, শুধুমাত্র আন্দোলনের মাধ্যমেই অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। কান্না অথবা অনুনয় দিয়ে নয়। তিনি স্পষ্ট বলেন, ইংরেজ মহিলারা পার্লামেন্টের সভ্য মনোনীত করার ক্ষমতা পাওয়ার জন্য যে অতিশয় চেষ্টা ও গোলযোগ করছে, সেই রকম স্ত্রী স্বাধীনতার জন্য প্রত্যেক ভারতবাসীর হৃদয়ে আঘাত করা যেত, যদি ভারতের স্ত্রীলোকেরা অবলা ও নম্র নাম বিসর্জন দিয়ে, অন্তরের বেগ গোপন না রেখে, পুরুষদের সম্মুখে চিৎকার করে কোলাহল করতে পারত। তা হলে হয়তো বঙ্গবাসীর কানে মহিলাদের যন্ত্রণার কথা পৌঁছত। সে সময় মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যাপারে অনেক তথাকথিত প্রগতিশীল পুরুষও সন্দিহান ছিলেন। মনে করা হত, মেয়েদের নারীসুলভ কোমল গুণগুলি এতে নষ্ট হবে। কৃষ্ণভাবিনী এই মনোভাবের তীব্র প্রতিবাদ করেন। তাঁর নারীমুক্তির এই চেতনা আরও বৈপ্লবিক হয়ে উঠেছিল বেগম রোকেয়ার হাত ধরে।
নারীজীবনকে অর্থবান করার জন্য তাঁদের শোচনীয় দাসত্ব থেকে মুক্তি আবশ্যক, এ ব্যাপারে রোকেয়ার চিন্তায় কোনও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল না। সমকালীন অন্য নারী সমাজ সংস্কারকদের থেকে তাঁর পার্থক্য এখানেই। অন্যরা নারীর দুর্দশা লাঘব করতে চেয়েছেন মাত্র। তাঁরাও লেখাপড়া বা গৃহকর্মের কথা বলেছেন। কিন্তু তাঁদের উদ্দেশ্য নারীদের আরও ভাল মা বা স্ত্রী হওয়া, অর্থাৎ ঐতিহ্যশীল ভূমিকাতেই তাঁরা নারীকে দেখেছিলেন। কিন্তু নারী-জীবনের এই সীমাবদ্ধতায় বিশ্বাসী ছিলেন না তিনি। রোকেয়া মনে করেছিলেন, নারীদের সহিষ্ণুতার প্রশংসা আসলে পুরুষ সমাজের শোষণ এবং দুর্ব্যবহারের সমর্থন। নারীমুক্তির অর্থ পুরুষের সমকক্ষতা অর্জন। নারী পুরুষের সহকর্মী সহধর্মিণী হবেন, এটাই ছিল তাঁর আশা। তিনি বলেছিলেন, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন ছাড়া নারীর মুক্তি অসম্ভব। রোকেয়া দাবি করেছিলেন, নারী-পুরুষের সমান অধিকার। নারীরা যে পুরুষ দ্বারা শোষিত— এই চেতনা প্রথম নারী হিসেবে তিনি তুলে ধরেছিলেন। গড়ে উঠেছিল বাংলার নিজস্ব ‘ফেমিনিজ়ম’।

শিবপুর দীনবন্ধু কলেজে ইতিহাসের শিক্ষক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement